Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হারানো শহর ‘এল মিরাডোর’-এর খোঁজে

স্বর্ণের শহর এল ডোরাডোর কথা পাঠকরা শুনে থাকবেন। বাস্তবে এল ডোরাডোর অস্তিত্ব থাক বা না থাক, তবুও এই নাম নিয়ে মানুষের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। তবে আজকের লেখা এল ডোরাডো নিয়ে নয়। বরং, এই নামের সাথে মিল রয়েছে এমন একটি শহরকে নিয়ে, যা একটি দীর্ঘ সময় লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। বলছি ‘এল মিরাডোর’ নামের এক হারানো মায়া নগরীর কথা।

এল মিরাডোর (El Mirador) একটি বিশাল প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল, যাকে ‘মায়া সভ্যতার পূর্বসূরি’ বললেও হয়তো ভুল হবে না। এল মিরাডোর-এর অর্থ বা ‘দেখার স্থান’। এরূপ নামকরণের কারণ হয়তো এখানকার বিশাল বিশাল পিরামিড। সম্ভবত, এগুলোর উপর থেকেই দূরবর্তী জায়গায় নজর রাখা হতো। হারিয়ে যাওয়া শহর এল মিরাডোর বর্তমান মধ্য আমেরিকার গুয়াতেমালার ঘন জঙ্গলে অবস্থিত। গুয়াতেমালার মায়া ধ্বংসাবশেষের কথা উঠলে প্রায়শই টিকালের প্লাজার কথা আলোচনায় আসে, যেটি ৭০০ থেকে ৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সমৃদ্ধ ছিল। প্রচুর পরিমাণে পিরামিড এবং প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ প্রাক-কলম্বিয়ান মায়া সভ্যতার বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় ৬ বর্গ মাইলেরও বেশি এলাকা জুড়ে এবং ৩,০০০ এর মতো স্থাপত্য নিয়ে এটি বিস্তৃত।

গুয়াতেমালার ঘন জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে আছে এল মিরাডোর;I mage source: Carmelita-El Mirador

তবে এল মিরাডোর মায়ার প্রাচীন রাজধানী টিকালের বহু শতাব্দী আগেই গড়ে উঠেছিল। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক থেকে ১ম খ্রিষ্টাব্দীর মধ্যে বিকাশ লাভ করেছিল, এবং সেই সাথে এখানে হাজার হাজার মানুষের বসবাস ছিল। ২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই জায়গা এখনও সবচেয়ে বেশি পরিচিত মায়া সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।

এটি ছিল সে সময়ে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহর। এই অঞ্চল মেক্সিকোর ক্যালাকমুলের সংরক্ষিত জীববৈচিত্র্যের সীমানা থেকে মাত্র ৬.৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গভীর অরণ্যে অবস্থিত এল মিরাডোরের অববাহিকায় নাকবে, লা-মুরাল্লা এবং টিন্টালসহ প্রাক-ক্লাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর সন্নিবেশ ঘটেছে। এল মিরাডোর থেকে প্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্যের প্রমাণের ভিত্তিতে ধারণা করা হয়- ক্লাসিক যুগের (১৫০-৯০০ খ্রিষ্টাব্দ) কয়েক শতাব্দী আগেও এই অঞ্চলে মায়া সমাজের অস্তিত্ব ছিল

