সিরাজগঞ্জ শহরে থেকেছেন অথচ ইলিয়ট ব্রিজে বসে আড্ডা দেননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া একেবারেই মুশকিল। নামে ইলিয়ট ব্রিজ হলেও মানুষের কাছে বড়পুল নামেই অধিক পরিচিত। যা সিরাজগঞ্জের মতো এক মফস্বল শহরের বিনোদন কেন্দ্রের অভাব মিটিয়ে আসছে প্রায় শত বছর ধরে।
যমুনা নদীর একেবারে কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা সিরাজগঞ্জ শহর সময়ের সাথে সাথে যে আয়তনে যতটুকু বাড়ার কথা ছিল, বাস্তবে হয়েছে তার অনেক কম। এর বড় কারণ ছিল নদী ভাঙন৷ যমুনার ভয়ঙ্কর ভাঙনে এ শহর বিলীন হবার হুমকিতে পড়েছে বারবার। ফলে এই শহরে বড় তেমন কোনো স্থাপত্য যেমন গড়ে ওঠেনি, শহরও খুব বড় হয়নি।
মফস্বল হওয়ার কারণে সিরাজগঞ্জ শহরে তেমন কোনো বিনোদন কেন্দ্র নেই। সম্প্রতি যমুনা নদীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৈরি ক্রসবার (চায়না বাঁধ) বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে যোগ হয়েছে। সেই সাথে রাসেল পার্কেরও কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে কয়েক বছর হলো।
কিন্তু এর আগে মানুষের আড্ডা দেওয়ার মতো জায়গা ছিল মাত্র দুটি। বড়পুল আর যমুনা নদীর পাড়, যা 'হার্ডপয়েন্ট' নামে পরিচিত। এর বাইরে শহর থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার বাইরে বঙ্গবন্ধু যমুনা ইকোপার্ক নামে একটি পিকনিক স্পট রয়েছে।
বিকাল হলে হার্ডপয়েন্টে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়। বিশেষ করে কোনো উৎসবের সময় প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে যমুনা নদীর পাড়। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে উঠলে যমুনা নদীর পাড়ে হয়ে উঠে প্রায় জনশূন্য।
সারাদিনের কর্মব্যস্ততার কারণে প্রিয়জনদের সাথে আড্ডা দিয়ে সেউখ দুঃখ ভাগ করে নেবার সময় যাদের হয়ে ওঠে না, তাদের জন্য প্রিয় এক জায়গার নাম ইলিয়ট ব্রিজ৷ রাতে নিয়ন বাতির আলোতে লোহার তৈরি মোটা রেলিংয়ের ওপর বসে যুবক কিংবা মধ্য বয়স্করা আড্ডা দিচ্ছেন- এটি সিরাজগঞ্জের সবচেয়ে পরিচিত একটি দৃশ্য।
তবে ইলিয়ট ব্রিজের মুগ্ধতা শুধু বিকাল কিংবা সন্ধ্যায় নয়। ভোরে উঁচু এই ব্রিজের মাঝ বরাবর দাঁড়ালে যমুনা নদী থেকে বয়ে আসা হিমেল হাওয়া যে স্নিগ্ধতার পরশে আলিঙ্গন করে নেয়, তা যে কারো মন ভালো করে দিতে যথেষ্ট।
ইলিয়ট ব্রিজ মূলত তৈরি হয়েছে সিরাজগঞ্জ শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া কাটাখালি খালের ওপর। এক সময় যে কাটাখালির ওপর দিয়ে জাহাজ চলাচল করতো, আজ তার প্রস্থ অনেক কম।
কয়েক বছর আগেও কাটাখালি ছিল এক বদ্ধ সরু জলাশয়। কিন্তু কাটাখালি যে সিরাজগঞ্জ শহরের জন্য আশীর্বাদ- তা দেরিতে হলেও বুঝতে পারে শহর কর্তৃপক্ষ। যে কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় খালটি পুনর্খনন করে তার হারানো স্রোত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কাজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে।
খননের ফলে কাটাখালি ধীরে ধীরে তার জৌলুশ ফিরে পাচ্ছে। যদি পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পটি শতভাগ সফলভাবে সম্পূর্ণ হয়, তাহলে নগর-সৌন্দর্য বা নগরের ট্রেডমার্ক- এই দু'য়ের নিরীখে লন্ডনের টেমস নদীর ওপর সে ঐতিহাসিক ব্রিজটির সাথেও তর্কযোগ্য তুলনা চলতে পারে ইলিয়ট ব্রিজের!
