Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আইনস্টাইন-সাইলার্ড চিঠি: খামে বন্দী পারমাণবিক বোমা

১৯৩৯ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। রণাঙ্গনে মানুষের আহাজারি চাপা পড়ছে আগ্নেয়াস্ত্রের আওয়াজে। মিত্রবাহিনীকে সমর্থন দেওয়া বিজ্ঞানীদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। কারণ ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে আবিষ্কৃত হয়েছে কিভাবে ইউরেনিয়াম পরমাণুর ফিশন ঘটিয়ে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা যায়। আর এটি ব্যবহার করে নাৎসি জার্মানি তৈরি করতে পারে প্রলয়ঙ্করী কোনো পারমাণবিক বোমা। হিটলারের হাতে এই বোমা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তাই ভেবে শিউরে উঠেন তৎকালীন সময়ের প্রথিতযশা সব বিজ্ঞানী।

আলবার্ট আইনস্টাইন, লিও সাইলার্ড, এডওয়ার্ড টেলার সহ খ্যাতিমান সব বিজ্ঞানী একত্র হয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে চিঠি লেখার পরিকল্পনা করেন যাতে আমেরিকা মিত্র বাহিনীর স্বার্থে নিজেদের পরমাণু কর্মসূচি শুরু করে। কারণ বিজ্ঞানী মহলে এমন গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছিলো যে, ইতোমধ্যে জার্মানি নিজেদের পারমাণবিক বোমা তৈরির পথে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। আর তাই যদি হয়, তাহলে মিত্র বাহিনীকেও পারমাণবিক যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। এই প্রেক্ষাপট থেকেই প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে অনতিবিলম্বে পারমাণবিক কর্মসূচী গ্রহণের তাগিদ দিয়ে বিজ্ঞানী লিও সাইলার্ড একটি চিঠি লিখেন যাতে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর করেন আলবার্ট আইনস্টাইন। ঐতিহাসিকভাবে এই চিঠি পরিচিত আইনস্টাইন-সাইলার্ড চিঠি নামে। এই চিঠির ফলশ্রুতিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু করে কুখ্যাত ম্যানহাটন প্রজেক্ট। ম্যানহাটন প্রজেক্ট থেকেই বেরিয়ে আসে হিরোশিমা আর নাগাসাকির উপরে নিক্ষেপিত দুই পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাট ম্যান’।

চিঠির পেছনের গল্প

১৯৩৮ সালে দুই জার্মান বিজ্ঞানী অটো হান আর ফ্রিটজ স্ট্রেসম্যান আবিষ্কার করেন ইউরেনিয়াম পরমাণুর ফিশন। অন্যদিকে লিজে মেইটনার আর অটো ফ্রিশ এই ফিশনের গাণিতিক ফর্মুলা তুলে ধরেন। এরপরেই পৃথিবীজুড়ে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার নিয়ে যারা কাজ করছিলেন তাদের টনক নড়ে। জার্মানীতে নিউক্লিয়ার ফিশন নিয়ে কাজ শুরু করেন অনেক বিজ্ঞানী ও প্রতিষ্ঠান। কিন্তু হিটলারের হস্তক্ষেপে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনীতিকরণ শুরু হয়। প্রতিভাবান অনেক বিজ্ঞানীই দেশ ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রিটেনে পাড়ি জমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে হিটলারের নিপীড়নের শিকার হয়ে আলবার্ট আইনস্টাইন সহ ১৫ জন জার্মান নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জার্মানি ছেড়ে যান। ফলে জার্মানিতে চলমান পারমাণবিক গবেষণা প্রকল্পগুলো অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার রিএক্টরের উপর কাজ করা বিজ্ঞানীদের একাংশ। (ছবিসূত্র: U.S. Department of Energy, Historian’s Office)

অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সারা বিশ্ব থেকে মেধাবী বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৩৮ সালে জার্মানি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো বিজ্ঞানী লিও সাইলার্ড কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেক ইতালিয়ান বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির সাথে কাজ শুরু করেন। দুজন মিলে ‘নিউক্লিয়ার রিএক্টর’ এর ধারণা পেটেন্ট করান। এই নিউক্লিয়ার রিএক্টরে ইউরেনিয়াম ব্যবহার করেই বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব, এমনকি তৈরি করা যেতে পারে বিপুল শক্তিশালী বোমাও।

