Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ: মোঘল সূর্যোদয়ে অস্তমিত দিল্লী সালতানাত

পানিপথ প্রান্তরে তখন থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। বাতাসের জোরালো আগ্রাসন আর ক্ষণে ক্ষণে ডেকে ওঠা যুদ্ধবাজ হাতি-ঘোড়ার ধ্বনি ব্যতীত আর কোনো শব্দ নেই।

একদিকে মোঘল অধিপতি বাবর তার ছোট সৈন্যদল নিয়ে প্রস্তুত। প্রায় আট হাজার সৈনিক সতর্কতার সাথে কান পেতে আছে বাবরের দিকে। যেকোনো সময় তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে বাবরের নির্দেশে। অপরদিকে অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকা ইব্রাহিম লোদির সুসজ্জিত বাহিনী। কারণ বাবরের চেয়ে তাদের শক্তিসংখ্যা প্রায় পাঁচ গুণ বড়। লোদির সৈনিকরা প্রথমদিকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলেন বাবরের স্পর্ধা দেখে। বাবরকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য বদ্ধপরিকর সুলতানের বাহিনী। পানিপথ প্রান্তরে দু’পক্ষ অবস্থান করছেন প্রায় ৮ দিন ধরে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ কারো দিকে আক্রমণ চালাননি। ওদিকে বাবরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি হাত উঁচু করে ইশারা করলেন।

মুহূর্তের মধ্যে বেজে উঠলো যুদ্ধের দামামা। হুংকার দিতে দিতে দু’পক্ষ এগিয়ে যেতে লাগলো একে অপরের দিকে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, পানিপথের যুদ্ধ!

পানিপথের প্রান্তর উপমহাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র। ভারতবর্ষের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মোঘল সাম্রাজ্যের উত্থান থেকে শুরু করে শক্তিশালী মারাঠাদের পতন পর্যন্ত প্রায় তিনটি বড় যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে এখনো ইতিহাসের পাতায় অবিনশ্বর হয়ে আছে পানিপথ প্রান্তর।

পানিপথ প্রান্তর

পানিপথ কোনো জলপথের নাম নয়। রাজধানী দিল্লীর উত্তরে অবস্থিত পানিপথ ভারতের হারিয়ানা প্রদেশের একটি শহরের নাম। মহাভারত অনুযায়ী, পানিপথ পঞ্চপাণ্ডব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পাঁচটি শহরের মধ্যে অন্যতম। মহাভারতের ইতিহাস ছাপিয়ে পানিপথ মুখ্য হয়ে আছে মূলত পানিপথ প্রান্তরে ঘটে যাওয়া তিনটি বড় যুদ্ধের কারণে।

মানচিত্রে পানিপথের অবস্থান; সূত্রঃ worldatlas.com

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৫২৬ সালে। মোঘল অধিপতি বাবর এবং সুলতান ইব্রাহিম লোদির মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৫৫৬ সালে। যুদ্ধে সম্রাট আকবর এবং উত্তরের রাজা হেমচন্দ্র মুখোমুখি হন। ১৭৬১ সালে পানিপথের সর্বশেষ যুদ্ধে মারাঠাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন আহমদ শাহ আবদালী।

যুদ্ধের পটভূমি

তৎকালীন মোঘল অধিপতি বাবর, যার পুরো নাম ছিল জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবর, তিনি ১৪৮৩ সালে উজবেকিস্তানের ফারগানা রাজ্যে জন্মগ্রহণ। তার পিতা ওমর শেখ মির্জা ছিলেন ফারগানার পূর্বকালীন অধিপতি তিমুরের বংশধর। আবার মায়ের দিক থেকে তিনি মঙ্গোল অধিপতি চেঙ্গিস খানের বংশধর। পূর্বসূরীদের মতোই বাবরের রক্তেও মিশে ছিল যুদ্ধের নেশা। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় ছিল না। তাই বারবার অভিযান পরিচালনা করেও তিনি পূর্বপুরুষদের ঘাঁটি মধ্য এশিয়া পুনরাধিকার করতে পারেননি। শুধু সমরকন্দের কাছেই তাকে পরপর তিনবার ব্যর্থ হতে হয়। যার দেহে বইছে চেঙ্গিসের রক্ত, তার জন্য শুধু কাবুল শাসন করে সন্তুষ্ট থাকা অসম্ভব। তখন সভাসদদের পরামর্শে তিনি দক্ষিণ দিকে দৃষ্টিপাত করেন।

