ধাঁধা শুনতে কে না ভালবাসে? প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে বিচার করতে ধাঁধার প্রচলন হয়ে এসেছে। বাইবেল থেকে শুরু করে শেক্সপিয়ারের যুগ কিংবা হালের হ্যারি পটার- সবখানেই আমরা মজার মজার ধাঁধা দেখতে পাই। তবে কিছু ধাঁধার সাথে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসও। তাই পৃথিবীতে এমন কিছু ধাঁধা বিদ্যমান যেগুলো সবকিছু মিলিয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে। আজ আমরা জানবো এমনই কিছু ধাঁধার গল্প।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধাঁধা
ধারণা করা হয়, প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে সর্বপ্রথম ধাঁধার প্রচলন হয়। তৎকালীন সময়ে চিন্তাভাবনার দৌড় বাড়ানোর পন্থা হিসেবে মানুষ ধাঁধা সমাধান করতো। বাগদাদ তখন ছিলো শিল্পসাহিত্যে বেশ এগিয়ে। ইতিহাসবেত্তাদের মতে, বাগদাদেই সর্বপ্রথম ধাঁধার প্রচলন হয়। প্রথম ধাঁধাটি ছিলো- "এমন একটি ঘর রয়েছে যেখানে মানুষ অন্ধ হয়ে ঢোকে, কিন্তু বের হয়ে সবকিছু দেখতে পায়।"
এর উত্তর ছিলো 'বিদ্যালয়'। সেই সময় স্কুলের গুরুত্ব বোঝাতেই এই ধাঁধার আবিষ্কার, যেটি কি না পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধাঁধা হিসেবেও পরিচিত।
স্ফিংক্সের ধাঁধাঁ
প্রাচীন মিথোলজিক্যাল দানবদের মধ্যে একটি হলো স্ফিংক্স। নারীর মুখ ও সিংহের দেহ নিয়ে তৈরি এই প্রাণীটি ছিলো থিবেস শহরের দ্বাররক্ষক। ইডিপাস দ্য কিং নামক বইয়ে এই স্ফিংক্সের কথা উঠে এসেছিলো। এই বিখ্যাত বইয়েই লিপিবদ্ধ করা হয় স্ফিংক্সকে নিয়ে গড়ে ওঠা সেই বিখ্যাত ধাঁধাঁটি।
সেই সময়ে থিবেস শহরে যে প্রবেশ করতে চাইতো, তাকে একটি ধাঁধা দিত স্ফিংক্স। সেই ধাঁধার উত্তরের প্রাপ্তি হিসেবে মিলতো শহরে প্রবেশ করার সুযোগ। আর ভুল উত্তর দিলেই স্ফিংক্সের হাতে প্রাণ হারাতে হতো আগন্তুককে। এতসব বাঁধা থাকা সত্ত্বেও ইডিপাস থিবেস শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। দ্বারে পৌঁছামাত্র স্ফিংক্স ইডিপাসকে একটি ধাঁধা দেন। ধাঁধাটি ছিলো এরকম, "কোন জিনিসটি জন্মের সময় চার পায়ে, মধ্য বয়সে দুই পায়ে এবং শেষ বয়সে তিন পায়ে হাঁটে?"
