Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডাগওয়ে শিপ ইন্সিডেন্ট: হাজার হাজার ভেড়ার রহস্যজনক মৃত্যু

আমেরিকায় বিভিন্ন প্রদেশে যে শহরগুলো রয়েছে, সেগুলোর প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকার কর্মকর্তাদের শেরিফ (Sheriff) বলা হয়। শহরের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা এবং সঠিকভাবে আইন প্রয়োগের জন্য জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে শেরিফদের বাছাই করেন। আমেরিকার উটাহ প্রদেশের টুয়েলা শহরের শেরিফ ছিলেন ফে জিলেট নামের এক ব্যক্তি।

১৯৬৮ সালের ১৪ মার্চ তার কাছে আর দশটি দিনের মতো ছিল না। শুধু তার কাছেই নয়, সেই দিনটি অনেক আমেরিকান নাগরিকের কাছেই জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত দিনগুলোর একটি মনে হয়। পত্রিকায় যখন হাজার হাজার ভেড়ার মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করে, তখন কেউই অবাক না হয়ে পারেনি। সেই সাথে ভেড়ার মৃত্যুর পেছনে তাৎক্ষণিক কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা না থাকায় আমেরিকার বাতাসে ভেসে বেড়াতে শুরু করে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। জিলেট সেই দিন সম্পর্কে পরবর্তীতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “আমি আমার জীবনে এরকম দৃশ্য আর দেখিনি।

মানচিত্রে উটাহ; Image Courtesy: Wikimedia Commons

এখন একটু দেখা যাক কেমন ছিল সেই দিনটি। আবার ফিরে যাওয়া যাক জিলেটের কাছে। তিনি বলছেন,

“চলচ্চিত্রে যেরকম ‘মৃত্যু ও ধ্বংস’ দেখা যায়, এটা ছিল ঠিক সেরকম। কোনো শহরে বোমাবর্ষণের পর অবস্থা যেরকম হয়, অনেকটা সেরকম অনুভূতি। চারদিকে হাজার হাজার ভেড়ার মৃতদেহ পড়ে আছে। যত দূর চোখ যায়, শুধুই সাদা দেখছিলাম।”

কিলোমিটারের পর কিলোমিটার জায়গা যেখানে সচরাচর অল্প কিছু স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া সাধারণ মানুষের পা পড়ে না, সেখানে হাজার হাজার ভেড়া রাতারাতি মরে গিয়েছে– এই দৃশ্যের সাথে আমেরিকার জনসাধারণ অভ্যস্ত ছিল না। আরেকটা বড় বিষয়, মহামারীর জন্য একসময় অসংখ্য পশুপাখি মারা গেলেও ডাগওয়ে অঞ্চলে সেসময় মহামারীর কোনো চিহ্নই ছিল না। এজন্য চারদিকে ভেড়ার মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়।

বেশিরভাগ ভেড়াই মারা যায়। যেসব মরেনি, সেগুলো গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সুচিকিৎসা দেয়া সত্ত্বেও সেগুলো মারা যায়। প্রাথমিকভাবে কেউই জানতে পারেনি ঠিক কী কারণে ভেড়াগুলো মারা গিয়েছে। ভেড়াগুলো যে জায়গায় মারা যায়, সেটার পাশেই ছিল মার্কিন সেনাবাহিনীর রাসায়নিক অস্ত্র পরীক্ষার জায়গা। তাই অনেকে প্রথমে ধারণা করেছিলেন, হয়তো কোনো গোপন পরীক্ষার কারণেই সেগুলো মারা গিয়েছে। কিন্তু এর পক্ষে তাদের কোন প্রমাণ ছিল না। রহস্য আরও ঘনীভূত হয় যখন ডাগওয়ে প্রুভিং গ্রাউন্ডের মুখপাত্র দাবি করেন, সম্প্রতি কোন রাসায়নিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হয়নি। এরপর একদল মানুষ দাবি করেন, ভেড়াগুলো বিষাক্ত কিছু খেয়েছিল, যে কারণে তাদের এই করুণ পরিণতি। তাদেরও হাতে কোনো শক্ত প্রমাণ ছিল না।

সিনেটর ফ্র্যাংক মোস উটাহ প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করতেন মার্কিন আইনসভায়। ডাগওয়ে প্রুভিং গ্রাউন্ডের পাশে যেদিন ভেড়াগুলো অজানা কারণে মারা যায়, তার এক সপ্তাহ পরে তিনি পেন্টাগনের একটি ডকুমেন্ট ফাঁস করেন। সেই ফাঁসকৃত ডকুমেন্টে দেখা যায়, ভেড়াগুলোর রহস্যময় মৃত্যুর আগের দিন দ্রুতগতির জেট বিমানের মাধ্যমে প্রায় ৩২০ গ্যালন পরিমাণ ভিএক্স নার্ভ এজেন্টের পরীক্ষা চালানো হয় ডাগওয়ে প্রুভিং গ্রাউন্ডে। বলে রাখা ভালো, মাত্র ১০ মিলিগ্রাম ভিএক্স নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগের মাধ্যমেই একজন মানুষকে মেরে ফেলা সম্ভব। এই নার্ভ এজেন্ট সাধারণত নিঃশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এরপর মানুষের শ্বাসতন্ত্রের সাথে জড়িত সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল করে দেয়। কোনো দুর্ভাগা ব্যক্তি বা প্রাণী যদি ভিএক্স নার্ভ এজেন্টের শিকার হয়, তাহলে সে অল্প সময়ের মধ্যেই ফুসফুস বিকল হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।