চিন্তার কারণ জার্মানি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানিতে থাকা খনিগুলো থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলন করে তা বিশুদ্ধকরণের খবর বিজ্ঞানী মহলে বেশ সাড়া ফেলে। জার্মান বিজ্ঞানী সিগফ্রিড ফ্লুগ সে সময় পারমাণবিক বোমা বিষয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। পাশাপাশি বেলজিয়ামের নিয়ন্ত্রণাধীন কঙ্গোর খনি থেকে ইউরেনিয়াম কেনার জন্যেও তোড়জোড় চালাচ্ছিল হিটলার। আর তাই সাইলার্ড, ফার্মি, নিলস বোর, এডওয়ার্ড টেলার সহ বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক প্রকল্প শুরুর ব্যাপারে তাগিদ দিতে থাকেন। অন্যদিকে বেলজিয়াম যাতে জার্মানির কাছে ইউরেনিয়াম বিক্রি না করে সেজন্য কুটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে অনুরোধ করা দরকার। কিন্তু প্রে্সিডেন্ট পর্যন্ত এই বার্তা পৌঁছাবে কে?

যুদ্ধকালীন জার্মানির পারমাণবিক প্রকল্প (ছবিসূত্র: Library of Congress/Washington)

সবাই প্রস্তাব করেন, আইনস্টাইন যদি এই ব্যাপারে একটি চিঠি লেখেন তাহলে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট হয়তো এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন। তবে পারমাণবিক বোমা তৈরি করার মতো একটি বিধ্বংসী কাজ করার জন্য প্রেসিডেন্টকে রাজি করাতে আইনস্টাইন চিঠি লিখবেন কিনা এই নিয়ে সংশয় ছিলো সবার মনে।

সাইলার্ড রাজী করালেন আইনস্টাইনকে

সাইলার্ডের সাথে আইনস্টাইনের পরিচয় বেশ পুরনো। ১৯২০ সালে বার্লিনে তারা একই ল্যাবরেটরিতে কাজও করেছেন। দুজনে একত্রে ১৯২৬ সালে ‘আইনস্টাইন-সাইলার্ড রেফ্রিজারেটর’ উদ্ভাবন করেন। জুলাইয়ের ১৬ তারিখ আইনস্টাইন লং আইল্যান্ডে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। তাই তার সাথে দেখা করতে সাইলার্ড দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তার সামার কটেজে পৌঁছেন। সেখানে সাইলার্ড তাকে সবিস্তারে সব বলেন। আইনস্টাইন এই কাজের ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন।

সাইলার্ডই প্রেসিডেন্টকে চিঠি লেখার ব্যাপারে রাজী করিয়েছিলেন আইনস্টাইনকে (ছবিসূত্র: atomicheritage.org)

এই বোমা যে কত ভয়াবহ ফলাফল বয়ে আনতে পারে তা একজন পদার্থবিদের চেয়ে ভালো আর কে অনুভব করতে পারে। হিটলার পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়নে যে গতিতে অগ্রসর হচ্ছে তাকে মোকাবেলা করতেই এই চিঠিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হন তিনি। কিন্তু ১৬ জুলাইয়ের সুন্দর সেই দিনটিতে ঘুণাক্ষরেও কারো জানা ছিলো না, হিটলার নয়, যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমাই আঘাত হানতে যাচ্ছে হিরোশিমা আর নাগাসাকি নামের জনবহুল দুই শহরে।

সেই চিঠি

অতঃপর সাইলার্ড ঐতিহাসিক সেই চিঠিটি লিখলেন আর আইনস্টাইন সেই চিঠিতে স্বাক্ষর করলেন। চিঠিতে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতার কথাও ছিলো। আর এর বিবরণ দিতে গিয়ে সাইলার্ড লিখেছিলেন, যদি কোনো বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি জাহাজে একটিমাত্র পারমাণবিক বোমার বিষ্ফোরণ ঘটে, তবে পুরো বন্দরটিই ধ্বংস হয়ে যাবে।

প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে লেখা চিঠি (ছবিসূত্র: atomicheritage.org)

