Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জেরি মক: একজন গৃহিণীর বৈমানিক হয়ে ওঠার গল্প

মিশরের একটি ট্যাক্সিওয়ে থেকে বাঁক নিলো ‘সেসনা ১৮০’ বিমানটি । অন্য ট্যাক্সিওয়েতে থাকা তিন ট্রাক বোঝাই সশস্ত্র সৈন্যদল তা দেখে ধরে নিল, নিশ্চয়ই কোনো গোয়েন্দা বিমান গোপনে এসে ঢুকেছে পরেছে। ট্রাকে আওয়াজ তুলে সশব্দে তারা থামল বিমানটি থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে এবং বন্দুকহাতে সৈন্যরা ঘিরে ধরল বিমানটিকে। কিন্তু, সে কী! ১৯৫৩ সালের এই সেসনা ১৮০- এর নিয়ন্ত্রণে বসে রয়েছেন একজন নারী, তাও আবার একা!  বিমানচালকের আসনে পুরুষকে দেখে অভ্যস্ত মিশরীয় গোপন বিমানবন্দরের সেই সৈন্যরা পরে জেনেছিল, এই নারী পেশাদার বিমানচালকও নন। ৩৮ বছর বয়সী তিন সন্তানের মা, জেরি মক একজন গৃহিণী

the Virginian Pilot
একঘেয়েমি কাটাতে বিশ্ব পাড়ি দিয়েছিলেন জেরি;image source: The Virginian-Pilot

১৯৬৪ সালের স্মরণীয় অভিযানের কথা জেরি লিখে গেছেন তার বই ‘থ্রি এইট চার্লি’তে। ত্রিপলি থেকে কায়রো যাওয়ার পথে ভুল করে কায়রো বিমানবন্দরে নামার বদলে গোপন এক সামরিক ঘাঁটিতে বিমান নিয়ে নেমে পড়েছিলেন জেরি। এখান থেকে ভালোয় ভালোয় ছাড়া পেলেও জেরির যাত্রায় কম বিপদ ছিল না। কখনো পুরনো সেসনার পাখায় জমতো বরফ, কখনো ইঞ্জিনে বালি ঢুকে যেত আবার কখনো এন্টেনা মোটর পুড়েও গিয়েছিল।
এতসব ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে ২৯ দিন, ১১ ঘণ্টা ৫৯ মিনিটে জেরির বিমান ফিরে এসেছিল কলম্বাস বিমানবন্দরে। সেদিন এপ্রিলের ১৭ তারিখ। ওহিয়োর গভর্নর জেমস এ রোডস জেরিকে নাম দিলেন ‘ওহিওর সোনালী ইগল’। ১৮ এপ্রিলকে ঘোষণা করা হল ‘জেরি মক দিবস’ হিসেবে।

জেরির বেড়ে ওঠার সময়টাতে একটা মেয়ের জন্য পুতুল না খেলা, ঘরের কাজ না শেখাটা ছিল অস্বাভাবিক। কিন্তু জেরির বাসার আশেপাশে বেশি মেয়েশিশু ছিল না। এজন্য ছেলেদের সাথে ‘কাউবয়’ খেলে তার শৈশব কেটেছে। জেরির মা তার মেয়েকে পছন্দের খেলনা ট্রেনটা কিনে দেননি ঠিকই, কিন্তু বুঝে গিয়েছিলেন, এ মেয়েকে তিনি সেলাই শেখাতে পারবেন না।

বিদ্যালয়ে নিয়ম ছিল মেয়েদের জন্য সেলাই ক্লাস, আর ছেলেদের জন্য মেকানিক্স। জেরি বললেন, তিনি সেলাই নয় বরং মেকানিক্স শিখতে চান। 
জেরির এই কাজকর্মকে তার পাড়া-প্রতিবেশীরা ভাবত পরিবারের আদরের কুফল। আর পরিবার ভাবত এসব পাগলামি সেরে যাবে একটু বড় হলেই। ৭ বছর বয়সে জেরি ১৫ মিনিটের একটা ভ্রমণ করেছিলেন ‘ফোর্ড ট্রি-মোটর’ বিমানে। এর বেশ ভালোরকম প্রভাব জেরির মনে পড়েছিল। সবাই তার কথা মন দিয়ে শুনত না। কিন্তু যারা যারা শুনত, তাদের সবাইকে জেরি বললেন, বড় হয়ে আর কিছু নন, তিনি পাইলটই হবেন, তারপর পুরো পৃথিবী চক্কর দেবেন। বিয়ের আগে জেরির মায়ের পদবী ছিল ‘রাইট’। জেরি শুনেছিলেন রাইট ভ্রাতৃদ্বয় তার নানার পরিবারের পূর্বপুরুষ হতে পারেন।