ভাগ্য ভালো যে ইডিপাস সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম হন। উত্তরটি ছিলো 'মানুষ'। জন্মের সময় হামাগুড়ি দেওয়াকে চার পা আর শেষ বয়সে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটাকে তিন পা বুঝিয়েছিলেন স্ফিংক্স।
শেক্সপিয়ারের ধাঁধাঁ
শেক্সপিয়ারের লেখা উপন্যাসগুলোতে বেশ কিছু ধাঁধার অস্তিত্ব রয়েছে। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত ধাঁধাটি তিনি লিখেছেন 'মার্চেন্ট অফ ভেনিস' উপন্যাসে। সেই উপন্যাসের চরিত্র পোর্শিয়ার জন্য স্বামী নির্বাচনে রাজা অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন। সোনা, রুপা ও লোহার তৈরি তিনটি কৌটা সবার সামনে রাখেন তিনি, যার মধ্যে একটিতে ছিলো পোর্শিয়ার ছবি। যিনি পোর্শিয়ার ছবি সম্বলিত কৌটাটি তুলবেন তিনিই হবেন পোর্শিয়ার বর। প্রতিটি কৌটার সামনে অবশ্য সমস্যা সমাধানের সূত্র দেওয়া ছিলো। সোনালি কৌটার সামনে লেখা ছিলো- 'যে আমাকে পছন্দ করবে সে অনেক ছেলের বাসনাকে পাবে।' রুপালি কৌটার সামনে লেখা ছিলো- 'যে আমাকে পছন্দ করবে সে যতটুকু প্রাপ্য তা পাবে।' লোহার কৌটার সামনে লেখা ছিলো- 'যে আমাকে পছন্দ করবে তাকে যাতনা সহ্য করতে হবে।'
বলাবাহুল্য, লোহার কৌটাটিতেও ছিলো পোর্শিয়ার ছবি। কারণ, রাজা বুঝতে পেরেছিলেন, যে লোহার কৌটাটি পছন্দ করবে সে পোর্শিয়ার জন্য যেকোনো কষ্টই সহ্য করতে পারবে।
সেইন্ট আইভেস ধাঁধাঁ
১৭৩০ সালে শিশুদের ছড়ার বইয়ে এই ধাঁধাটি প্রথম লিপিবদ্ধ করা হয়। সেইন্ট আইভেস দ্বীপটি মাছ শিকারের জন্য বিখ্যাত ছিলো। তবে ধাঁধাটি জনপ্রিয়তা পায় মূলত ডাই হার্ড মুভির একটি সিকুয়েলে, যেখানে ভিলেন ব্রুস উইলিস স্যামুয়েল এল জ্যাকসনকে ধাঁধাটি সমাধান করতে দেন। সময় ছিলো ৩০ সেকেন্ড। শেষ সেকেন্ডে উত্তরটি দিতে সক্ষম হন স্যামুয়েল। ধাঁধাঁটি ছিলো এরকম, 'সেইন্ট আইভেসে যাওয়ার পথে আমার একজন লোকের সাথে দেখা হয়। তার সাথে ছিলো তাঁর সাতজন স্ত্রী। সাত স্ত্রীর নিকট ছিলো সাতটি থলে। তাতে ছিলো সাতটি বিড়াল। প্রতিটি বিড়ালের একটি করে বাচ্চা রয়েছে। এখন কতজন সেইন্ট আইভেসে যাচ্ছে?'
যদিও ধাঁধাঁটি একটু প্যাঁচানো, তবে উত্তর হচ্ছে একজন। আসলে সেইন্ট আইভেসের পথে শুধু যাচ্ছেন বক্তাই। বাদবাকিরা সেইন্ট আইভেস থেকে ফিরছেন।
হ্যারি পটার ও স্ফিংক্সের ধাঁধাঁ
হ্যারি পটার সিরিজের চতুর্থ বই 'হ্যারি পটার এন্ড দ্য গবলেট অফ ফায়ার' এ এই ধাঁধাঁটি রয়েছে। ট্রাইউইজার্ড টুর্নামেন্টে একটি ম্যাজিক কম্পিটিশনে একের পর এক বাঁধা পেরোনোর পর হ্যারি পটারের সামনে একটি গোলকধাঁধা পড়ে। সেখানে একটি স্ফিংক্সও ছিলো। স্ফিংক্সকে পেরোতে হলে হ্যারিকে তার দেওয়া ধাঁধার উত্তর জানাতে হবে। ধাঁধাটি ছিলো এরকম-
'প্রথমে একজন ছদ্মবেশে থাকা মানুষের কথা চিন্তা করো। যে কি না গোপনে কাজ করে। তারপর ভাবো কোন জিনিসটি মাঝের মাঝে এবং শেষের শেষে থাকে। সবশেষে ভাবো- কখনো কোনো কিছুর সমাধান না পেলে আমরা কী শব্দ করে থাকি। এখন সবগুলো জোড়া লাগিয়ে উত্তর বলো।'
