Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গিটার: বিবর্তনের ধারায় আপন আলোতে উজ্জ্বলিত এক বাদ্যযন্ত্র

প্রাচীন এবং অভিজাত কোনো বাদ্যযন্ত্রের কথা বললে সম্ভবত যেটির নাম মাথায় আসে তা হলো গিটার। এর উৎপত্তি এবং ক্রমপরিবর্তন নিয়ে যুগযুগ ধরে গবেষণা চলে আসছে। বেরিয়ে এসেছে ৪,০০০ বছর আগের তথ্যসম্ভার। বেশিরভাগ ইতিহাসের সূচনা যেমন গ্রিক থেকেই এসেছে জানা যায়, গিটারের ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনই। যদিও এর আবিষ্কারক আসলে কে, তা জানা সম্ভব নয়। তবে এর বিবর্তনের পথ অনেকটাই উন্মোচিত হয়েছে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক গিটারের জীবনালাপ তথা বিবর্তন।

সূচনার যত রটনা

সর্বপ্রথম গিটারের পূর্বপুরুষ হিসেবে দাবি করা হয়েছিল বাদ্যযন্ত্র ‘লুট’ থেকে অথবা প্রাচীন গ্রিসের ‘কিথারা’ নামক বাদ্যযন্ত্রকে। তবে লুট থেকে গিটার এসেছে এ ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে ১৯৬০ সালে মাইকেল কাশা একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার মতে, লুটের এগিয়ে চলার পথ গিটারের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা; কিছুটা মিল থাকলেও তা গিটারের অভিব্যক্তিতে কোনো প্রভাবই ফেলেনি।

‘লুট’ নামক বাদ্যযন্ত্র; Source: quailtytraders.com

এবার আসা যাক কিথারার কথায়। একেও গিটারের আদি অবস্থা বলা যায় কিনা, তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। দ্বিমতের প্রধান উৎস হলো এর নাম। গ্রিক শব্দ ‘কিথারা’ এবং স্প্যানিশ শব্দ ‘কুইত্রা’ দুটোই কাছাকাছি ধরনের। এই কিথারা দেখতে বর্গাকার, ভাঁজযুক্ত এবং একটি বাদ্যযন্ত্রও বটে। অনেকটা বীণার মতো। এতে চারটি তারের ব্যবহার ছিল। এখন প্রশ্ন হলো এই চার-তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্রটি কি স্প্যানিশ কুইত্রা থেকে এসে গ্রিকে কিথারা নাম পেয়েছে, নাকি অন্য কোথাও থেকে। গবেষক মাইকেল কাশার মতে, গ্রিকেরা এই কিথারা নামটি পেয়েছে প্রাচীন পারস্যের চার-তারের যন্ত্র ‘চার্টার’ থেকে।

কিথারা নামক বাদ্যযন্ত্র; Source: You Tube

গিটারের পূর্বপুরুষেরা

গিটারে যেহেতু তারের ব্যবহার দেখা যায়, তাই এর পূর্বপুরুষেরাও নিশ্চয়ই তারযুক্তই হবে। প্রত্নতত্ত্ববিদগণের মতে, আদি তারযুক্ত যন্ত্রগুলোর মধ্য সবচেয়ে পুরোনো বাটি আকৃতির বীণা এবং ‘তানবার’। বাটি আকৃতির হবার কারণ ছিল। তখন মানুষ বীণা তৈরির জন্য কচ্ছপের খোলস বা লাউয়ের খোল ব্যবহার করতো অনুনাদক হিসেবে, যা বাটি আকৃতিরই বটে। এর সাথে থাকতো একটি বাঁকানো লাঠি এবং এক বা একাধিক তার। ওয়ার্ল্ড মিউজিয়ামে গেলে সুমেরিয়ান, ব্যাবিলনিয়ান এবং মিশরীয় সভ্যতার এমন অনেক বীণার দেখা মিলবে। এর চেয়ে কিছুটা আধুনিক বীণার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে রানী শাব-আদের মন্দিরে, যেটি সোনা দিয়ে সজ্জিত, বেশ বাঁকানো এবং রয়েছে ১১টি তারের ব্যবহার।