এই অঞ্চলের প্রাচীনতম বসতিটি প্রায় ১০০০-৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এবং স্মৃতিসৌধ স্থাপত্যটি প্রায় ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গড়ে তোলা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এল মিরাডোর ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। এই সভ্যতা তার বিভিন্ন স্থাপত্য নকশার একটি উন্নত ধারণার বিকাশ লাভ ঘটিয়েছিল এবং সমগ্র মিরাডোর অববাহিকা জুড়ে এর শাসন বিস্তৃত ছিল। এখানে একটি প্রতিরক্ষামূলক দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল, এবং এজন্য ধারণা করা হয় যে যুদ্ধ এই সভ্যতার পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। জেড, অবসিডিয়ান এবং ফ্লিন্টের মতো মূল্যবান পাথরগুলো ইঙ্গিত দেয় যে এই পুরো অঞ্চল জুড়ে বিদ্যমান বিশাল বাণিজ্য ব্যবস্থার অংশ ছিল। এল মিরাডোর ক্লাসিক (৯০০-১১০০ খ্রিষ্টাব্দ) যুগের শুরুতে শেষবারের মতো পরিত্যক্ত হয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা LiDAR (Light Detection and Ranging) নামে একটি বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে গুয়াতেমালার জঙ্গলের নীচে একটি নতুন মেগালোপলিসের লেজার স্ক্যান প্রকাশ করেছেন, যেখানে এটি প্রাচীন শহরগুলোর একটি বিশাল আন্তঃসংযুক্ত নেটওয়ার্ককে ইঙ্গিত করে

প্রাচীন এল মিরাডোর শহরের লেজার স্ক্যান; Image source: leonidemartinblog

১৮৮৫ সাল পর্যন্ত এল মিরাডোরের আর কোনো ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তবে এই সময় ক্লদিও উরুটিয়া মিরাডোর অববাহিকার একটি অঞ্চলে জরিপ করেন এবং সেখানকার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করেন। এল মিরাডোর শহরটি আবিষ্কৃত হয় ১৯২৬ সালে। যেহেতু এখানে কোনো রাস্তা নেই, তাই এ জায়গাগুলোতে যাওয়া বেশ কঠিন। এখানে পৌঁছানোর জন্য ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ১৯৬২ সালে প্রখ্যাত গবেষক ইয়ান গ্রাহাম প্রথম এলাকাটি জরিপ করেন ও সেখানে ব্যাপকভাবে অনুসন্ধান চালান। তিনি এই জায়গার প্রথম মানচিত্র তৈরি করেন। ১৯৭৮ সালে এই শহরের প্রথম পুরোদমে খননকাজ শুরু হয়, আর তা শেষ হয় ১৯৮৩ সালে। এ সময় ব্যাপক অনুসন্ধান, খননকাজ এবং তদন্ত করা হয়েছে।

১৯৭৮ সালের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ থেকে এটা জানা যায় যে মায়া সভ্যতা সম্পর্কে আমরা যা জানতাম, এল মিরাডোর তার চেয়েও অনেক পুরনো। অন্য যেকোনো বৃহৎ মায়া শহরের তুলনায় এল মিরাডোরের আকার বড় ছিল। শুধুমাত্র সিভিক সেন্টার এলাকা ১০ ​​বর্গ মাইলেরও বেশি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। সেখানে হাজার হাজার কাঠামো এবং মন্দির রয়েছে, যেগুলো ২০০ ফুট পর্যন্ত উঁচু। সম্ভবত প্রত্নতাত্ত্বিকরা এল মিরাডোর নিয়ে এতটা বিস্মিত হওয়ার প্রধান কারণ লা-দান্তা পিরামিড।

লা-দান্তা পিরামিড; Image source: viator.com

লা-দান্তা হলো ২৩২ ফুট উঁচু একটি তিন স্তরবিশিষ্ট পিরামিড। এর প্রতিটি স্তর শীর্ষে চূড়া পর্যন্ত উপরে উঠেছে। সেখানে তিনটি মন্দিরের সাথে ওরায়ন এবং ওরায়ন নক্ষত্রের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা রয়েছে যা মায়ার জন্য সৃষ্টির স্ফুলিঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করে। আয়তন অনুসারে লা-দান্তাকে কেউ কেউ প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম কাঠামো হিসেবে বিবেচনা করে। এটি গিজার পিরামিডের মতো এতটা উঁচু নয়, তবে এটি আকারে বিশাল। কারণ, প্রায় ৯৯ মিলিয়ন ঘন ফুট পাথর দিয়ে নির্মিত লা-দান্তা পিরামিডটি ৯২ মিলিয়ন ঘনফুটের মিশরের পিরামিডগুলোর আয়তনের চেয়েও বড়। এই পিরামিড কমপ্লেক্সের ভিত্তি ৪৫ একর জুড়ে বিস্তৃত এবং ৩৩ ফুট লম্বা। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, লা-দান্তার পুরো কাঠামোর নির্মাণে প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ (বা ১৫ মিলিয়ন) শ্রমিক অংশ নিয়েছিল

