Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিলুপ্ত কয়েকটি কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা

স্বৈরাচারী বা অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোতে জনগণের ওপরে নজরদারি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রীয় কাজ। বর্তমানে অবশ্য পৃথিবীর অনেক দেশেই নজরদারির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব সংস্থা এই কাজগুলো করে তাদেরকে গুপ্ত পুলিশ বা ওই ঘরানার নাম দেওয়া হয়। এই বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর সদস্যরা সরকারি সমর্থনের ফলে কখনো কখনো এত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে যে দেশের ইতিহাসেই এরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। গুপ্ত পুলিশ বা সিক্রেট পুলিশ যদি লাগামছাড়া শক্তি পেয়ে বসে, তবে দেশের মানুষের কাছে তারা হয়ে ওঠে আতংকের অন্য নাম। বিলুপ্ত করে দেওয়া এমনই কয়েকটি কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থার কথা আজ বলবো।

স্তাসি (পূর্ব জার্মানি)

১৯৪৯ সালে সোভিয়েত সমর্থিত পূর্ব জার্মানী গঠিত হওয়ার মাস চারেকের মধ্যে স্তাসি গঠন করা হয়। স্তাসি শব্দটি জার্মান মিনিস্ট্রি ফর স্টেট সিকিউরিটি এর সংক্ষিপ্ত রূপ। শুরু দিকে এই সংস্থা খুব ছোট ছিল। মূলত পশ্চিমা গুপ্তচর আর নাৎসীদের ওপরে নজরদারি করাই এর কাজ ছিল। তবে ১৯৫৭ সালে এরিখ মিয়েল্কে এর প্রধান হয়ে আসার পর সব বদলে যায়। ১৯৮৯ সাল স্তাসিতে কর্মরত ছিল এক লক্ষ মানুষ। এর বাইরে অনিয়মিত এজেন্ট আর ইনফরমার ছিল প্রায় ২০ লক্ষ। মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ স্তাসির নজরদারির আওতায় ছিল। ইরাক সহ এশিয়া আর আফ্রিকার বহু দেশে স্তাসি এজেন্টরা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছে।

source: pinterest

মিয়েল্কেকে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম বলতো ‘মাস্টার অব ফিয়ার’। সোভিয়েতদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিয়েল্কে এর আমলে স্তাসি বিশ্বের সবথেকে দক্ষ এবং কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থায় পরিণত হয়। সে আমলে পূর্ব জার্মানি থেকে অনেকেই পালিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে চলে যেত। স্তাসি কর্মকর্তারা এসব পালিয়ে যাওয়া লোকদেরকে অপহরণ করে ফেরত আনতেন। পূর্ব জার্মানীর নাগরিকদের ওপরে সার্বক্ষণিক নজরদারি করবার জন্য স্তাসি সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে প্রচুর এজেন্ট নিয়োগ করতো। সমাজে সৃষ্টি হয়েছিল এক চাপা আতংক। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারতো না। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অসন্তোষ দানা বাধতে পারতো না। বার্লিন প্রাচীর টপকে পালাবার সময় অনেক মানুষ স্তাসি এজেন্টদের গুলিতে নিহত হয়েছেন।

source: wikimedia commons

১৯৮৯ সালে মিয়েল্কে সংসদে বক্তৃতা দিতে গেলে তাকে খুব বাজেভাবে অপদস্থ করা হয়। সেই ফুটেজ আবার সম্প্রচারও করা হয়। সবাই বুঝতে পারে স্তাসি আর টিকবে না। কয়েক মাসের মধ্যে, ১৯৯০ সালে স্তাসি বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। ‘দ্য লাইভস অব আদার্স’ নামের বিখ্যাত চলচ্চিত্রটি জনৈক স্তাসি কর্মকর্তাকে নিয়ে বানানো হয়েছে।

সাভাক (ইরান)

অর্গানাইজেশন অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি ওরফে সাভাক ছিল ইরানের শাসক রেজা শাহ পাহ্লবী এর গোয়েন্দা সংস্থা। ১৯৫৭ সালে সিআইএ আর মোসাদের আদলে এটি গড়ে তোলা হয়। ইরানের সবথেকে ভয়ংকর সংগঠন ছিল এই সাভাক।