দক্ষিণে তখন দিল্লীর সিংহাসন সুলতান ইব্রাহিম লোদির দখলে ছিল। অদক্ষ সুলতান লোদি ছিলেন রাজ্য পরিচালনায় অপটু। বাবর খবর নিয়ে জানতে পারলেন লোদির সভাসদদের মধ্যেই অনেকে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেননি।

মোঘল সম্রাট বাবর এবং দিল্লীর সুলতান ইব্রাহিম লোদি; সূত্রঃ medium.com

ইব্রাহিম লোদি তার সভাসদদের মধ্যে বড় একটা অংশের বিদ্রোহের কথা জানতে পারেন এবং নির্বিচারে তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। সভাসদদের একজন ছিলেন দৌলত খান লোদি। তিনি সম্পর্কে সুলতানের চাচা ছিলেন। কিন্তু তার নিজেরও প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দিলে তিনি বাবরকে ইব্রাহিম লোদির বিরুদ্ধে আক্রমণ করার অনুরোধ করেন। তিনি ভেবেছিলেন বাবর সুলতানকে অপসারণ করে কাবুলে ফিরে যাবেন। কিন্তু বাবরের মনে তখন ছিল ভারত দখলের নেশা।

বাবর প্রায় ১৫ হাজার সেনাসদস্য নিয়ে দক্ষিণে যাত্রা শুরু করেন। লোদির বিশাল বাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধ করার জন্য সেটা পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু বাবর তার সাথে নিয়ে নেন এক ‘গোপন অস্ত্র’। কী সেই অস্ত্র? সেটা নিয়ে একটু পরে আলোচনা করা হবে। এভাবে শুরু হয় মোঘলদের পানিপথের দিকে যাত্রা।

পানিপথের দিকে যাত্রা

বাবর তার প্রথম যাত্রাস্থল হিসেবে লাহোরকে বেছে নেন। কিন্তু বাবরের লাহোর যাত্রার পূর্বেই সুলতান দৌলত লোদির ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হন এবং তাকে অপসারণ করতে সেনাদল প্রেরণ করেন। বাবরের কৌশলী আক্রমণের মুখে লোদির সৈনিকরা পরাজিত হন। যুদ্ধের সময় মোঘল সেনারা লাহোর শহরে অগ্নিসংযোগ করেন। বাবর লাহোর ত্যাগ করার পূর্বে বিদ্রোহী আলম খানের হাতে লাহোরের দায়িত্ব প্রদান করেন।

লাহোর যুদ্ধে বাবরের প্রচুর ক্ষতিসাধন হয়। শক্তিবৃদ্ধির জন্য কাবুল থেকে নতুন সেনারা এসে বাবরের বাহিনীতে যোগ দেন। তারপর বাবর আলম খান এবং দৌলত লোদিকে উপহার হিসেবে কিছু সৈনিক প্রেরণ করেন।

বাবরের পানিপথ যাত্রাপথ; সূত্রঃ medium.com

আলম খান এবং দৌলত লোদি প্রায় ৩০ হাজার সৈনিক নিয়ে দিল্লী অভিযান করেন। কিন্তু ইব্রাহিম লোদির বিশাল বাহিনীর হাতে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন

এই যুদ্ধের পরে ইব্রাহিম লোদি সতর্ক হয়ে যান। তিনি বাবরের অভিযান সম্পর্কে অবগত হন এবং হিসার-ফিরোজার গভর্নর হামিদ খানের কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য চান। হামিদ খান প্রায় ২০ হাজার সৈনিকের একটি দল লোদির কাছে প্রেরণ করেন। অপরদিকে লোদি বাবরকে রুখে দিতে ছোট আকারের ফৌজ প্রেরণ করেন।