বাটি আকৃতির বীণা; Source: web.prm.ox.ac.uk

রানী শাব-আদের সেই বীণা; Source: britannica .com

‘তানবার’ একটি লম্বা গলাযুক্ত যন্ত্র, যার নিচে ছোট ডিম্বাকৃতির বা মুক্তাকৃতির অংশ, আর পেছনের দিকটা ধনুকের মতো বাঁকানো। তানবার তৈরির ধারণা বাটি আকৃতির বীণা থেকেই এসেছে বলে মনে করা হয়। মিশরীয় সভ্যতার মন্দিরের আলপনা এবং খোদাইকৃত পাথর থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

সর্বাধিক পুরাতন সংরক্ষিত গিটার

তানবার; Source: guyguitars.com

মিশরীয় সঙ্গীত শিল্পী হার-মোজের একটি তানবার ছিল। সে প্রায় ৩,৫০০ বছর আগেকার কথা। তার সেই তানবারে ছিল তিনটি তার আর একটি মেজরাব (তার তোলার যন্ত্রবিশেষ)। এর অনুনাদক ছিল দারুবৃক্ষের কাঠ দিয়ে তৈরি সুন্দর গড়নের আর সাউন্ডবোর্ডটি ছিল চামড়ার তৈরী। হার-মোজে যখন মারা যান, তখন তার কবরে তার দেহের সাথে তানবারটিও দিয়ে দেওয়া হয়েছিল যা প্রত্নতাত্ত্বিকগণ খুঁজে পেয়েছেন। চাইলে কায়রোর ‘প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে’ গিয়ে এই ঐতিহাসিক বস্তুটি দেখে আসতে পারবেন।

গিটার আসলে কী?

তারযুক্ত সকল বাদ্যযন্ত্রকে নিশ্চয়ই আমরা গিটার বলি না। গিটার শব্দটির উৎপত্তি প্রাচীন সংস্কৃত শব্দ ‘তার’ থেকে। এই শব্দটি মধ্য এশিয়া এবং ভারতে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। তো মধ্য এশিয়ার তার ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রের অভাব নেই। যেমন ধরুন দোতারা, সেতার (পারস্য) বা সিতার (ভারতীয়), চাতুর বা চাতার ইত্যাদি। তাহলে গিটার আসলে কোনগুলো? গিটার মূলত এসেছে চার তারযুক্ত চাতার থেকে, যার উৎপত্তি সেই পারস্যে। গিটার হতে পারে চার, পাঁচ বা ছয় তারের। মাইকেল কাশার মতে, গিটার  হলো লম্বা, ঢেউ খেলানো গলাযুক্ত, সমতল কাঠের সাউন্ডবোর্ডযুক্ত এবং পেছনটা সমতল এমন একটি বাদ্যযন্ত্র। এমন বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে গিটারের প্রথম সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তা প্রায় ৩,৩০০ বছর আগের।

রেনেসাঁ যুগের শুরুতে ইউরোপে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে গিটারের দাপট খুব বেড়ে যায়। তখন এক তারের ব্যবহারও দেখা গিয়েছিল। একসময়ে ইতালিতে পাঁচ-তারের গিটার জায়গা দখল করে চার তারের গিটারের। এমনকি আধুনিক গিটারের বৈশিষ্ট্যগুলোও দেখা যেতে লাগলো। গিটারের গলায় শুরুর দিকে আটটি খাঁজ থাকতো। কিন্তু ধীরে ধীরে তা ১০-১২টিতে উন্নীত হয়।

সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে গিটারে ছয় তারের ব্যবহার শুরু হয় এবং ইতালি থেকে ইউরোপেও এর প্রভাব দেখা যেতে লাগলো। জার্মান মাস্টার হ্যামবার্গ, জোয়াকিম থিয়েল্ক প্রমুখ ব্যক্তিগণ অসাধারণ সুসজ্জিত গিটারের রূপকল্পক।

