Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: যার রক্তে ভিজে আছে প্রতিটি বাংলা বর্ণমালা

১৯৪৭ সালের দেশভাগে জন্ম নেওয়া নতুন দেশ পাকিস্তান, নতুন দেশের মুদ্রা থেকে ডাকটিকেট, মানিঅর্ডার থেকে শুরু করে নিত্য দিনের প্রয়োজনীয় সরকারি সব কাগজে বাংলাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকে এভাবে দূরে সরিয়ে রাখায় চাপা কষ্ট বুকে নিয়েই গণপরিষদে একটি সংশোধনী প্রস্তাব এনেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত; Source: bonikbarta.net

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, পাকিস্তানের বয়স তখন ছয়মাসের ঘরে, করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে প্রস্তাব করা হয়েছিলো, “ইংরেজির সঙ্গে উর্দুও পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে”। ধীরেন্দ্রনাথের আনা সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয়েছিলো, বাংলাকেও পরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য।

ধীরেন্দ্রনাথ বাঙ্গালী এবং মাতৃভাষার প্রতি তার সহজাত আবেগ থাকা স্বাভাবিক। পাকিস্তানের গণপরিষদে দাঁড়িয়ে যে তিনি সেই আবেগের প্রতিনিধিত্ব করছেন সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েই তিনি বলেছিলেন,

“So sir, I know I am voicing the sentiments of the vast millions of our state and therefore Bengali should not be treated as provincial language. It should be treated as the language of the state.”

তবে গণপরিষদের সেই অধিবেশনে তার বক্তব্যে যতটা না আবেগের প্রতিফলন ছিলো বরং তার চেয়ে বেশি ছিলো যুক্তির ধার। পাকিস্তানের ছয় কোটি নব্বই লক্ষ জনগণের মধ্যে চার কোটি চল্লিশ লক্ষই যে বাংলা ভাষাভাষী এবং পাকিস্তানের রাজকার্যে তাদের ভাষাকে বাদ দিলে সমস্যার সৃষ্টি হবে সেটিও তার বক্তব্যে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তার বক্তব্য থেকেই প্রথম দাবি ওঠে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার। বাংলার পথে প্রান্তরে ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতাকেই অভিজাত গণপরিষদ সদস্যদের সামনে তুলে ধরেছিলেন তিনি। পূর্ব বাংলার একজন মানুষ সাধারণ পোস্ট অফিসে মানিঅর্ডার করতে গেলেও যে উর্দু ভাষায় লিখিত ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে হিমশিম খান এই কথাটিই ধীরেন্দ্রনাথের বক্তব্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছিলো সেদিন। খাম-পোস্টকার্ডের ভেতরে বন্দী থাকা ছাড়া বাংলার যেন আর কোনো গতি নেই।

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন কাজটি তার জন্য সহজ হবে না। তবে তার আশা ছিলো পূর্ব বাংলার প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতারা তার পক্ষে সমর্থন দেবেন।

প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমুদ্দীন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন; Source: dailyasianage.com

কিন্তু পূর্ব বাংলার কোনো মুসলমান গণপরিষদ সদস্যই তার এই প্রস্তাবকে আমলে নিলেন না। ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান উর্দুভাষী খাজা নাজিমুদ্দীন সরাসরি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বসলেন। কটাক্ষের তীরে ধীরেন্দ্রনাথকে জর্জরিত করলেন খাদ্যমন্ত্রী রাজা গজনফর আলী খান। আর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই প্রস্তাবের সূত্র ধরে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বললেন,

“আসলে যখন সংশোধনী নোটিশটি দেওয়া হয় তখন ভেবেছিলাম এর উদ্দেশ্যটা নির্দোষ। ‘কিছু লোক’ যদি গণপরিষদে ইংরেজি বা উর্দুতে দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের প্রকাশ করতে না পারে তাহলে তারা ওই ভাষায় বক্তব্য পেশ করতে পারে। কিন্তু এখন দেখছি আগে যা ভাবছিলাম এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য তো তেমন নির্দোষ নয়।”