বাবর তার সন্তান হুমায়ুনকে হামিদ খানের বাহিনী পরাস্ত করতে পাঠান। এরপর বাবর তার বাহিনী নিয়ে আম্বালার দিকে রওয়ানা হন। সেখান থেকে আরো দক্ষিণে দুয়াব নামক একটি গ্রামে বাবর লোদি প্রেরিত ফৌজের মুখোমুখি হন। বাবর অনায়াসে লোদির ফৌজকে পরাজিত করেন। যুদ্ধে প্রচুর সৈনিক বাবরের হাতে বন্দি হন। সেদিন রাতে বাবর সকল সৈনিককে হত্যা করার নির্দেশ দেন।

দিল্লীর মসনদে বসে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে যান সুলতান। আর দেরি করা ঠিক হবে না। এবার লোদি তার সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের নিয়ে ফৌজ গঠন করা শুরু করলেন। বাবরকে পরাজিত করতে দিল্লী থেকে প্রায় ৪০ হাজার সেনাসদস্যের বিশাল ফৌজ রওয়ানা দেয়।

১৫২৬ সালের ১৩ এপ্রিল দু’পক্ষ পানিপথ প্রান্তরে মুখোমুখি হয়। প্রায় ৮ দিন অবস্থানের পর ২১ এপ্রিল সকালে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন বাবর এবং লোদি।

ইব্রাহিম লোদির ফৌজ

লোদির প্রধান শক্তি ছিল অশ্বারোহী দল। কিন্তু তিনি নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন যে বাবরকে হারানো সহজ হবে না। তিনি ঘোড়ার পাশাপাশি প্রায় ১ হাজার যুদ্ধবাজ হাতি দিয়ে বিশাল এক হস্তিবাহিনী গড়ে তোলেন। প্রতিটি হাতির উপর তৈরি আসনে তিনজন সুদক্ষ তীরন্দাজ নিযুক্ত করা হয়।

যুদ্ধের সাজে প্রাচীন ভারতবর্ষের হাতি; সূত্রঃ medium.com

লোদির অধীনে দক্ষ তীরন্দাজ পদাতিক বাহিনীও ছিল। প্রয়োজনে সম্মুখ যুদ্ধেও সমান দক্ষতার সাথে লড়াই করার যোগ্যতা রাখতেন তারা। পদাতিক যোদ্ধারা তলোয়ার, কুঠার এবং বর্শা দিয়ে সজ্জিত ছিলেন। লোদির প্রধান অস্ত্র ছিল অশ্বারোহী দল এবং হস্তিবাহিনী।

মোঘল বাহিনী এবং বাবরের গোপন অস্ত্র

বাবরের মোঘল বাহিনীতে তুর্কি, মঙ্গোল, পারস্য এবং আফগান অঞ্চলের যোদ্ধারা ছিলেন। বাবরের নির্দেশে তারা জাতিভেদ ভুলে একসাথে চলাফেরা করতেন। এমনকি একই দস্তরখানায় খাবার গ্রহণ করতেন। ফলে তাদের আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। লোদির বিশাল বাহিনীর খবর পাওয়ার পরেও তারা মোটেও বিচলিত হয়ে পড়েননি। মঙ্গোলদের চিরাচরিত কায়দায় বাবর অশ্বারোহী বাহিনী, তীরন্দাজ বাহিনী এবং পদাতিক বাহিনী দিয়ে দল ভারি করলেও তার কাছে ছিল একটি ‘গোপন অস্ত্র’।

যুদ্ধবাজ মোঘলদের বিধ্বংসী অশ্বারোহী সেনা; সূত্রঃ medium.com

আর সেই গোপন অস্ত্র ছিল ‘গোলন্দাজ বাহিনী’। তখনও ভারতের বুকে পশ্চিমা বারুদের বোঁটকা গন্ধ এসে পৌঁছায়নি। তাই লোদি এই অস্ত্র সম্পর্ক অবগত ছিলেন না। বাবর প্রায় চার ধরনের ভারি এবং হালকা কামান দিয়ে গোলন্দাজ বাহিনী সজ্জিত করেন। গোলা হিসেবে পাথর এবং বিভিন্ন ধাতুর তৈরি গোলক ব্যবহার করেন।