এমিলিয়া এয়ারহার্ট; image source: National Geographic

জেরি সবচাইতে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন এমিলিয়া এয়ারহার্টকে দেখে। এমিলিয়া এয়ারহার্ট ছিলেন প্রথম নারী যিনি একা আকাশপথে পৃথিবী ঘুরতে বেরিয়েছিলেন, তারপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মাধ্যমিকে থাকতেই জেরি বিমান চালনার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়া শুরু করেন, এখানে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী

জেরি সবসময় উড়তে চাইতেন। ওহিও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী। ওড়ার স্বপ্ন চোখে নিয়ে ভালোবাসলেন রাসেল মককে। লেখাপড়া বাদ দিয়ে জেরি ঘর বাঁধলেন রাসেলের সাথে। কিছুদিনের জন্য তার স্বপ্নে ছেদ পড়ল।
১৯৫৬ সালে যখন জেরি বিমানচালনা শেখা শুরু করলেন, প্রশিক্ষক, বন্ধুরা সবাই বুঝে গিয়েছিলেন এই মেয়ে ওড়ার জন্যই জন্মেছে। মাত্র নয় ঘণ্টার প্রশিক্ষণের পর তিনি একাই বিমান চালিয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে জেরি লাইসেন্স পান।

কিন্তু বার বার একই রুটে বিমান চালাতে অভ্যস্ত ছিল তখনকার চালকরা। জেরি বিরক্ত হয়ে উঠলেন, যখন জানলেন কলম্বাসে এমন কেউ নেই যে তাকে সাগরের উপর দিয়ে বিমানচালনা শেখাতে পারে। তিনি নিজেই বিভিন্ন রুট বের করে সেখান দিয়ে বিমান চালনা শুরু করেন, অভিজ্ঞরা অবাক হতেন, রেডিও ছাড়া এই মেয়ে পথ খুঁজে পায় কেমন করে! ১৯৬১ সালে মক ওহিওর প্রথম নারী বৈমানিক হন, যার বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনারও লাইসেন্স আছে। বিমানবন্দরে চাকরি নিয়ে খুব বেশি কাজ করতে হয়নি তাকে। পুরুষ নির্দেশকরা একজন নারীর কাছে বিমান পরিচালনার উপদেশ নেওয়া হাস্যকর ভাবতেন। তাকে কফি বানানোর মতো কাজগুলো করতে হতো। সবকিছু উপেক্ষা করেই কাজ করছিলেন মক। একসময় ইস্তফা দেন, বুঝতে পারেন এটা তার স্বপ্নের চাকরি নয়।

লাইসেন্স পাওয়ার কিছু বছর পর একদিন জেরি তার স্বামীকে বলেন পুরাদস্তুর গৃহিণীর কাজ করে তিনি ক্লান্ত, এখন তিনি অন্যকিছু করতে চান। রাসেল মক মজা করে বলেছিলেন, “পৃথিবী চক্কর দাও”। অবশ্য তার কৌতুকটা আর কৌতুক থাকল না, যখন জেরি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, তখন পর্যন্ত কোনো নারী একা বিমানে পৃথিবী ঘোরেনি। সেই কবে এমিলিয়া এয়ারহার্ট হারিয়ে গেলেন, তারপর কতগুলো দিন পার হয়ে গেছে! জেরি তো ভেবে বসেই ছিলেন এতদিনে অন্যকেউ পৃথিবী ঘুরে ফেলেছে।

নেহাত শখের বশে পৃথিবী ঘোরার ইচ্ছাটা তখন একটা বিশ্বরেকর্ড করার লক্ষ্যে পরিণত হল।

জেরির স্বামীর বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ ছিল, ‘দ্য কলম্বাস ডিসপ্যাচ’ তাই তার স্পন্সর হতে রাজি হল। তারপর রুট পরিকল্পনা, দেশে দেশে ছাড়পত্রের আবেদন, যেখানে যেখানে নামবেন সেখানে সময় দেখার লোক নিয়োগ করা, রেকর্ড সংরক্ষণ করার জন্য প্রথমবার ওড়ার সময় লোক ঠিক রাখা এসব কাজ করতে হচ্ছিল জেরিকে। জেরি বলেন, ‘আমাকে ওয়াশিংটন ডিসির সবকটা দূতাবাসে ছাড়পত্রের জন্য ঘুরতে হয়েছে। এসব খুঁটিনাটি কাজগুলোর চেয়ে বিমান ওড়ানোটাই অনেক বেশিই সহজ ছিল।”