রেজ শাহ কম্যুনিস্ট আর ধর্মীয় সংগঠনগুলিকে ভীষণ ভয় পেতেন। তার নির্দেশে সাভাক গোটা দেশ জুড়ে যথেচ্ছ ধড়পাকড় চালাতো। বিশেষ করে সাভাকের অত্যাচার আর জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি ছিল ভয়ংকর। বন্দীকে প্রয়োজনে অপহরণ করে খুন করে ফেলতেও সাভাক এজেন্টদের বাধতো না। বিদেশে পড়তে যাওয়া ইরানি ছাত্রদের ওপরেও নজরদারি চালাতো এই সংগঠন।

ঘুমাতে না দেওয়া, একলা আটকে রাখা, পায়ের পাতায় চাবুক মারা, নখ উপড়ে ফেলা, বৈদ্যুতিক শক, সাপ দিয়ে ভয় দেখানো, নাকে এসিড ঢেলে দেওয়া, ধর্ষণ, বন্দীর গায়ে মূত্র বিসর্জন- সাভাকের অত্যাচারের ধরণ তালিকা করেও শেষ হবে না। বন্দীরা শেষমেষ বাধ্য হয়ে টিভিতে এসে স্বীকার করতেন নিজেদের দোষ। তারা ইরান সরকারের গুণগাণ করতেন। না করলেই আবার অত্যাচার। সাভাক তেহরানের কুখ্যাত এভরিন কারাগারসহ দেশজুড়ে অনেকগুলো নিজস্ব কারাগার পরিচালনা করতো। ১৯৭৯ সালে শাহের পতনের কিছুদিন আগে সাভাক বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। ‘পার্সেপোলিস’ নামক সিনেমাটিতে সাভাকের অত্যাচারকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

ওখরানা (রাশিয়া)

১৮৮১ সালে ওখরানা প্রতিষ্ঠা করে রুশ জার। মূলত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া নিহিলিস্টদের দমন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধেও এরা প্রচুর কাজ করেছি। রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ, বিশেষ করে নির্বাসিত আর পলাতক কম্যুনিস্টদের অন্যতম আড্ডা প্যারিসেও ওখরানা সক্রিয় ছিল।

source: rarehistoricalphotos.com

ওখরানা কুখ্যাত ছিল এর ভয়ানক অত্যাচার আর বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের জন্য। ওখরানা কর্মকর্তারা বিপ্লবীদের মধ্যে ঢুকে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ড চালাতেন। অনেক প্রথম সারির বিপ্লবী তাদের এই প্রলোভনে পা দিয়ে বিপদে পড়েছেন। বলশেভিকেরা দাবি করে ‘ব্লাডি সানডে’ তে পাদ্রী গ্যাপন ওখরানা কর্মকর্তাদের নির্দেশমতো কাজ করছিলেন। ওখরানা বলশেভিকদের মোকাবেলা করবার জন্য শ্রমিকদের মধ্যে আলাদা ট্রেড ইউনিয়ন পর্যন্ত গড়ে তুলেছিল। তাদের গোপন সাহায্যে ১৯০৩ সালে রাশিয়ায় ‘দ্য প্রটোকলস অব দ্যা এল্ডার্স অব জায়ন’ নামের একটি ইহুদী বিদ্বেষী পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, ট্রটস্কীসহ অনেক বিখ্যাত বলশেভিক নেতা ইহুদি পরিবারে জন্মেছিলেন। পরে হিটলারের সমর্থকেরা এই পুস্তিকাটিকে ইহুদীদের ওপরে আক্রমণ করবার জন্য অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতো।

১৯১৭ সালে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরে উত্তেজিত জনতা ওখরানার কার্যালয় পুড়িয়ে দেয়।

এনকেভিডি (সোভিয়েত ইউনিয়ন)

