ক্যাপ্টেন নামের একটি জার্মান শেফার্ড কুকুর টানা ১১ বছর ধরে রাত হলেই মনিব মিগুয়েল গুজমানের কবরের পাশে শুয়ে থাকতো। কুকুরটি প্রায়ই তার মনিবের কবরের পাশে চুপচাপ বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বসে থাকতো। প্রভুভক্তির দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী কুকুরটিকে কখনো প্রয়াত প্রভুর সমাধি থেকে আলাদা করা যেতো না। মানুষ আর কুকুরের এই গভীর অনুভূতির সম্পর্কটা প্রভু-ভৃত্য বা মনিব-মান্য দিয়ে বিশেষায়িত করলে একটু কমই হয়ে যাবে।
এমন মানবিক একটি সম্পর্ক কেবল দুই বন্ধুর মাঝেই থাকতে পারে। কিন্তু কুকুরের মতো একটি প্রাণী কীভাবে মানুষের এত কাছাকাছি এলো? কীভাবে তারা মনিবের জন্য প্রাণ দিতে শিখলো? কেন তারা এত প্রভুভক্ত? কত বছরের পরিক্রমায় মানুষের বন্ধুতে পরিণত হয়েছে? কে সর্বপ্রথম কুকুরকে পোষ মানিয়েছিল?
কুকুরকে পোষ মানানোর ইতিহাস জানতে হলে, প্রাচীনকাল থেকে মানুষ এবং কুকুরের মধ্যকার যে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে সেই গল্প আগে জানতে হবে। প্রথমদিকে মানুষের শিকার কাজে সঙ্গ দিতে, জিনিসপত্র দেখাশোনার কাজে, পূর্বাভাস ও সংকেত প্রাপ্তির জন্য, খাদ্যের উৎস খোজার কাজে কুকুরের সহযোগিতার সূত্র ধরে মানুষের সাথে এই প্রাণীটির সখ্যতার শুরু হয়। দিনে দিনে তা ভালবাসা এবং বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছে। কিন্তু ঠিক কবে থেকে এই সখ্যতা বা বন্ধুত্বের শুরু তা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে।
কুকুরের বিবর্তন পরীক্ষা করার জন্য মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ (mtDNA) ব্যবহার করা হয়েছে। এই গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল থেকে ধারণা করা হচ্ছে, আজ থেকে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে নেকড়ে এবং কুকুর দুটি আলাদা প্রজাতিতে বিভক্ত হয়েছিল। এই গবেষণার আলোকে আরো ধারণা করা হচ্ছে, কুকুরকে পোষ মানানোর প্রথা সর্বপ্রথম চালু হয়েছিল আজ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে। কিন্তু গবেষকরা এই ফলাফলের সাথে একমত হতে পারছেন না। কিছু পরীক্ষার বিশ্লেষণ মতে, কুকুরকে পোষ মানানোর সর্বপ্রথম প্রচেষ্টাটি গৃহীত হয়েছিল পূর্ব এশিয়ায়। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, কুকুরকে সবার আগে পোষ মানানো হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে এবং পরবর্তীতে ইউরোপে কুকুরকে পোষ মানানোর প্রথা চালু হয়েছিল।
দুটি স্থানে পোষা কুকুরের উৎপত্তি?