মূলত, প্রথমে যখন গণপরিষদের ভাষা হিসেবে ইংরেজী আর উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে প্রস্তাব করা হয় তখন পর্যন্ত লিয়াকত আলী খান এই প্রস্তাবটিকে নির্দোষ ভেবেছিলেন।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান; Source: brecorder.com

কিন্তু গণপরিষদে দেওয়া বক্তব্যে যখন তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যে ন্যায্য প্রস্তাবটিকেও সামনে নিয়ে আসলেন তখন প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঢেলে দিতে ভুল করেননি। পাকিস্তানের ভিত্তি যে ধর্মের উপর দাঁড়িয়ে আছে এই জানিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এই রাষ্ট্রের ধর্মীয় চরিত্র বজায় রাখার জন্য সর্বত্রই উর্দুর প্রাধান্য থাকা প্রয়োজন সেই ব্যাপারে একটি অযৌক্তিক বক্তব্যও দিয়ে দিলেন। পাশাপাশি সংসদে বাঙ্গালীর প্রাণের দাবী যৌক্তিকভাবে তুলে ধরার অপরাধে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে বিছিন্নতাবাদী উপাধি দিয়ে দিলেন। পূর্ব বাংলা থেকে সাধারণ আসনে নির্বাচিত সদস্য প্রেমহরি বর্মন বাদে প্রায় সকল বাঙ্গালী গণপরিষদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সেই বক্তব্য বিনা বাক্যব্যয়ে হজম করে নিলেন। ফলাফল হিসেবে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বাঙ্গালী স্পিকার তমিজউদ্দিন খানও রায় দিতে বাধ্য হলেন প্রস্তাবটি গৃহীত হচ্ছে না। বাঙ্গালীর ভাষার দাবীতে প্রথম যে নিয়মতান্ত্রিক দাবীটি উঠেছিলো তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেলো। কিন্তু এই গণপরিষদে এই একটি মাত্র প্রস্তাব সমগ্র পূর্ব বাংলায় এক ঝড় তুলবে, সেই ঝড়ই একদিন বাঙ্গালীকে মুক্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেকথা তখনো পাকিস্তানীদের শাসকদের হিসেবের বাইরে।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অনেকটা ব্যথিত হৃদয় নিয়েই করাচি থেকে ঢাকায় ফিরলেন। তেজগাঁ বিমান বন্দরে তার জন্যে অপেক্ষা করছিল অভূতপূর্ব এক সংবর্ধনা। সেই সংবর্ধনাকে তিনি তার স্মৃতিকথায় এভাবেই অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন,

“প্রথম গণপরিষদ অধিবেশন শেষে করাচি থেকে ফিরলাম। অনুন্নত তেজগাঁ বিমান বন্দরে সিকিউরিটি বলতে কিছুই নেই। প্লেন থেকে নেমে দেখলাম, প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশজন যুবক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাদের প্রত্যেকের গায়ে চাদর। আমার ধারণা হলো, গণ-পরিষদে বাংলার সপক্ষে কথা বলার দরুণ এরা বিক্ষোভ জানাতে এসেছে, এদের চাদরের আড়ালে অস্ত্রও থাকতে পারে। সংশয় নিয়ে এগিয়ে গেলাম। যখন ওদের একেবারে নাগালের মধ্যে চলে গেছি তখন হঠাৎ প্রত্যেকে চাদরের তলা থেকে রাশি রাশি ফুল বের করে আমার ওপর বর্ষণ করতে লাগলো। ওরা সবাই ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।”

ধীরেন্দ্রনাথের প্রস্তাবটি গণপরিষদে বাতিল হয়ে যাবার ফলে ২৬ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট অনুষ্টিত হয়। স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্লাশ ছেড়ে বেড়িয়ে আসে। বাংলার সপক্ষে স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি খাজা নাজিমুদ্দীন, তমিজউদ্দীন খানকে ধিক্কার জানানো হয় এই ধর্মঘট থেকেই। সেই বছরের ১১ মার্চ সমগ্র প্রদেশে ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিল হয়ে যাওয়ার ফলে তিনিও ব্যথিত হয়েছিলেন, প্রতিবাদে যুক্ত করেছিলেন নিজেকে। এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছিলেন,

“পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশ এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশ যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে।… সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হল।”

১১ মার্চের ছাত্র ধর্মঘটে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মত শিক্ষকেরাও সামনে থেকে রাস্তা দেখিয়ে গেছেন। এই আন্দোলনে গ্রেফতার হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, রণেশ দাশগুপ্তসহ অসংখ্য ছাত্রনেতা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তখন বাঙ্গালীকে একদম ভেতর থেকে নাড়া দিয়েছে।

শেরে বাংলার কাছ থেকে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত; Source:  bdnews24.com

বাঙ্গালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম উপাদান ছিলো এই বাংলা ভাষা। পাকিস্তান গণপরিষদে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হলো, জিন্নাহ আর খাজা নাজিমুদ্দীন বলে গেলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আর তাই বাঙ্গালীকে নিজের আত্মপরিচয়ের এই উপাদানকে বাঁচাতে রাজপথে নামতে হয়েছিলো। ভাষা সাধারণ মানুষের জীবনের কতটা বড় অংশ জুড়ে থাকে তা হয়তো পাকিস্তানের গণপরিষদের অভিজাতশ্রেণী বুঝতে পারেনি। কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন তার দাবী মেনে না নিলে যে এই দাবী রাজপথেই আদায় হবে।

চার বছরের ঘটনাক্রমেই ১৯৫২ সালের সেই একই ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রাণের ভাষার দাবী আদায় করে পাকিস্তানী শাসকদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলো বাঙ্গালী। হয়তো বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না বলেই ১৯৪৭ এ দেশভাগের কঠিন মুহুর্তেও থেকে গিয়েছিলেন নিজের পিতৃভূমিতে।

১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার বাকী সদস্যদের সাথে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত; Source: bdnews24.com

তবে শুরু থেকেই কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকা ধীরেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ভারত ভাগ না হোক, অন্তত ধর্মের ভিত্তিতে তো নয়ই। বাংলাকে ভাগ করার সিদ্ধান্তেও চরমভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ। কংগ্রসের অসংখ্য নেতা-কর্মী, বন্ধুবান্ধব আর অনুসারীদের অনুরোধ উপেক্ষা করেও থেকে গেলেন পূর্ববঙ্গে, মাতৃভূমির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেননি। কঠিন সেই দিনগুলোর কথা তার স্মৃতিকথায় ঠিক এভাবেই লেখা আছে,

“পাকিস্তান হওয়ার পর আমার বহু রাজনৈতিক বন্ধু পাকিস্তান ত্যাগ করিয়া ভারতবর্ষে চলিয়া যান। ত্রিপুরা জেলার বহু কংগ্রেস কর্মী ও বহু লোক পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া যান। অভয় আশ্রমের বহু কর্মী পূর্ববঙ্গ ছাড়িয়া পশ্চিমবঙ্গে তাঁহাদের কর্মস্থান ঠিক করিলেন, তাহাতে আমি বহু রাজনৈতিক বন্ধু হারাইলাম, বেদনায় মন ক্লিষ্ট হইয়া গেল। কিন্তু পূর্ববঙ্গে থাকিব এই সংকল্প করিয়াছি, সেই জন্য পশ্চিমবঙ্গের বন্ধুবান্ধবের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করিয়া পূর্ববঙ্গে রহিয়া গেলাম।”

১৮৮৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই মানুষটি আজীবন নিজেকে মাটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবেই চিন্তা করে গেছেন। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চে নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন বাঙ্গালীর স্বায়ত্ত্বশাসনের সূর্য ওঠার কথা।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে এ্যারোমা দত্ত ও রাহুল দত্ত; Source: bdnews24.com

কুমিল্লার সেই বাড়ি থেকেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায়। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পবিত্র রক্তে আজো ভিজে আছে বাংলাদেশের মাটি, আমাদের প্রতিটি বাংলা শব্দে পরম মমতায় জড়িয়ে আছেন বাংলা ভাষা আন্দোলনের এই ধ্রুবতারা।

ফিচার ইমেজ: bdnews24.com

Related Articles