নারোদনি কমিসারিয়েট ভনুত্রেন্নিখ ডেল ওরফে এনকেভিডি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯১৭ সালে। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এটি কেবল সাধারণ পুলিশ সংস্থা ছিল। পরে, ১৯৩৪ সালে গুপ্ত পুলিশ ওগপু কে এর সাথে জুড়ে দিলে এনকেভিডি দারুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ও পরবর্তী সময়ে পূর্ব ইউরোপ আর সোভিয়েত ইউনিয়নে গজিয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলোকে পিষে ফেলে এনকেভিডি। কাতিন গণহতার মতো অনেকগুলো গণহত্যা আর খুনের রক্ত লেগে আছে এই সংস্থার গায়ে। লক্ষাধিক মানুষ মরেছে এই সময়ে। এর বাইরে এনকেভিডির সবথেকে কুখ্যাত কাজ হল তিরিশের দশকে স্তালিনের নির্দেশে সোভিয়েত সমাজ আর কম্যুনিস্ট পার্টির লক্ষ লক্ষ মানুষকে বন্দী ও হত্যা করা, অত্যাচার, গুলাগে পাঠিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এনকেভিডির হাতে কেবল স্তালিনের সমালোচক হওয়ার অপরাধে বহু নিবেদিত কম্যুনিস্টকে প্রাণ খোয়াতে হয়েছে। ট্রটস্কিকেও হত্যা করে এক এনকেভিডি এজেন্ট।

source: pinterest

এনকেভিডি অবশ্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান বাহিনীর ওপরে অসংখ্য গুপ্ত হামলা চালিয়ে প্রভূত সাহায্য করেছিল মিত্রশক্তিকে। এর এজেন্টদের দক্ষতার কারণেই ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন অতি অল্প সময়ে পরমাণু শক্তিধর হয়ে ওঠে। এনকেভিডির প্রধানদের দুর্ভাগ্যও লক্ষ্য করবার মতো। লক্ষ মানুষের অভিশাপের কারণেই কিনা কে জানে, এর প্রথম পরিচালক গেন্নাদি ইয়াগোদাকে স্তালিনের নির্দেশে খুন করা হয়। পরবর্তী প্রধান নিকোলাই ইয়াজভেরও একই পরিণতি হয়। শেষজন, ল্যাভরেন্তি বেরিয়া কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করে, গুলাগে পাঠিয়ে শেষমেষ নিজেই এক সোভিয়েত জেনারেলের গুলি খেয়ে মরেন। ১৯৫৩ সালে এনকেভিডি ভেঙ্গে কেজিবি গঠন করা হয়।

 দিনা (চিলি)

দিরেক্তোরেত দে ইন্তেলিজন্সিয়া ন্যাশিওনাল ওরফে দিনা গঠন করা হয় ১৯৭৩ সালে, চিলিতে। জনপ্রিয় নেতা সালভাদর আয়েন্দেকে খুন করে তখন সদ্য ক্ষমতায় এসেছেন অগুস্তো পিনোশে। দেশব্যাপী বিক্ষুব্ধ মানুষকে বশে আনবার জন্য দিনা গঠন করা হয়। শুরুতে এটি সেনাবাহিনীর হাতে থাকলেও ১৯৭৪ সালে একে পৃথক সংস্থা করা হয়

source: The Santiago Times

দিনা চিলিতে হাজার হাজার মানুষের গুম আর হত্যার জন্য দায়ী। মেয়েদেরকে ধর্ষণ করা আর জীবিত বন্দীদের পায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেওয়া ছিল এর অত্যাচারের অন্যতম ধরণ। অপারেশন কন্ডোর আর অপারেশন কলম্বো নামের দুটি কুখ্যাত কম্যুনিস্ট বিরোধী কার্যক্রমে মার্কিন সিআইএর সাথে কাজ করেছে দিনা কর্মকর্তারা। হাজার হাজার বন্দীকে আতাকাম মরুভূমির বিরান অঞ্চলে আটকে রাখতো দিনা কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে, পিনোশের পতনের পর অনেক দিনা এজেন্টকে বিচারের আওতায় আনা হয়। পিনোশে অবশ্য বিচারকাজ শুরু হওয়ার আগেই মারা যান।

ফিচার ইমেজ – renegadetribune.com

Related Articles