২০১৬ সালে জীব প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞানী গ্রেগর লারসনের নেতৃত্বে একটি গবেষণা দল এমটিডিএনএ গবেষণা প্রকাশ করেছিল। এই গবেষণাপত্রে তারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, কুকুরকে পোষ মানানোর আদিম রীতির উৎপত্তি একটি স্থানে না। বরং দুটি স্থানে একইসাথে কুকুরকে পোষ মানানোর চেষ্টা চলছিল। একটি ছিল পূর্ব ইউরেশিয়া অঞ্চল, আরেকটি পশ্চিম ইউরেশিয়া অঞ্চল।
প্রকাশিত গবেষণার বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল, এশিয়া অঞ্চলের কুকুরগুলো এশিয়ার নেকড়েদের বংশধর। প্রায় ১২,০০০ বছর আগে এই নেকড়েদেরকে পোষ মানানোর মাধ্যমে এশীয় কুকুরদের আগমন হয়। অন্যদিকে ইউরোপের কুকুরদের আদি বংশধর হচ্ছে পুরাতন প্রস্তর যুগের ইউরোপিয়ান নেকড়ে, যাদেরকে ১৫ হাজার বছর পূর্বে মানুষ বশ্যতা স্বীকার করানোর চেষ্টা করেছিল এবং সময়ের পরিক্রমায় সেগুলো আজকের ইউরোপিয়ান কুকুরে পরিণত হয়েছে। এরপর এশিয়ান কুকুরগুলো মানুষের মাধ্যমেই ইউরোপে পৌঁছেছে এবং ইউরোপিয়ান প্রস্তরযুগের কুকুরকে ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপিত করেছে।
এবার তাহলে ব্যাখ্যা করা যাক, আগের ডিএনএ পরীক্ষাগুলো কেন বলেছে যে নেকড়ে থেকে কুকুরের বিবর্তন এবং কুকুর পালনের ঘটনা সর্বপ্রথম শুধু একটি স্থানেই ঘটেছে এবং লারসনের গবেষণা কেন বলছে এই প্রক্রিয়া দুটি স্থানে দু'ভাবে শুরু হয়েছিল! লারসনের মতবাদ অনুসারে, প্রাচীন প্রস্তরযুগে দুই ধরনের কুকুরের অস্তিত্ব ছিল। এদের মধ্যে ইউরোপিয়ান প্রাচীন প্রস্তরযুগের কুকুরগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়। কারণ সেগুলো এশিয়ান কুকুর দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে গিয়েছিল। আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। যেমন- প্রাচীন আমেরিকান কুকুরের তথ্য কোনো গবেষণায় পাওয়া যায় না কেন? গবেষক ফ্রানতস এবং অন্যান্যরা বলেন, কুকুরের বিবর্তনের উৎস হিসেবে যে দুটি প্রজাতিকে বলা হচ্ছে তাদের আদি বংশধর একই প্রজাতির নেকড়ে এবং এই দুটো ধীরে ধীরে কমে এসেছে এবং এখন অনেকটাই বিলুপ্ত।
কুকুরের বিবর্তন নিয়ে গবেষণায় অবতীর্ণ অন্যান্য পণ্ডিতরা তদন্ত করে দেখেছেন, এশিয়া অঞ্চলের কিছু কুকুরের অভিবাসন বা মাইগ্রেশনের কিছু প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো ইউরোপের কুকুরকে পুরোপুরিভাবে প্রতিস্থাপন করতে পারেনি। তাই তারা কুকুরের আদি জন্মস্থান হিসেবে ইউরোপকে অগ্রাহ্যও করে পারেননি।
কুকুর পোষার গোড়াপত্তন
স্বীকৃত তথ্য এবং গবেষণালব্ধ উপাত্ত অনুসারে, পোষা কুকুরের সন্ধান সর্বপ্রথম পাওয়া গিয়েছিল ১৪ হাজার বছরের পুরনো জার্মানির বন-ওবারকাসেলের একটি কবরস্থানে, যেখানে মানুষ এবং কুকুরকে কবর দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। চীনে সর্বপ্রথম পোষা কুকুরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল ৭০০০-৫৮০০ খ্রিস্টপূর্বে নব্য প্রস্তরযুগে হেনান প্রদেশে। তবে মানুষ এবং কুকুরের সহাবস্থানের সর্বপ্রথম সন্ধান পাওয়া যায় ইউরোপের প্রস্তরযুগীয় উত্তরাঞ্চলে। সেই কুকুরগুলো যে অবধারিতভাবে পোষ্য কুকুর ছিল এমনটি না-ও হতে পারে। এসব অঞ্চলের মধ্যে বেলজিয়ামের গোয়েত গুহা, ফ্রান্সের চাউভেত গুহা, চেক-রিপাবলিকের প্রেডমস্তি অন্যতম।
ইউরোপে মধ্য প্রস্তরযুগের কিছু কবরস্থানে, যেমন- সুইডেনের স্কটহোমে কুকুরের সমাধির (খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫০-৩৭০০) সন্ধান পাওয়া যায়। অর্থাৎ তখন থেকেই শিকারীদের সাথে কুকুরের বন্ধুত্ব রয়েছে।
দক্ষিণ আমেরিকার উতাহ অঞ্চলের ডেঞ্জার গুহায় ১১ হাজার বছর আগের একটি সমাধিতে একটি কুকুরের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, কুকুরের এই প্রজাতিটিই এশিয়ান কুকুরদের পূর্বসূরি। নেকড়ের সাথে চলমান সংকরায়নের ফলে কুকুরের একটি চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য আমেরিকান কালো নেকড়ের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। কালো পশম কুকুরের বৈশিষ্ট্য, নেকড়ের নয়।
আদিকালে কুকুরেরও ব্যক্তিত্ব ছিল!