জোন মেরিয়াম স্মিথ; image source: Find A Grave

কিন্তু ছোট্ট একটা হিসেবে গোলমাল হয়ে গিয়েছিল রেকর্ড আর খ্যাতির পিছনে ছোটা রাসেল মকের। তার স্ত্রী জেরির দু’দিন আগে ক্যালিফোর্নিয়ার নারী জোন মেরিয়াম স্মিথ একই রেকর্ড গড়তে রওনা দেয়। ফলে জেরির শখের পৃথিবী ঘোরার রেকর্ড করার লক্ষ্যটা পরিণত হয় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে। রুট পরিকল্পনায় যতটুকু সময় দেওয়া ছিল এর বাইরে না যেতে বার বার করে জেরিকে বলে দেন রাসেল। যে বিমানবন্দরেই তিনি নামতেন, রাসেল তার সাথে যোগাযোগ করে বলতেন, দ্রুত সব কাজ শেষ করে আবার রওনা দিতে।
ভাগ্য মেরিয়ামের সহায় হল না, যান্ত্রিক কিছু ত্রুটির জন্য অনেক পিছিয়ে গেলেন জেরির থেকে। জেরি এখনো মনে করেন, যখন তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন, তখন খবর পান, মেরিয়াম সিঙ্গাপুরে কেনাকাটা করছে।
সেসনা তাকে নতুন একটা বিমান দেয়। তার পুরনো বিশ্বরেকর্ড করা বিমানটা সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে।

জেরি মকের সেসনা ১৮০; image source: Ohio Memory

অবশ্য তারপর জেরি একের পর এক রেকর্ড ভাঙতে থাকেন। সবচেয়ে বেশিক্ষণ একনাগাড়ে বিমান চালনার রেকর্ডটাও তার ঝুলিতে ছিল একসময়। বিশ্ব-ভ্রমণের পর জেরি আবিষ্কার করেছিলেন, এটা তার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়। বরং তিনি সেই প্রথম নারীদের একজন ছিলেন যারা সুপারসনিক গতির বিমান চালনার সুযোগ পেয়েছিল। জেরি বলেন, ‘আমার সুযোগ থাকলে আমি ওই বিমানটা থেকে নামতামই না’।
মক বিশ্বাস করতেন তার বিশ্ব-ভ্রমণের পর নারীদের জন্য বিমানচালনাকে পেশা হিসেবে নেওয়া আগের থেকে সহজ হয়েছে। মাঝে মাঝেই তিনি তার ভক্তদের চিঠি পেতেন। তাদের চিঠিতে লেখা থাকত কিভাবে জেরি তাদের জীবন বদলে দিয়েছেন। জেরি পুরস্কারও কম পাননি জীবনে।
এতকিছু সত্ত্বেও তিনি নিজের অর্জনকে খুব আহামরি করে দেখেন না। তার বই ‘থ্রি এইট চার্লি’ তে তিনি বলেন ফিরে আসার পর বিমানবন্দরে মানুষের ভিড় দেখে নিজের অনুভূতির কথা,

“এত মানুষ আমাকে এত অভিনন্দন দিচ্ছে, বিষয়টা কেমন যেন অনুচিত ঠেকছিল। আরে! আমি তো আমার ছোট্ট প্লেনটাকে নিয়ে একটু মজাই করেছি।”

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্লোরিডাতে জেরি মক মারা যান। জীবনের শেষদিকে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন উড়ুক্কু এই গৃহিণী। তার নতুন বাসার পাড়া-প্রতিবেশীরা বলতে গেলে কেউই জানত না, এই নারী একা একটা সেসনা নিয়ে পৃথিবী পাড়ি দিয়েছেন এক সময়।

This is a bengali article about Jerrie Mock, the first woman to fly solo around the globe.

All the sources are hyperlinked below in  the article. 

Feature image source: historynet.com

Related Articles