এল মিরাডোরের পিরামিডগুলোর নকশা করা হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এছাড়াও লা-দান্তা পিরামিডসহ প্রায় ৭ হাজার পাথরের কাঠামোও রয়েছে এখানে। শহরের অন্য দুটি পিরামিড হলো এল টাইগ্রে (১৮০ ফুট উঁচু), এবং লস মোনোস (১৫৭ ফুট উঁচু)। এই পিরামিডগুলো বিশ্বের অন্যান্য পিরামিড থেকে আলাদা, কারণ এগুলো ত্রয়ী কাঠামোর (ট্রায়াডিক প্যাটার্ন) বিশাল পিরামিড স্মৃতিস্তম্ভের মতো। প্রকৃতপক্ষে, এল মিরাডোরে এরকম মোট ৩৫টি ট্রায়াডিক কাঠামো রয়েছে। এই রহস্যময় কাঠামোগুলোর সমস্তই মসৃণ পাথরের ছিল, যেগুলো মায়া দেবতাদের পাথরের মুখোশ দিয়ে সজ্জিত ছিল। এছাড়াও প্রধান মন্দিরগুলো সম্ভবত সূর্যের গতিবিধির সাথে সম্পর্কিত সারিবদ্ধতা দেখায়।

ট্রায়াডিক পিরামিডের কাঠামো; Image source: printables.com

এই মন্দিরের দৃশ্য চিত্তাকর্ষক হলেও নীচে এমন কিছু রয়েছে যা মায়া পুরাণ সম্পর্কে নতুনভাবে আলোকপাত করেছে। আইডাহো স্টেট ইউনিভার্সিটির ড. রিচার্ড হ্যানসেন বর্তমান তদন্তের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি ২০০৯ সালে এক উল্লেখযোগ্য জিনিস আবিষ্কার করেন। এ সময় মাটির নিচে একটি অ্যাক্রোপলিস (নগরদুর্গ) আবিষ্কৃত হয়। অ্যাক্রোপোলিসে ২৬ ফুট লম্বা খোদাই করা প্লাস্টারে ঢাকা একটি কামরা (স্টুকো প্যানেল) পাওয়া গেছে, যা হাজার হাজার বছর ধরে মাটির নীচে নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত ছিল

এটি মায়া সৃষ্টিতত্ত্ব উপকথার দুই জমজ ভাই হুনাপু ও এক্সব্লাঙ্কা সম্পর্কে কিছু তথ্য দেয়। এই অতিপ্রাকৃত প্রতিভাধর যমজ দুই ভাই তাদের বাবা হুন হুনাপুকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল, যে প্রেতলোকের দুষ্ট দেবতার হাতে নিহত হয়। দুই ভাইয়ের পরনে ছিল জাগুয়ারের চামড়ার তৈরি কাপড়। এই দুই ভাই কীভাবে প্রেতলোকে সাঁতার কেটে তাদের বাবা হুন হুনাপুর মাথা পুনরুদ্ধার করে সেই ঘটনা এই পৌরাণিক কাহিনীতে উঠে এসেছে