আধুনিক গিটারের ছায়া

ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে আধুনিক গিটারের সূচনা ঘটে। আধুনিক ক্লাসিক্যাল গিটার এর রূপ পেয়েছে অ্যান্টোনিও টরেস নামক স্প্যানিশ নির্মাণকারীর হাতে। তিনি গিটারের দেহকে আকারে বড় করেন, অভ্যন্তরীণ অনুপাতগুলো এদিক-সেদিক করেন এবং আরও কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসেন। এটি ১৮৬০ সালের কথা। তার এই ডিজাইনের গিটারের শব্দ, তাল, ছন্দ সবকিছুই আরও ভালোভাবে করা সম্ভব হচ্ছিল। তার সেই ডিজাইনই এখনো ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং এখন অবধি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়নি!

অ্যান্টোন টরেনের সেই গিটার; Source: tonereport.com

স্টিলের তারের গিটার

স্পেনে বসে টরেস যেই সময়ে ক্লাসিক্যাল গিটার বানানোতে ব্যস্ত, ঠিক একইসময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিটারে স্টিলের তারের ব্যবহারে কাজ করে চলেছেন ফ্রেডরিক মারটিন। ঘটনা মোটামুটি ১৯০০ সালের দিকের। স্টিলের তার ব্যবহার বেশ ভালোই, তাই সেই সময়ে খুব দ্রুতই তা জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাছাড়া প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে সস্তায় ভালো মানের স্টিলের তারও পাওয়া যাচ্ছিল, যাকে বলে একেবারে সোনায় সোহাগা। ১৯৪০ এর দিকে নাইলনের তারও ব্যবহার করা শুরু হয়।

বৈদ্যুতিক গিটারের আবির্ভাব

বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী বাদ্যযন্ত্র ছিল এই বৈদ্যুতিক গিটার। ১৯১৯ সাল থেকে শুরু করে প্রায় ৫ বছর ধরে শব্দের ধরন, তীক্ষ্ণতা এবং পরিবর্ধন নিয়ে গবেষণা চালিয়ে ১৯২৩ সালে  একটি বৈদ্যুতিক গিটারের প্রোটোটাইপ তৈরি করেন লর্ড লোয়ার, গিবসন কোম্পানির কোয়ালিটি কন্ট্রোল সুপারভাইজার। ১৯২৪ সালে তার তৈরি এই গিটার দিয়ে একটি কনসার্টও করেছিলেন। তবে ১৯২৯ সালে সবচেয়ে সারা জাগানো বৈদ্যুতিক গিটারের প্রবক্তা ‘কে’, এমন একটি গিটার আনেন যা ইতিহাসের সর্বাধিক বিক্রিত বৈদ্যুতিক গিটার।

গিবসন বৈদ্যুতিক গিটার; Source: gibsonprewar.com

বৈদ্যুতিক গিটারে তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশের মূলনীতি ব্যবহার করে তারের কম্পনকে অত্যন্ত দুর্বল বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত করে। এরপর এই সংকেতকে বিবর্ধিত করে একটি লাউড স্পিকারে পাঠানো হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের এই গিটারগুলো পরিপূর্ণ রূপ পায় ১৯৫৫ সালে এসে। পাওয়ার কর্ডের ব্যবহার, উচ্চমানসম্পন্ন অ্যামপ্লিফায়ার বা বিবর্ধক ইত্যাদির ব্যবহারে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায় এ গিটার। রক-সঙ্গীতের চল বেড়ে যায়, পাশাপাশি অন্যান্য সঙ্গীতচর্চায়ও এর ব্যবহার বাড়ে। এভাবেই এগিয়ে চলে গিটারের বিবর্তনের ধারা।

ফিচার ইমেজ © by Ganoblast

Related Articles