প্রায় ২০টি কামান সহ ৮ হাজার সৈনিক সম্বলিত মোঘলবাহিনী ইতিহাস গড়ার জন্য বাবরের নেতৃত্বে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পানিপথের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

উপমহাদেশে বাবর সর্বপ্রথম যুদ্ধে গোলন্দাজ বাহিনী সংযোজন করেন; সূত্রঃ Wikimedia commons

পানিপথের যুদ্ধ শুরু

লোদির বিশাল বাহিনী দেখে বাবর চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিন্তু তার উপস্থিত বুদ্ধির কারণে মুখোমুখি হবার প্রথম দিনেই লোদিবাহিনী অগ্রসর হতে সাহস পায়নি। বাবর তার পুরো বাহিনীর বামদিকে পানিপথ শহর এবং ডানদিকে অসংখ্য খাদ নির্মাণ করে এমনভাবে অবস্থান করেন যে লোদিবাহিনীর আক্রমণের পথ খুব সরু হয়ে যায়। তারপর তার নির্দেশে সৈনিকরা শহর থেকে শত শত গরুর গাড়ি নিয়ে হাজির হন। বাবর গরুগুলো ছেড়ে দিয়ে গাড়িগুলোকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে অর্ধবৃত্তাকার প্রতিবন্ধক তৈরি করেন। গাড়িগুলোর মাঝে যথেষ্ট জায়গা ফাঁকা রাখেন। সেখানে তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণ পদাতিক সেনা মোতায়েন করেন।

এবার প্রতিবন্ধক থেকে আরো পেছনে তিনি তার কামানগুলো স্থাপন করেন। এর ফলে গোলন্দাজ বাহিনী লোদিবাহিনীর তীরন্দাজের সীমানার আওতামুক্ত হয়ে যায়। গোলন্দাজ বাহিনীর সাথে প্রায় হাজারখানেক সৈনিক অতিরিক্ত হিসেবে আলাদা করে রাখেন।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ নিয়ে চিত্রকর মুকুন্দের ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি; সূত্রঃ Wikimedia Commons

এরপর শুরু হয় অপেক্ষার পালা। দেখতে দেখতে ৭ দিন চলে যায়। লোদিবাহিনী এক পা-ও সামনে অগ্রসর হয়নি। বাবরের তীরন্দাজরা প্রতিদিন শত্রুপক্ষের দিকে অগ্নিফলক নিক্ষেপ করতো যেন লোদিবাহিনী আক্রমণ শুরু করে, কিন্তু ফলাফল শূন্য। এমনকি বাবর রাতের অন্ধকারে লোদিবাহিনীর ব্যারাকে আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু উল্টো তিনি নিজেই বিপদে পড়ে যান। সেবার অল্পের জন্য বেঁচে যায় মোঘল বাহিনী।

পরদিন সকালে লোদিবাহিনী ব্যারাক থেকে বের হয়ে যুদ্ধের সাঁজে সজ্জিত হয়। মোঘলরাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। এরপর শুরু হয় যুদ্ধ। যুদ্ধের শুরুতেই লোদিবাহিনীকে চমকে দেন বাবর। তিনি অটোম্যানদের যুদ্ধের প্রথম কৌশল ‘তুলুঘমা’ অনুসরণ করেন। তুলুঘমা অর্থ শত্রুকে দু’দিক থেকে ঘিরে ফেলা।

৮ হাজার সৈনিক যখন লোদির ৪০ হাজার যোদ্ধাকে ঘিরে ফেললো, তখন সুলতান নিজেই খেই হারিয়ে ফেললেন। বিপদে পড়লে যেমন মানুষ তার সেরাটা দিয়ে আঘাত করতে চায়, তেমনি লোদি তার হস্তিবাহিনী দিয়ে চড়াও হলেন ঘিরে ফেলা মোঘল সৈনিকদের উপর।

