একটি কথা সবসময় বলা হয়ে থাকে যে, বিজীতরা নয়, বিজয়ীরাই ইতিহাস রচনা করেন। বড় বড় বীরদের ইতিহাস আমরা সবসময় মনে রাখি, তাদের বিজয়গাঁথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম স্মৃতিতে বয়ে বেড়ায়। আর যারা হেরে যান, তারা যেমন জীবন যুদ্ধেও হেরে যান, তেমনি ইতিহাসের কোনো পাতায়ও তাদের জন্য জায়গা হয় না। বিজয়ীর তলোয়ারের তলায় আসার মুহূর্তটিই কেবল সবার নজরে আসার একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু একটি পর্যায়ে এসে আমরা বুঝতে পেরেছি; কেবল বিজয়ী হওয়া নয়, হেরে যাওয়াও হতে পারে ইতিহাসে জায়গা করে নেয়ার উপায়। যদি না সেই হারের ভেতরও থাকে লড়াই, হেরে না যাওয়ার মানসিকতা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, পেশাদারিত্ব আর মানুষের ভালোবাসা। তাই ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করাটা এখন ততটা সহজ কাজ নয়। কারণ একে এখন তুলে ধরার চেয়ে দৃষ্টিকোণটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানবজাতির ইতিহাসে 'ক্রুসেড' এবং 'মোঙ্গল শাসন' অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত দুটি অধ্যায়। ক্রুসেডের কথা উঠলেই বিখ্যাত কমান্ডার সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর নাম চলে আসবে, যিনি জেরুজালেমকে ক্রুসেডারদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তেমনি মোঙ্গল শাসনের ইতিহাস মানেই মামলুক সুলতান বাইবার্সের নাম, কিন্তু কেউ জালাল-উদ-দীনের কথা বলে না। অথচ তার আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ না করা মানে অসম্পূর্ণ অবস্থায় ইতিহাস লেখা শেষ করা।
মামলুক ও শাহরা
জালাল-আল-দীন যখন তলোয়ার হাতে তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন, সেই সময়টা ছিল মুসলমানদের জন্য দুঃসহ একটা সময়। প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো ক্রুসেডাররা একে একে আনাতোলিয়া, সিরিয়া, মিশর মুসলমানদের থেকে কেড়ে নিচ্ছিল। তারপর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। মুসলিমরা আবার নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ে মনোযোগ দেয়। ঠিক এই অবস্থায় উত্তর দিক থেকে আরেক দুঃস্বপ্ন আর আতঙ্ক মুসলিমদের ঘিরে ধরে। এক নামে যাদের সবাই চেনে- মোঙ্গল বাহিনী। যাদের চলার পথের পেছনে পড়ে থাকত কেবল মৃত মানুষের খুলির পিরামিড, প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া শহর আর হাজার হাজার ধর্ষিতা নারীর কান্না।
মোঙ্গল বাহিনী যখন মধ্য এশিয়া থেকে পশ্চিমে অগ্রসর হতে শুরু করে, তাদের প্রথম প্রতিরোধ আসে খাওয়ারিজম শাহদের পক্ষ থেকে। খাওয়ারিজমের বিভিন্ন শহরের শাসনভার ছিল এসব শাহদের নিয়ন্ত্রণে, যার বিস্তৃতি ছিল পূর্ব ইরান থেকে ভারত পর্যন্ত। সেলজুকদের পক্ষ থেকে এসব শাহরা প্রায় বারো শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত শাসনকাজ পরিচালনা করে। সেলজুক শাসন যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন এসব অঞ্চলের শাহরা স্বাধীনভাবে নিজেদের এলাকা শাসন করতে থাকে, যে এলাকাগুলোর কেন্দ্রবিন্দু ছিল উরগঞ্জ। বর্তমানে উরগঞ্জ উজবেকিস্তান নামে পরিচিত।
দুর্ভাগ্যবশত এই খাওয়ারিজম শাহরা ছিল সেলজুকদের মতো ওঘুজ তুর্কী, যারা সেলজুকদের পতনের মূল কারণ। যার ফলশ্রুতিতে মোঙ্গলরা পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। সেই সময় মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো নিজেদের ভেতর সবসময় যুদ্ধ বাঁধিয়ে রাখতো। যার কারণে মুসলিম বিশ্ব কখনোই এক হওয়ার সুযোগ পায়নি। বড় সাম্রাজ্য শাসনের সুযোগ পেয়েও কেবল নিজেদের সাথে মনোমালিন্যের কারণে ভেতর থেকে মুসলিম সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। সাম্রাজ্য ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত হতে থাকে। যার চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে একে একে মোঙ্গলদের তলোয়ারের নিচে মাথা হারাতে হয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, ঠিক সেই সময়ও মুসলিমরা এক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পারেনি!