চিঠিতে জার্মানির দখলে থাকা চেকস্লোভাকিয়ান অঞ্চলের খনি থেকে উত্তোলিত ইউরেনিয়াম জার্মানির পারমাণবিক গবেষণা প্রকল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক করে ১৯৩৯ সালের আগস্টের দুই তারিখ প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে চিঠি প্রেরণ করেন সাইলার্ড। চিঠিটি দেওয়া হয়েছিলো রুজভেল্টের বন্ধু আলেকজান্ডার স্যাকস এর হাতে। তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট এর সাথে দেখা করে চিঠিটি তার হাতে পৌঁছে দেবেন এমনটাই কথা ছিলো। কিন্তু এরই মধ্যে জার্মানি পোল্যান্ডকে আক্রমণ করায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কুটনৈতিক কাজে ব্যস্ত রুজভেল্টের সাথে দেখা করার সুযোগ পাচ্ছিলেন না আলেকজান্ডার স্যাকস।

জবাব দিলেন প্রেসিডেন্ট

১৯ অক্টোবর আইনস্টাইনকে তার চিঠির জবাব দেন রুজভেল্ট (ছবিসূত্র: atomicheritage.org)

অন্যদিকে কোনো জবাব না পেয়ে লিও সাইলার্ড, এনরিকো ফার্মি সহ সবাই ধরেই নিলেন যে প্রেসিডেন্ট হয়তো ব্যাপারটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু চিঠি হাতে পাবার দীর্ঘদিন পর আলেক্সান্ডার স্যাকস অক্টোবরের ১১ তারিখ সেটি নিয়ে দেখা করতে সক্ষম হন রুজভেল্টের সাথে। রুজভেল্ট তাৎক্ষণিক সামরিক বাহিনীর একটি দলকে ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করার জন্যে কমিটি গঠন করার আদেশ দেন। অবশেষে ১৯ অক্টোবর আইনস্টাইনকে খুব সংক্ষেপে তার চিঠির জবাব দেন তিনি। আইনস্টাইনকে তিনি ইউরেনিয়াম রিসার্চ কমিটি গঠনের পদক্ষেপের ব্যাপারেও অবহিত করেন।

কাজ শুরু হলো ম্যানহাটন প্রজেক্টের

১৯৪০ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ইউরেনিয়াম সংগ্রহ কমিটির সবুজ সংকেত পাওয়া যায়। কাজ শুরু হয় ম্যানহাটন প্রজেক্টের।

ম্যানহাটন প্রজেক্টের প্রতীক (ছবিসূত্র: cfo.doe.gov)

১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান ‘পার্ল হারবার’ আক্রমণ করে আর ১০ তারিখ জার্মানি ও ইতালি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অন্যদিকে ম্যানহাটনের পারমাণবিক বোমার পেছনে তখন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ দক্ষ প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, সামরিক বাহিনীর সদস্য, সাধারণ শ্রমিক নিয়োগ করে, যার সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৩০,০০০ জনে। তবে বোমা বানানোর কোনো কাজেই জড়িত ছিলেন না আইনস্টাইন কিংবা সাইলার্ড। মূল ভূমিকায় ছিলো সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই।

সফলভাবে চালানো ‘Trinity Test’ (ছবিসূত্র: atomicarchive.com)

১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই তারিখে ম্যানহাটন প্রজেক্ট সফলভাবে তাদের পারমাণবিক বোমার উপর করা ‘ট্রিনিটি টেস্ট’ সম্পন্ন করে। জার্মানি ততদিনে যুদ্ধে ইস্তফা দিয়েছে। জাপানকেও আত্মসমর্পণ করার বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু জাপান তখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলো। ৬ আগস্ট হিরোশিমাতে ‘লিটল বয়’ আর ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে ‘ফ্যাট ম্যান’ আছড়ে পড়ে।

আইনস্টাইন আর সাইলার্ডের প্রতিক্রিয়া

জাপান আত্মসমর্পণ করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। পারমাণবিক শক্তির এই ধ্বংসযজ্ঞ দেখে মুষড়ে পড়েন লিও সাইলার্ড আর আইনস্টাইন সহ ম্যানহাটন প্রজেক্টের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত অনেকে। লিও সাইলার্ডের সাথে সম্মতি জানিয়ে ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ করা ৭০ বিজ্ঞানী দাখিল করেন ‘সাইলার্ড পিটিশন’।

সাইলার্ড পিটিশন

আইনস্টাইন আরেক নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী লিনাস পলিংকে দুঃখ করে একবার বলেছিলেন, আমি যদি সেই চিঠিতে স্বাক্ষর না করতাম, তবে হয়তো অকালে প্রাণ হারাতো না হিরোশিমা আর নাগাসাকির মানুষ।

ফিচার ইমেজ ছবি: atomicarchive.com

Related Articles