Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাইখস্ট্যাগ ফায়ার: বার্লিনে সেদিন কি হয়েছিল?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভাইমার প্রজাতন্ত্র জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয় এবং এবং তাদের হাত ধরেই গণতন্ত্রের দিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির যাত্রা শুরু হয়। মিত্রপক্ষ ও জার্মান প্রতিনিধিদের মাঝে সম্পাদিত ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। এই চুক্তিতে জার্মানিকে পুনর্গঠনের কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি, বরং এমন সব বৈষম্যমূলক শর্ত চাপিয়ে দেয়া হয় যেগুলো পাঠ করার পর জার্মান নাগরিকেরা প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হন। এমনকি জার্মান জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন, যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করার মতো মানসিকতা ছিল না তাদের। ১৯১৯ সালে একেবারে নিরুপায় হয়ে যখন আত্মগর্বী জার্মান সেনারা লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়, তখন ভবিষ্যতে এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে যে আরেকটি বড় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে, তা অনুমান করাই যাচ্ছিল।

জতওতপগেগ
ভার্সাই চুক্তি ছিল জার্মান জনগণের জন্য অপমানজনক একটি চুক্তি; image source: bbc.com

যুদ্ধোত্তর জার্মানিতে অর্থনীতি তেমন একটা বিকশিত হতে পারেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার একটি বড় কারণ ছিল উপনিবেশ নিয়ে অন্যান্য ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তিগুলোর সাথে জার্মানির দ্বন্দ্ব। শিল্পবিপ্লব তুলনামূলক আগে হওয়ার কারণে ইউরোপের অন্যান্য পরাশক্তিগুলো পৃথিবীর অধিকাংশ উপনিবেশ দখল করে ফেলেছিল। জার্মানিতে বেশ দেরিতে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয় এবং শিল্পপণ্যের বাজার খুঁজতে গিয়ে তারা দেখতে পায় অধিকাংশ উপনিবেশই হয় ব্রিটেন, আমেরিকা কিংবা ফ্রান্সের দখলে চলে গিয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির অবশিষ্ট উপনিবেশগুলোও মিত্রপক্ষের বিজয়ী পরাশক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। এমনকি ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির প্রাকৃতিক সম্পদের উপরও মিত্রপক্ষের দেশগুলো নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, যেটি প্রায় একটি দেশের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয়ার শামিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলার জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে তার সবচেয়ে বড় গুণগুলোর একটি ছিল যে তিনি জনগণের চাহিদা বুঝতে পারতেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মান সমাজের মধ্যে ধিক ধিক করে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার আগুন জ্বলছিল এবং প্রতিশোধ নেয়ার জন্য জার্মানরা একজন শক্তিমান নেতাকে খুঁজছিলে যিনি জার্মানির হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করবেন। জার্মান সমাজের মনোভাব বুঝতে পেরে হিটলার এগিয়ে আসেন, বৈধভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করেন, এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নেন। প্রথমদিকে তার জনসমর্থন খুব বেশি ছিল না। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তিনি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন। নির্বাচনগুলোর ফলাফল পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায় তার প্রতি জনসমর্থনের গ্রাফ ছিল ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী।

হচিতওআচজ
মহামন্দার কারণে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের জনসমর্থন আরও কমে যায়; image source: khanacademy.org

১৯২৯-৩০ সালের দিকে মহামন্দা শুরু হলে ইউরোপের আর দশটি দেশের মতো জার্মানিও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেসময়ে বেকারত্ব জার্মান সমাজে জেঁকে বসে, ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ সামাল দেওয়ার মতো সামর্থ্য ভাইমার প্রজাতন্ত্রের ছিল না। জার্মান সমাজের এহেন প্রতিকূল অবস্থা থেকে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য হিটলার ও তার রাজনৈতিক দলের বাকি নেতারা কোমড় বেধে নেমে পড়েন। জাতীয়তাবাদী বক্তব্য প্রচার ও প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মাধ্যমে তারা জনগণকে এটা বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, জার্মানির সমস্ত দুর্দশার জন্য ভাইমার প্রজাতন্ত্র দায়ী। হিটলারের প্রচারকেন্দ্র ছিল দুর্দান্ত, যেকোনো প্রোপাগান্ডা কিংবা আধা-সত্য, অতিরঞ্জিত কথাকে তারা এমনভাবে জনগণের মধ্যে প্রচার করতো যে জনগণের পক্ষ থেকে তা বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। তিনি নিজেও সুবক্তা ছিলেন। তার বক্তব্য শুনে সাধারণ মানুষ তাকেই ‘উদ্ধারকারী’ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে।

জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতায় গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে হিটলারের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পেছনে যদি বিশেষ কোনো ঘটনার খুব বড় ভূমিকা থাকে, তাহলে সেটি হচ্ছে রাইখস্ট্যাগ ফায়ার। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিকূলতাকে কাজে লাগিয়ে হিটলার নিঃসন্দেহে বেশ শক্ত জনমত তৈরি করতে পেরেছিলেন, কিন্তু এই একটি ঘটনা জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতায় তার আগমনকে একদম নিশ্চিত করে। বিপরীত দিক থেকে বলতে গেলে, এই ঘটনা জার্মানিতে কমিউনিস্টদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সাথে পেরে উঠতে তাদেরকে এমনিতেই জান দিয়ে লড়তে হচ্ছিল, এই ঘটনার পর একেবারে আইন করে তাদের সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়।