Uufkffkfkglv
ডাগওয়ে প্রুভিং গ্রাউন্ডে মার্কিন সেনাবাহিনীর ঘাঁটি ছিল; image source: globalsecurity.org

তবে ফ্র্যাংক মোস পেন্টাগনের রিপোর্ট ফাঁস করলেও সেটাকে প্রমাণ হিসেবে না নিয়ে মার্কিন স্বাস্থ্যবিভাগ ও পশুচিকিৎসকরা তদন্ত চালিয়ে যান। তাদের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, জেট বিমানের মাধ্যমেই ভিএক্স নার্ভ এজেন্ট স্প্রে করা হয়। কিন্তু সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। জেট বিমানের নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগের জন্য যে ডেলিভারি ট্যাংক ছিল, সেগুলোতে সেদিন যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এজন্য ঠিক যে উচ্চতায় নার্ভ এজেন্ট স্প্রে করার কথা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি উচ্চতায় গিয়ে ডেলিভারি ট্যাংকগুলো সচল হয়। মূল ঝামেলা এখানেই। অতিরিক্ত উচ্চতায় স্প্রে করার কারণে ঠিক যেখানে নার্ভ এজেন্টের পতন ঘটার কথা ছিল, বাতাসের কারণে তার চেয়ে বেশ দূরে পড়ে। দ্রুতগতির জেট বিমানের পাইলটের লক্ষ্য ছিল ডাগওয়ে প্রুভিং গ্রাউন্ডের অন্তর্গত একটি অংশে নার্ভ এজেন্টের পরীক্ষা করা। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তা হয়নি এবং ডাগওয়ে প্রুভিং গ্রাউন্ডের বাইরে যে জায়গায় ভেড়া চড়ে বেড়াত, সেখানে পড়ে। ভিএক্স নার্ভ এজেন্ট মিশ্রিত ঘাস খেয়েই গণহারে মৃত্যুমুখে পতিত হয় ভেড়াগুলো।

আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, আমেরিকায় ডাগওয়ে প্রুভিং গ্রাউন্ডের হাজার হাজার ভেড়া মারা যাওয়ায় দেশটির গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হলেও স্থানীয় লোকজন এটা নিয়ে খুব বেশি উৎসাহী ছিল না। এর পেছনে বেশ কিছু কারণও ছিল। উটাহ্ প্রদেশের ঐ অংশের বাসিন্দাদের সেনাবাহিনী বিভিন্ন কাজের জন্য নিয়োগ দিয়েছিল। ধারণা করা হয়, সেনাবাহিনী ছিল স্থানীয় জনগণের সবচেয়ে বড় ‘কর্মসংস্থানের যোগানদাতা’। তাই স্থানীয় সাধারণ মানুষ ভেবেছিল, যদি তারা সেনাবাহিনীর এই দুর্ঘটনা নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য করে, তাহলে মার্কিন সমাজের প্রবল জনরোষের জন্য সেনাবাহিনী সেই অঞ্চল থেকে ঘাঁটি সরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। এতে হঠাৎ করে সেখানকার অসংখ্য মানুষের বেকারত্ব বরণের আশঙ্কা রয়েছে। এজন্যই আসলে স্থানীয় মানুষ এত বড় দুর্ঘটনার পরও খুব বেশি মুখ খোলেনি।

Kglgkglg
ভিএক্স নার্ভ এজেন্ট ১০ মিলিগ্রামই যথেষ্ট একজন ব্যক্তিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য; image source: bellingcat.com

মার্কিন সেনাবাহিনী কখনোই তাদের এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। ডাগওয়ে প্রুভিং গ্রাউন্ডের দুর্ঘটনায় যে ভেড়াগুলো মারা গিয়েছিল (প্রায় তিন হাজার), সেগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশের মালিকানা ছিল টুয়েলা শহরের খামারি অ্যালভিন হ্যাচের। তার এত ক্ষতি হলেও খুব বেশি দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাকে ৩,৭৬,৬৮৫ ডলার দেয়া হয়। এছাড়া, এত বিশাল সংখ্যক ভেড়ার সৎকারের জন্য সেনাবাহিনী বেশ কিছু বুলডোজারের ব্যবস্থাও করে দেয়। পাশাপাশি, ডাগওয়ে প্রুভিং গ্রাউন্ডের সেফটি প্রটোকল পুনর্নিরীক্ষণের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়।

ডাগওয়ে প্রুভিং গ্রাউন্ডের দুর্ঘটনাটি আমেরিকার সাধারণ মানুষের সামনে একটি তিক্ত সত্যকে সামনে নিয়ে আসে। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন– দুটি দেশই অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র উদ্ভাবন ও মজুদে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। ১৯৬১-৬৯ পর্যন্ত ৮ বছরে রাসায়নিক অস্ত্র মজুদে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ঢালে আমেরিকা। মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। যেসব দেশ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে, তারা পরবর্তীতে ১৯২৫ সালে জেনেভা প্রটোকলের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই ভয়াবহ অস্ত্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। আমেরিকা সুকৌশলে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত ছিল। রাসায়নিক অস্ত্র শুধু মানুষ নয়, অন্যান্য পশুর জন্যও যে ভয়াবহ ফলাফল বয়ে আনতে পারে– এই সত্যটি ডাগওয়ে শিপ ইন্সিডেন্ট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

Related Articles