সাইবেরিয়ার সিস বাইকল অঞ্চলে মধ্য প্রস্তরযুগ এবং নব্য প্রস্তরযুগের কিতোই সময়ের কিছু কুকুরের কবর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, কুকুরকে সেই সময়ে মানুষের মতো ব্যক্তিত্ব মর্যাদা (person-hood) দেয়া হতো এবং কুকুরের সাথে মানুষের মতোই আচরণ করা হতো। শামানাকা অঞ্চলের একটি কবরস্থানে মধ্যবয়স্ক একটি কুকুরের সমাধি পাওয়া গিয়েছিল। কুকুরটি মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছিল, আঘাত থেকে সেরেও উঠেছিল সম্ভবত। প্রায় ৬,২০০ বছরের পুরনো সেই সমাধিক্ষেত্রে কুকুরটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। একই উপায়ে সমাধিক্ষেত্রটিতে মানুষকেও সমাধিস্থ করা হতো।
লোকোমোটিভ রাইসোভেতের প্রায় ৭,৩০০ বছরের পুরোনো সমাধিক্ষেত্রে একটি নেকড়ের কবর আছে। এই নেকড়েটি ছিল পুরুষ নেকড়ে। নেকড়েটির রেডিও-কার্বন পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, এর খাদ্যাভ্যাসে হরিণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। নেকড়েটির দাঁতে কোনো দাগ বা ক্ষত ছিল না। ফলে নেকড়েটি তৎকালীন মানব জনগোষ্ঠী ও কুকুর সম্প্রদায়ের অংশ ছিল কি না তার সরাসরি কোনো প্রমাণ নেই। তবে নেকড়েটিকেও আনুষ্ঠানিকভাবে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
এই কবরগুলো ব্যতিক্রম হলেও তেমন একটা বিরল নয়। এরকম আরো কিছু কবর রয়েছে। বৈকাল হ্রদ অঞ্চলের কিছু ঢিবিতে কুকুর এবং নেকড়ের হাড়ের দেহাবশেষ দেখা যায়। ধারণা করা হয়, সেখানকার মৎস্য শিকারিরা তাদের সাথে কুকুর রাখতেন। প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞানী রবার্ট লুসাই এবং তার সহকারীরা এই গবেষণা পরিচালনা করেছিলেন, তারা ধারণা করেন, এইসব কবর এবং প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন প্রমাণ করে যে, অন্তত এইসব কুকুরগুলোকে তখনকার সময়ে মানুষের মর্যাদা দিয়েছিল।
আধুনিক প্রজাতি এবং প্রাচীন প্রজাতির তুলনা
ইউরোপিয়ান প্রস্তরযুগের কিছু অঞ্চলে কুকুরে প্রজাতিগত বৈচিত্র্যর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ১৫,৫০০-১১,০০০ বছরের পুরনো মধ্যম আকারের কুকুরের অস্তিত্ব অদূর প্রাচ্যের নাটুফিয়ান অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছিল। ১৭,০০০ থেকে ১৩,০০০ বছরের পুরনো মধ্যম বা বড় আকারের কিছু কুকুরের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল জার্মানি, রাশিয়া এবং ইউক্রেনে। ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডের কিছু জায়গায় ১৫,০০০ থেকে ১২,৩০০ বছরের পুরনো ছোট আকৃতির কিছু কুকুরের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।