জডওতপগক
আগুন লাগার অল্প সময়ের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল পুরো ভবন; image source: prospect.org

১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বার্লিনের পরিবেশ ছিল একেবারে চুপচাপ। রাস্তা দিয়ে পথচারীরা নিঃশব্দে হেঁটে চলেছেন। বেশ ঝড়ো ঠান্ডা হওয়া বইছিল সেদিন। কেউ ভাবতেও পারেনি যে সেদিনের ঘটনা পরবর্তীতে জার্মানির ইতিহাস একেবারে ওলটপালট করে দেবে।

নয়টার দিকে বার্লিনের যে বিশাল প্রাসাদোপম ভবনে তখনকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বসতেন, দেশের স্বার্থে আইনকানুন প্রণয়ন করতেন, সেই রাইখস্ট্যাগ ভবন থেকে হঠাৎ কাচ ভেঙে পড়ার শব্দ পাওয়া যায়। পথচারীরা অবাক হন। কারণ এত রাতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার স্তর ভেদ করে যেখানে কারো সেই ভবনে প্রবেশ করারই কথা নয়, সেখানে কীভাবে কাচ ভাঙার শব্দ শোনা যেতে পারে? অনেকে আবার ভয়ে ছুটতে শুরু করেন। একটু পর ভবনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে শুরু করে।

ব্যাপক হৈচৈ এর শব্দ শোনার পর পুলিশ হাজির হয়। অল্প কিছুক্ষণ পরে দমকল বাহিনীও হাজির হয়ে আগুন নেভানোর কাজে লেগে যায়। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার, তা হয়ে গিয়েছে। পুলিশ এসে রাইখস্ট্যাগ ভবন থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ডাচ তরুণকে গ্রেফতার করে, যে বার্লিনে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করত। মারিনাস ভ্যান ডার লুব্বে নামের এই তরুণ ছিল জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য। আসল ঘটনা শুরু হয় এবার। রাইখস্ট্যাগ বা জার্মান আইনসভায় যখন অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে, তখন হিটলার এবং তার আরেকজন সঙ্গী রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। তাদের কাছে রাইখস্ট্যাগ আগুন খবর পৌঁছালে তারা খুব দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান এবং পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী মারিনাস ভ্যান ডার লুব্বে, একজন ডাচ কমিউনিস্ট; image source: spartacus-educational.com

পুলিশ যেহেতু ঘটনাস্থল থেকে একজন ব্যক্তিকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে এবং মারিনাস ভ্যান ডার লুব্বে নামের সেই ব্যক্তি ছিল একজন কমিউনিস্ট, তাই হিটলার ও তার প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার গোয়েবলস প্রচার করতে শুরু করেন যে কমিউনিস্টরা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে চেয়েছিল, কিন্তু তাদের চেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে। সেসময়ে জার্মানিতে বুর্জোয়ারা কমিউনিস্টদের রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহন থেকে বিরত রাখতে হিটলারকেই পছন্দ করেছিলেন। জনগণের সামনে এভাবে কমিউনিস্টদের ‘ভিলেন’ ও ‘দুষ্কৃতকারী’ হিসেবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে জার্মানদের হিটলার একটি বার্তাই দিতে চেয়েছিলেন– “হয় আমাকে বেছে নাও, নাহলে কমিউনিস্টরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে মার্ক্সবাদ প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে।” জার্মান জনগণের বড় অংশ যেহেতু কমিউনিজমবিরোধী ছিল, তাই তারা হিটলারকে সমর্থন করে।

জার্মান আইনসভা তথা রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগার কিছুদিন পরেই ছিল নির্বাচন, যাতে হিটলারের নাৎসি পার্টি বড় ব্যবধানে জয়লাভ করে। এছাড়া এই ঘটনার পরপরই জার্মানিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়, যেখানে কথা বলার, মত প্রকাশ কিংবা নাৎসি পার্টি ব্যতীত আর কোনো রাজনৈতিক দল গঠন কিংবা সমর্থনের সুযোগ ছিল না। এছাড়া কমিউনিস্টদের উপর জার্মান সরকারের নিপীড়ন নতুন মাত্রা লাভ করে। কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়, অনেককে গুম করে ফেলা হয়।

হিটলার এরপর রাজনীতিতে আরও বেশি করে জনসমর্থন লাভ করতে থাকেন। পরবর্তীতে আইনের মাধ্যমে তার একনায়কত্বকে বৈধতা দেন। রাইখস্ট্যাগে আগুনের ঘটনা এমন একটি সময়ে ঘটে, যখন প্রতিপক্ষ কমিউনিস্টদের জনগণের সামনে ‘দুষ্কৃতকারী’ হিসেবে উপস্থাপনের জন্য একটি ঘটনা বা কারণ দরকার ছিল। রাইখস্ট্যাগের অগ্নিকান্ড ছিল সেরকমই একটি ঘটনা, যেটি হিটলারকে জার্মানিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে এবং একনায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সকল বাধা দূর করে দেয়।

Related Articles