পাথরে খচিত স্টুকো প্যানেলে প্রাপ্ত মায়া উপকথা; Image source: Maya Decipherment

শহরটি কৃষিকাজের জন্য বেশ উপযুক্ত ছিল। কাদার প্রাচুর্যের কারণে আশেপাশের চত্বর ঢাকার জন্য এগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল। এছাড়া, সেখানে চুন প্রয়োগ করে উর্বর করার মাধ্যমে ভুট্টা, বিন, তুলা, পাম, স্কোয়াশ ইত্যাদি ফসল ফলানো হতো। যখন মাটি ক্ষয় হয়ে যেত, তখন তারা জলাভূমি থেকে আরও বেশি কাদা অপসারণ করে দিত। শহরের অন্যতম আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো কজওয়ে বা পানির উপর তৈরি বিশেষ পথ। এই কজওয়ের পরিমাণ এবং আকার উভয়ই শহরের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোকে অভ্যন্তরীণভাবে সংযুক্ত করে, কিন্তু বাহ্যিকভাবে আইলমারকে সংযুক্ত করে অন্যান্য মায়া সভ্যতার বসতিগুলোর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়

কয়েক মাইল দূরে এই কজওয়েগুলো মাটি থেকে ২-৬ মিটার উঁচু, এবং সেগুলোর প্রস্থ প্রায় ২০-৫০ মিটার।বিশেষজ্ঞদের অনুমান- শহরটি সম্ভবত ১ লক্ষ থেকে ২.৫ লক্ষ লোকের বাসস্থান ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ৩-৮ মিটার উঁচু একটি বড় প্রাচীর আবিষ্কার করেছেন যা শহরের পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ অংশে নির্মাণ করা হয়েছিল। তারা বিশ্বাস করেন, বন উজাড়ের ফলে মাটির ক্ষয় এই শহরকে পতনের দিকে নিয়ে যায়। ফলে কৃষিকাজের জন্য যথোপযুক্ত মাটি ছিল না, এবং কৃষকরা ফসল চাষে ব্যর্থ হয়। সমৃদ্ধ এই সভ্যতা শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে

ইউরোপীয়রা আমেরিকায় আসার হাজার হাজার বছর আগেই মায়া সভ্যতার মানুষরা তাদের নিজস্ব পৌরাণিক কাহিনী তৈরি করে। অ্যাক্রোপলিসের নীচে খনন করে পাওয়া আরেকটি অত্যাশ্চর্য স্নেক-গ্লিফ বা পাথরে খোদাই করা সর্পচিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যা সর্প-শাসকদের একটি রহস্যময় এবং বিস্তৃত রাজবংশের সাথে যুক্ত বলে মনে করা হয়। তাই এদের সর্পরাজাও বলা হয়।

স্নেক-গ্লিফ বা সর্পচিত্র; Image source: The last word on nothing

এই রাজারা মায়া সভ্যতার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে তাদের চিহ্ন রেখে গেছে। তারা আশেপাশের বিভিন্ন সাম্রাজ্যের মধ্যে শক্তিশালী জোট তৈরি করেছিল বলে ধারণা করা হয়। এল মিরাডোরের পতনের পর ৪০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রাজারা এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন বলে জানা যায়। জঙ্গলে পুনর্গঠিত এল মিরাডোরে পাওয়া সর্পচিত্রের অর্থ হতে পারে যে এই হারিয়ে যাওয়া শহর সর্প-রাজবংশের আদি বাসস্থানও ছিল

Image Source: Global Heritage Fund

অনেক প্রাচীন মায়া শহরের ধ্বংসাবশেষ লুটপাটের ঘটনা একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে। আনুমানিক ১০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের আর্টিফ্যাক্ট প্রতি মাসে অবৈধভাবে বিক্রি হয় বলে উঠে এসেছে সেই প্রতিবেদনে। আর ঠিক একই কারণে এল মিরাডোরও এখন বিপন্ন অবস্থায় আছে। এছাড়া, নির্বিচারে বন উজাড়ের ফলেও এর প্রাচীন স্থাপনা ও নিদর্শনগুলো বর্তমানে হুমকির মুখে রয়েছে।

Language: Bangla
Topic: Lost city of El Mirador
References: Hyperlinked inside the article

Related Articles