কিন্তু বাবর বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখলেন। তিনি আরো শক্ত করে পিছু হটাতে লাগলেন লোদিবাহিনীকে। এরপর সুবিধাজনক দূরত্বে নিয়ে যাওয়ার পর বাবর পিছনে ফিরে তাকালেন। এরপর মৃদু ইশারা করলেন। বাবরের ইশারা পাওয়া মাত্রই হঠাৎ একসাথে ২০টি কামান গর্জে উঠলো। ভারতবর্ষের বাতাসে প্রথমবারের মতো বারুদের ভারি গন্ধ মিশে গেল।

মোঘলদের কামানের শব্দে ভয় পেয়ে যায় সুলতানের হস্তিবাহিনী; সূত্রঃ Wikimedia commons

লোদির হস্তিবাহিনী যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তারা এর আগে কখনো কামানের আওয়াজ শোনেনি। একদিকে কামানের গোলায় লোদিবাহিনীর ঘোড়া, হাতি এবং সৈনিকদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। অপরদিকে হাতিগুলো ভয় পেয়ে আর সামনে অগ্রসর হতে রাজি হলো না। উল্টো হাতিগুলো পাগলের মতো লোদিবাহিনীর উপর চড়াও হলো। হাতির পায়ের তলায় পিষে যেতে থাকলেন সুলতানের সৈন্যরা।

বাবরের গোলন্দাজ বাহিনী এবং তীরন্দাজ বাহিনী অতি উৎসাহে আক্রমণ চালাতে লাগলো। মোঘলরা লোদিবাহিনীকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ না দিয়ে নির্বিচারে হত্যা করতে লাগলো। তাদের সাথে বাবরের অতিরিক্ত সৈনিকরা যোগ দিলে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ বাবরের হাতে চলে যায়।

যুদ্ধের তিন ঘন্টার মাথায় সুলতান ইব্রাহিম লোদি মৃত্যুবরণ করেন। ইতিহাসবিদদের মতে লোদি তখন যুদ্ধের তীব্রতায় সৈনিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ফলে অতিরিক্ত ফৌজ থাকার পরেও তিনি তাদের ব্যবহার করতে পারেননি। সুলতানের মৃত্যুর পর লোদিবাহিনী পরাজয় বরণ করে নেয়।

বাবরের কৌশলের কাছে পরাজিত হলো দিল্লী সালতানাত। মাত্র ৮ হাজার সৈনিক নিয়ে ভারতের বুকে নিজেদের খুঁটি স্থাপন করলো মোঘলরা। যুদ্ধে লোদিবাহিনীর প্রায় ১৫ হাজার যোদ্ধা প্রাণ হারায়, যেখানে মোঘলদের প্রাণহানীর সংখ্যা মাত্র ৪ হাজারের কাছাকাছি।

যুদ্ধের তিনদিন পর পানিপথের বীর বাবর বিজয়ীর বেশে দিল্লী দখল করে নেন। শুরু হয় ইতিহাসের নতুন অধ্যায়, যার নাম মোঘল সাম্রাজ্য। ইতিহাসবিদদের মতে, এই যুদ্ধে বাবরের একমাত্র কঠিন কাজ ছিল লোদিবাহিনীকে সামনে অগ্রসর হতে উস্কানি দেয়া।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লী দখল করে নেয় মোঘলরা; সূত্রঃ exoticindiaart.com

পানিপথের প্রথম যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের ইতিহাসে মোঘল শাসনের শুরু হয়। মোঘলদের দ্বারা ভারতবর্ষের বুকে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রথম ব্যবহারের মাধ্যমে উপমহাদেশে যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ হয়।

সেদিন পানিপথের প্রান্তরে লোদির মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মাধ্যমে যে মোঘল সূর্যের উত্থান হয়, তা পরবর্তী কয়েকশ বছর ধরে প্রতাপের সাথে ভারতবর্ষ শাসন করে। হুমায়ুন, আকবর, আওরঙ্গজেব এবং শাহজাহানরা মিলে ধাপে ধাপে গড়ে তোলেন ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ ইতিহাস।

ফিচার ইমেজঃ Wikimedia Commons

Related Articles