স্বপ্ন যখন ভাঙলো
খাওয়ারিজম শাহরা যখন সেলজুকদের প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করে পূর্বদিকে নিজেদের অবস্থান দৃঢ করে নেয়, ঠিক তখনই মোঙ্গল আক্রমণের শিকার হয় তারা। যে আক্রমণের কারণে তাদের টনক নড়ে উঠে, তারা বুঝতে পারে যে এতদিন তারা অহেতুক নিজেদের সাথে লড়াই করছিল! খাওয়ারিজমদের শেষ শাসক ছিলেন জালাল-আল-দীন, যিনি মুসলিমদের একত্রিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন। তার নেতৃত্বগুণে মুসলিমরা আবার ঘুরে দাঁড়ায় এবং মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
জালাল-আল-দীন ছিলেন একজন শক্তিমান শাসক, যার তলোয়ার চালানোর দক্ষতা আর বিচক্ষণতার গুণে মোঙ্গলদের জয়রথ প্রায় থেমে যেতে বসেছিল! তার মা ছিলেন একজন ভারতীয় এবং তার বাবার একাধিক স্ত্রীদের একজন। তার বাবা আলা-আল-দীন মোঙ্গলদের সাথে লড়তে লড়তে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাই তার দাদি তার রাজ্যাভিষেকের পক্ষপাতী ছিলেন। পরবর্তীতে সিংহাসনে আরোহণ করার পর তার বাবাকে সাথে নিয়ে মোঙ্গল কমান্ডার জোচিকে পরাজিত করেন। কিন্তু এটাই মোঙ্গলদের চূড়ান্ত পরিণতি ছিল না। আলা-আল-দীন নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পুত্রের বাহুতে মাথা রেখে, মোঙ্গলদের সাথে লড়াই করতে করতে।
লড়াই হলো শুরু
বাবার মৃত্যুর শোক জালাল-আল-দীনকে ব্যথিত করলেও থামিয়ে দিতে পারেনি। বরং তিনি আবার তলোয়ার তুলে নেন মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে, এবার আরও হিংস্র। ছোট থেকেই তিনি মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা দেখে অভ্যস্ত। তাই ঠিক করলেন সৃষ্টিকর্তা এবং নিজেকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করবেন না। জালাল যখন বুঝতে পারেন, তার সেনাবাহিনীর কমান্ডার তার চেয়ে তার ভাই উজলাক শাহকেই রাজধানী উরগঞ্জের শাসক হিসেবে পছন্দ করে, তখন তিনি উরগঞ্জ থেকে পালিয়ে যান।
পালিয়ে যাওয়ার পর তিনি গজনীতে নিজের আস্তানা তৈরি করেন, এবং সেনাবাহিনী গঠনে মনোযোগ দেন। মোঙ্গল সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করতে সক্ষম এমন এক বাহিনী নিয়ে জালাল-আল-দীন ১২২১ সালে চেঙ্গিস খানের মুখোমুখি হন। নওশেরা গ্রামের পাশে সিন্ধু নদীর তীরে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংগঠিত হয়। একদিকে নিজ চোখে শত্রুকে দেখতে আসা চেঙ্গিস খান, আর অন্যদিকে সদ্য পিতা হারানো জালাল-আল-দীন। যুদ্ধে চেঙ্গিস খানের বাহিনীর তুলনায় জালালের বাহিনী ছিল তুলনামূলক ছোট। তাই তাদের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ালো বুকভরা সাহস আর জালাল-আল-দীনের চতুর নেতৃত্বগুণ।
যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত চেঙ্গিস খানের সেনাবাহিনীক দ্রুত পিছু হঠতে বাধ্য করে জালালের বাহিনী। তার বাহিনী দ্রুতই শত্রুকে কোণঠাসা করে ফেলে সবদিক দিয়ে। স্বয়ং চেঙ্গিস খান শত্রুর অভেদ্য তীর আর নিখুঁত তলোয়ারের আঘাত থেকে বাঁচতে রণক্ষেত্র থেকে দূরে চলে যেতে বাধ্য হন। এটা চেঙ্গিস খানের জন্য যথেষ্ট অপমানজনক! কারণ এত বছরের অভিজ্ঞতায় তাকে কখনো পিছু হঠতে হয়নি, যে শহরেই তিনি একবার পা ফেলেছেন সেটা স্রেফ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।
তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন, চেঙ্গিস খান এই প্রথম একজন যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা পেয়েছেন। যার সাথে লড়াই করতে গিয়ে কোনোমতে জীবন নিয়ে পালাতে হচ্ছে! কিন্তু বিশাল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করতে আসা মোঙ্গল সেনাবাহিনী দ্রুতই তাদের সামলে নেয়। এবার আগের ভুলগুলো শুধরে এগিয়ে আসে আবার যুদ্ধের ময়দানে। ততক্ষণে স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে নামা জালালের বাহিনী আকারে আরও ছোট হয়েছে। তাই দ্বিতীয় দফায় যখন চেঙ্গিস খান আক্রমণ করেন, তখন নিমিষেই কচুকাটা হতে থাকে তার সৈন্যরা। জালালের বাহিনী এবার পিছু হঠতে হঠতে নদীর একেবারে কিনারায় চলে আসে। তার সাথে রয়েছে অল্প কিছু সৈন্য। ওদিকে আহত সৈন্যদের আর্তচিৎকার চলছে, ঘোড়ার খুরের আওয়াজ দ্রুতই এগিয়ে আসছে।
জালালের সাথে ছিল তার পরিবারের লোকজন, বেশিরভাগই নারী। তার পূর্বের অভিজ্ঞতা বলে চেঙ্গিস খান কখনোই বিজীত দলের নারীদের ক্ষমা দেখান না।
চেঙ্গিস খান ও তার বাহিনী সবসময় বিজীত দলের নারীদের তাদের চোখের সামনে ধর্ষণ করে মজা পেত! বন্দি সৈনিকরা চেয়ে দেখে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকতো না। এটাই ছিল চেঙ্গিস খানের যুদ্ধনীতি।
তাদের ভাগ্যে জোটে ধর্ষণের পর করুণ মৃত্যু কিংবা যৌনদাসী হিসেবে সারাজীবন কাটাতে হয় তাদের। তাই জালাল নিজের পরিবারের নারীদের বস্তায় ঢুকিয়ে নদীতে ছেড়ে দেন, যাতে তারা স্রোতে ভেসে দূরে কোথাও ঠাঁই নিতে পারে। তারপর নিজের জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দেন তিনি। নদীর ওপারে পৌঁছে তীরে ওঠার পর ক্লান্ত শরীরে মাটিতে শুয়ে পড়েন। এপারে চেঙ্গিস খান নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকেন, আর আশ্চর্য হয়ে দেখতে থাকেন নিজের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে! আর মুখে বিড়বিড় করে নিজের সন্তানদের বলতে থাকেন, "জালাল-আল-দীনের মতো আমার যদি একটা ছেলে থাকতো! যে বাবার পাশে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবে।"
চেঙ্গিস খানকে দেখতে পেয়ে জালাল নদীর ওপার থেকে হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দেন, তিনি আবার আসবেন চেঙ্গিস খানের সাথে লড়তে! তিনি ভারতে চলে যান, তবে সেখান থেকে তাকে আবার নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এখানে তিনি আবারও সৈন্য সংগ্রহে নামেন। তার সামনে দুটো বিপদ ছিল, একদিকে মুসলিমদের মধ্যে চলমান পূর্বশত্রুতা, অন্যদিকে চেঙ্গিস খানের সাথে অসমাপ্ত যুদ্ধ। নিজভূমে তিনি বারবার বাধার সম্মুখীন হতে থাকেন, কয়েকটি লড়াইয়ে জয়লাভ করলেও শেষে আলা-আল-দীন কায়কোবাদের কাছে পরাজিত হন। হারের পর জালাল-আল-দীন পালিয়ে যান। ১২৩১ সালে তুরস্কের দিয়ারবাকিরে জালাল-আল-দীন মৃত্যুবরণ করেন। তবে তার মৃত্যু নিয়ে সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারেননি।
This Bengali article is about jalal-al-din, who fought against zhengis khan. defeated in war but gave zhengis khan a lesson!
Related Sources:
1. jalaluddin khwarazm- The Express Tribune
2. Defeated yet proud- Daily Sabah
3. jalal-al-din- Encyclopedia iranica
4. jalal-ad-din khwarazmshah - AF
Featured image: ringmar.net