এসএনপি (সিংগেল নিউক্লিওটাইড পলিমরফিজম) নামক একধরনের ডিএনএ গবেষণা ২০১২ সালে কুকুরের প্রজাতি এবং বিবর্তন সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছিল। এই গবেষণায় বলা হয়েছিল, প্রাচীনকালের বিভিন্ন আকৃতির কুকুরের অস্তিত্বের যে প্রমাণ পাওয়া যায় তার সাথে আধুনিক প্রজাতির কুকুরের কোনো সম্পর্কই নেই! আধুনিক কুকুরের যেসব প্রজাতি দেখা যায় তার মধ্যে সবচাইতে পুরনো প্রজাতিটি খুব বেশি হলে ৫০০ বছরের পুরনো এবং কম করে হলেও ১৫০ বছরের পুরনো প্রজাতি।
আধুনিক কুকুরের বংশগতি তত্ত্ব
বর্তমানে আমরা কুকুরের যেসব প্রজাতি দেখতে পাই তাদের বেশির ভাগেরই বিকাশ ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। এ নিয়ে অবশ্য গবেষকদের মধ্যে তেমন একটা দ্বিমত নেই। তবে কুকুরের প্রজাতিতে যেসব বিশেষ ভিন্নতা দেখা যায় সেটি তাদের আদি প্রজাতির রূপ হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে। কুকুরের প্রজাতি আকার এবং আকৃতিতে বিভিন্ন সাইজের এবং ওজনের হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রজাতির আবার মুখাবয়ব, মাথার গড়ন, ঠোঁট আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। দক্ষতার দিক থেকেও একেক প্রজাতির কুকুর একেক রকমের হয়ে থাকে। কোনো কোনো প্রজাতি শিকার শনাক্ত করতে পারদর্শী, কোনোটি ঘ্রাণশক্তিতে দক্ষ, কোনোটি আবার সহকারী হিসেবে দক্ষ।
কুকুরের প্রজাতিতে এরকম ভিন্নতা থাকার একটি কারণ হতে পারে প্রাচীনকাল থেকে শিকারী জনগোষ্ঠীর সাথে বসবাস এবং একেক সময়ে একেক স্থানে স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়া। তারপর মানুষ এবং কুকুর একইসাথে ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে বিকশিত হতে থাকে। প্রাচীনকালে অল্প সংখ্যক কুকুরের প্রজাতি বিকশিত হলেও, সভ্যতা যত এগিয়েছে এবং মানুষের জনসংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েছে, সেই সাথে বেড়েছে কুকুরের প্রজাতিও।
কারণ মানুষ যখনই এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়েছে, এক কাজ থেকে আরেক কাজে নিজেদের নিয়োগ করেছে, তখনই এই বন্ধুপ্রতীম প্রাণীটিকে তারা সাথে রেখেছে। ফলে কুকুরের প্রজাতির বিকাশও বেড়েছে আগের চাইতে বেশি হারে। পোষা কুকুরের বিকাশ কবে কোথায় কীভাবে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে গবেষকদের নানা রকমের মতামত থাকলেও কুকুর যে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের বন্ধু হিসেবে মানুষকে ভালবেসেছে এবং ভালবাসা পেয়েছে তা নিয়ে কারো দ্বিমত থাকবে না।
This is a Bangla article on dog's domestication, evolution and debates. All sources are hyperlinked inside the article.
Feature Image: Innerstrength Zone