ওপরের কথাগুলো কিছুটা অতিশয়োক্তি মনে হলেও সিরাজগঞ্জবাসীর কাছে তা নিখাদ আবেগ। তারা যে স্বপ্ন দেখছেন কাটাখালী নিয়ে, তা বাস্তবে রূপ নিলে দেশেরই জনপ্রিয় এক পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে সিরাজগঞ্জের মতো এক ছোট্ট শহর।
ইলিয়ট ব্রিজের ইতিহাস
যমুনার যখন ভরা যৌবন তখন কাটাখালিও ছিল খরস্রোতা। ফলে সিরাজগঞ্জ শহর তখন দুই অংশে বিভক্ত ছিল। স্থানীয় লোকজন দুই অংশকে কাটাখালির 'এপার' ও 'ওপার' নাম দিয়েছিলেন।
কিন্তু দুই অংশের মধ্যে যাতায়াতের খুবই সমস্যা ছিল। যার ফলে দুই পারের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার জন্য একটি সেতুর প্রয়োজন ছিল।
১৮৯২ সালে সিরাজগঞ্জের তৎকালীন সাব ডিভিশনাল অফিসার (এসডিও) ছিলেন বিটসন বেল। তিনি সিরাজগঞ্জ শহরকে ভালোভাবে দেখা যায়- এমন একটি সেতু তৈরির পরিকল্পনা করেন। সেই সাথে তার লক্ষ্য ছিল, কাটাখালির দুই পারকে জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে যাতায়াত-সমস্যার নিরসন।
নিজের চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য তিনি শহরের বড় বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ে বসলেন। সবাই তার পরিকল্পনাকে সমর্থন করলেন। এরপর তাদের নিয়ে কমিটি গঠন করে শুরু হলো অর্থ সংগ্রহ।
জেলা বোর্ড থেকে ১৫০০ টাকা অনুদান সংগ্রহ করা হলো। আর ব্যবসায়ীদের নিয়ে গড়া কমিটির সদস্যরা নিজেদের সাধ্যমতো অনুদান প্রদান করলেন।
এরপর শুরু হলো সেতুর নির্মাণ কাজ। ১৮৯২ সালের ৬ আগস্ট বাংলার ছোটলাট স্যার আলফ্রেড ইলিয়ট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেতুটি নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার স্টুয়ার্ট হার্টল্যান্ড। তার নকশায় সেই সময়ে ৪৫ হাজার টাকা ব্যয়ে সেতুটি নির্মাণ করা হয়।
নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৮৯৫ সালে। আলফ্রেড ইলিয়টের নামানুসারেই ব্রিজটির নাম রাখা হয় ইলিয়ট ব্রিজ। তবে বর্তমানে স্থানীয়রা একে 'বড়পুল' বলেই ডাকেন। কেননা শহরে কাঠের পুল নামে একটি কংক্রিটের ব্রিজ থাকলেও তা বড়পুলের চেয়ে বড় নয়।
ইলিয়ট ব্রিজের বিশেষত্ব হচ্ছে এর কোনো পিলার নেই। ১৮০ ফুট লম্বা ও ১৬ ফুট চওড়া এই ব্রিজটির পুরোটাই আর্চ করে খালের দুই পাড়ের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে। আর যেহেতু শহরকে ভালোভাবে দেখার জন্য উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল- এ কারণে এর উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট উঁচু।
পুরো কাঠামো কংক্রিট ও স্টিলের সমন্বয়ে তৈরি। উচ্চতা অনেক বেশি হওয়ার কারণে পূর্বে এর নিচ দিয়ে বড় বড় নৌকা ও জাহাজ চলাচল করতো। তবে এখন তা আর চলে না। কিন্তু এরপরও সৃষ্টির পর থেকেই সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ইলিয়ট ব্রিজ।
সিরাজগঞ্জের শতবর্ষের পুরোনো এই স্থাপত্যটি টিকিয়ে রাখার সকল বন্দোবস্ত করেছে শহর কর্তৃপক্ষ। প্রায় এক দশকের বেশি সময় আগে থেকে এর ওপর দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ এছাড়া একবার সংস্কারও করা হয়েছে। যার ফলে সিরাজগঞ্জের তরুণ প্রজন্ম এখনও এই ব্রিজে বসে আড্ডা দিতে পারছে।
স্মৃতিময় কিংবা পরোপকারী ইলিয়ট ব্রিজ