ধাঁধাটির মূলত তিনটি অংশ। প্রথম অংশ ছিলো ছদ্মবেশে থাকা মানুষ, যার মানে হচ্ছে 'spy'। দ্বিতীয় অংশের উত্তর 'D'। Middle শব্দের মাঝে এবং End শব্দের শেষে যার অবস্থান। আর সবশেষে সাধারণত আমরা কোনো কিছুর উত্তর না পারলে 'er' শব্দটি করে থাকি। এই তিনটি মিলে হয় 'spy-d-er', মানে মাকড়শা। অবশ্য হ্যারির মতো প্রথম আর শেষ অংশ মিলিয়েও ধাঁধাটির উত্তর দিয়ে দেওয়া যাবে। উপন্যাসে হ্যারি সঠিক উত্তর দিয়ে স্ফিংক্সকে পেরিয়ে যাওয়ার পরই মুখোমুখি হয় বড় একটি মাকড়শার, যার মানে স্ফিংক্স মূলত ধাঁধাটির মাধ্যমে হ্যারিকে সতর্কও করে দিয়েছিলেন।
দ্য হবিট: গোলেমের ধাঁধা
আরেক জগৎ বিখ্যাত উপন্যাস লর্ড অফ দ্য রিংসেও রয়েছে একটি জনপ্রিয় ধাঁধা। সেখানে বিলবোকে শয়তান গোলেম থেকে বাঁচার জন্য পাঁচটি ধাঁধাঁর উত্তর দিতে হতো। প্রথম চারটি পারলেও শেষ ধাঁধাটিতে আটকা পড়ে যান বিলবো। শেষ ধাঁধাঁটি ছিলো এরকম।
'এই জিনিসটি সবকিছুকে গিলে ফেলে। বড় বড় পাহাড়-পর্বত কিংবা পাখি, পশু, ফুল। লোহা কিংবা ইস্পাত সব কিছু গলে যায় এর সামনে। রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করে কিংবা শহর ধ্বংস করে।'
এই ধাঁধাঁটির উত্তর না দিতে পারলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বিলবো। উত্তর না পারায় গোলেমের কাছে আরেকটু বেশি সময় চান তিনি। কিন্তু 'time' শব্দটি বললেই গোলেম ধরে নেয় উত্তর বলছেন বিলবো। কারণ ধাঁধাঁটির উত্তর ছিলো 'সময়'।
আইন্সটাইনের বিখ্যাত ধাঁধা
আইন্সটাইনের বানানো এই ধাঁধাটি জগদ্বিখ্যাত হয়ে আছে শুধু আইন্সটাইনের জন্যই নয়, বরং ধাঁধাটির জটিলতার জন্যও। খুব কম মানুষই দ্রুত এই ধাঁধাঁটির উত্তর দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূলত ১৫টি সূত্র দিয়ে একটি ধাঁধা তৈরি করেন তিনি। ধাঁধাটি নিম্নে দেওয়া হলো।
পাঁচটি ভিন্ন রঙের বাড়ির মালিক পাঁচ ভিন্ন দেশের নাগরিক। তারা প্রত্যেকেই ভিন্ন ধরনের পানীয় পান করে, ভিন্ন ধরনের পোষাপ্রাণী পালন করে ও ভিন্ন ধরনের সিগারেট খায়। আর এর পাশাপাশি ১৫টি সূত্র দেওয়া হলো। সেগুলো হচ্ছে
১. ব্রিটিশ বাস করে লাল রঙের বাড়িতে।
২. সুইডিশের কাছে রয়েছে কুকুর।
৩. ড্যানিশ চা পান করে।
৪. সবুজ রঙের বাড়িটি সাদা বাড়ির বাম পাশে অবস্থিত।
৫. সবুজ রঙের বাড়ির ব্যক্তি কফি পান করে।
৬. যে ব্যক্তি পল মল সিগারেট খায় তার রয়েছে পোষা পাখি।
৭. হলুদ রঙের বাড়ির মালিক ডানহিল সিগারেট খায়।
৮. মাঝের বাড়ির ব্যক্তি দুধ পান করে।
৯. নরওয়েজিয়ান বাস করে প্রথম বাড়িতে।
১০. যে ব্যক্তি ব্লেন্ড সিগারেট খায় সে বিড়াল পোষা বাড়ির পাশে থাকে।
১১. যে ব্যক্তির পোষা ঘোড়া রয়েছে সে ডানহিল সিগারেট খাওয়া ব্যক্তির পাশে থাকে।
১২. যে ব্যক্তি ব্লুমাস্টার সিগারেট খায় সে বিয়ারও পান করে।
১৩. জার্মান ব্যক্তি প্রিন্স সিগারেট খায়।
১৪. নরওয়েজিয়ান ব্যক্তি নীল বাড়ির পাশে থাকে।
১৫. যে ব্যক্তি ব্লেন্ড সিগারেট খায় তার পাশের বাড়ির ব্যক্তি পানি পান করে।
প্রশ্ন হলো- পোষা প্রাণী হিসেবে মাছ পালন করে কোন ব্যক্তি?
উত্তর হলো জার্মান ব্যক্তি। একটি চার্ট করে আপনিও এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। তবে এই লিংকে আইন্সটাইনের এই পুরো ধাঁধাটির ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে।
Feature Image : Brainzila
Description : This Bangla article is about the famous riddles around the world.
References : References are hyperlinked in below.