এই ব্রিজকে ঘিরে সিরাজগঞ্জের প্রায় প্রত্যেকের হাজারো স্মৃতি রয়েছে। অনেক উঁচু বলে উঠতে বেশ কষ্ট হয়। এ কারণে স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের প্রায়ই সাইকেল নিয়ে ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখা যায়, যুগ যুগ ধরেই হয়ে আসছে এটি।
ইলিয়ট ব্রিজের পূর্ব পাশের বিশাল কড়ই গাছের নিচে তৈরি কংক্রিটের বেঞ্চের ওপর বসে তপ্ত রোদে কত ক্লান্ত পথিক বিশ্রাম নিয়ে আবারও নিজ নিজ কাজে ফিরে গেছেন- তার কোনো হিসেব নেই। সকাল বেলা কত মানুষকে শরীর চর্চার সুযোগ করে দেয় এই ব্রিজ- তারও কোনো পরিসংখ্যান নেই।
ইলিয়ট ব্রিজ শুধু মানুষকে আড্ডার সুযোগ করে দিয়েছে কিংবা কাটাখালির উভয় পাড়ের মানুষের মধ্যে সংযোগ তৈরি করেছে, তা নয়। মাঝামাঝে শহরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া বিবাদেও ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে এই ব্রিজ।
বিশেষত রাজনৈতিক চাপান উতোর থেকে যখন সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়, তখন শহরের বড় দুই রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ব্রিজের উভয় পাশে অবস্থান নেন। কারণ প্রধান দুই দলের কার্যালয় ব্রিজের দুই পারে। কিন্তু মাঝখানে ইলিয়ট ব্রিজ থাকার কারণে অধিকাংশ সময়ই এই হানাহানি থেমে যায় কোনো রক্তপাত ছাড়া!
সিরাজগঞ্জ শহর ছেড়ে যারা এখন দেশের অন্যান্য অঞ্চল কিংবা দেশের বাইরে থাকেন, তারা একবার হলেও ইলিয়ট ব্রিজ বা বড়পুলের কথা স্মরণ করেন। বড়পুলকে ঘিরে থাকা অনেক স্মৃতি তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। হয়তো এই কংক্রিট আর লোহার ব্রিজে যাদের সাথে আড্ডা দিয়েছেন, তাদের অনেকেই আজ আর নেই।
কিংবা অনেকেই দূর পরবাসে বসে ভাবছেন, দেশে ফিরলে আবারো বড়পুলে বসে আড্ডা দিতে দিতে শিক কাবাব খাবো। ইলিয়ট ব্রিজও হয়তো তাদের অপেক্ষায় আছে।
হয়তো আরো শত শত বছর ইলিয়ট ব্রিজকে ঘিরে রচিত হবে আরো অজস্র স্মৃতি। হারিয়ে যাবে শুধু স্মৃতির নির্মাতারা। থেকে যাবে মান্নাদের গানের সেই কফিহাউজের মতো ইলিয়ট ব্রিজ। ভালো থাকুক ইলিয়ট ব্রিজ। ভালো থাকুক প্রিয় সিরাজগঞ্জ শহর।
যেভাবে যাবেন
সিরাজগঞ্জের বাইরে থেকে যারা ইলিয়ট ব্রিজ দেখতে চান তাদের বাস বা ট্রেনে করে কড্ডার মোড় এসে নামতে হবে। তবে ঢাকার মহাখালী ও টেকনিক্যাল মোড় থেকে এসআই, অভি, স্টারলিট, ও ঢাকা লাইন নামে বাস সরাসরি সিরাজগঞ্জ শহরে আসে। বাস থেকে নেমে রিক্সায় যেতে হবে।
আর ট্রেনে আসতে চাইলে শহীদ মনসুর আলী স্টেশনে নেমে সিএনজি অটোরিকশা বা বাসে করে শহরের রেলগেট অথবা বাজার স্টেশন নামতে হবে। সেখান থেকে রিকশায় ১০ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ইলিয়ট ব্রিজে পৌঁছে যাবেন। তবে রিকশাওয়ালাদের বড়পুল বলতে হবে, নয়তো তারা চিনতে পারবেন না। সিরাজগঞ্জের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান দেখার জন্যও যদি আসতে চান, তবুও এক ফাঁকে দেখেই যেতে পারেন ঐতিহ্যবাহী এই ইলিয়ট ব্রিজ।
This article is in Bangla language. It is about more than 100 years old Eliot Bridge, which situated in Sirajganj Town.
Necessary references have been hyperlinked.
Featured Image Source: AKM Rafiqul Islam