সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপের উপনিবেশ বিস্তার প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বিস্তৃত হতে শুরু করে। এক্ষেত্রে ইংরেজ, ফরাসী ও ওলন্দাজদের উৎসাহ ও সামর্থ্যে কিছু তারতম্য হয়তো ছিল, কিন্তু কেউ কারো থেকে পিছিয়ে থাকতে ইচ্ছুক ছিল না।
১৬৪২ সালে ওলন্দাজ নাবিক আবেল তাসমান আজকের অস্ট্রেলিয়া উপকূলে এক অনুসন্ধানমূলক অভিযানে এসেছিলেন। তিনি স্থানীয় কিছু দ্বীপ ও ভূখণ্ডের মানচিত্রও আঁকেন। ১৬৪৫ সালে তার আবিষ্কৃত দ্বীপের নাম রাখা হয় ‘নোভা জিল্যান্ডিয়া’। আবেল তাসমানের আবিষ্কৃত ভূখণ্ডের সাথে হল্যান্ডের ‘জিল্যান্ড’ প্রদেশের মিল থাকায় হয়তো এই নামকরণ করা হয়।
সেদিনের নোভা জিল্যান্ডিয়া বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের নিউজিল্যান্ড নাম নিয়েছিল। ওলন্দাজ শব্দ Nieuw Zeeland থেকে আজকের নামটির ইংরেজি রূপ New Zealand এসেছে।
তবে এই ভূখণ্ডে পুরোদমে ইউরোপীয়দের আগমন ও বসতি গড়া শুরু হয় ১৯ শতকে। এসময় মিশনারিদের মাধ্যমে এখানে খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসও এসে পৌঁছেছিল। এর আগের শতকের একেবারে শেষের দিকে তিমি ও সীল শিকারের জন্য ইংরেজ ও ফরাসী বণিক ও নাবিকদের আগমন অন্যদের পথ আরো সহজ করে দিয়েছিল।
পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের আদিবাসীদের মতো নিউজিল্যান্ডের মাওরি গোষ্ঠীও বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। তাদের আপন ভূখণ্ডে ইউরোপীয়দের আগমনের ফলে তাদের সাথে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলো। ফলে আদিবাসী জীবনধারার বিভিন্ন দিকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এল। বিশেষ করে ইউরোপীয় বড়শি ও ইস্পাতের কুঠার মাওরি জীবনধারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল। তবে, সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল মাস্কেট বা গাদা বন্দুকের প্রচলন। এর ফলে মাওরিদের বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘর্ষ আরো বেশি রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠেছিল।
১৭৮৮ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড অঞ্চলে ইংরেজ উপনিবেশ বিস্তারের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। এসময় থেকে অঞ্চলটিতে ইংল্যান্ড থেকে আগত অধিবাসীদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। তাদের বাণিজ্য ও বসতি স্থাপনের কাজ আরো বড় এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে সংকুচিত হতে থাকে স্থানীয় মাওরি জনগোষ্ঠীর বিচরণ। ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্য বিস্তার ক্রমে শক্তিশালী হতে হতে তার ধারালো নখ বিস্তার করে চলছিল। অন্যান্য উপনিবেশের তুলনায় এখানে তার নখ কতটা বেশি বা কম আগ্রাসী- তা পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যাবে।
১৮৪০ সালে এসে নিউজিল্যান্ডে ব্রিটিশ উপনিবেশের এক বিশেষ ঘটনা ঘটল। এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হবসন প্রায় ৪০ জন মাওরি গোত্রপ্রধানের সাথে একটি চুক্তি করলেন। এই চুক্তি ‘ট্রিটি অব ওয়াতানাগি’ নামে পরিচিত। পুরো নিউজিল্যান্ড দ্বীপের বিভিন্ন মাওরি গোষ্ঠীর কাছে চুক্তির অনুলিপি স্বাক্ষরের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। মাত্র কয়েকটি মাওরি গোত্র চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত ছিল। কিন্তু প্রায় পাঁচ শতাধিক মাওরি গোত্র চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।
এই চুক্তির ফলে মাওরিদের ভূখণ্ডে কার্যত ব্রিটিশদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রথমদিকে অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের নিউ সাউথ ওয়েলসের অংশ হিসেবে নিউজিল্যান্ড পরিগণিত হতো। পরে ১৮৪১ সালে এটি এক বিশেষ আইনবলে অস্ট্রেলিয়া থেকে আলাদা হয়ে ভিন্ন উপনিবেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ধীরে ধীরে নিউজিল্যান্ডে ইংল্যান্ড থেকে ভাগ্য বদলাতে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। এ কাজের মাধ্যমে বাণিজ্যিক লাভের উদ্দেশ্যে ঊনিশ শতকে ‘নিউজিল্যান্ড কোম্পানি’ নামে এক ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, যার কাজ ছিল অঞ্চলটিতে উপনিবেশ বিস্তারের গতি আরো বাড়িয়ে তোলা। এই সংস্থার কাজ সবসময় সৎপথে পরিচালিত হয়নি, বরং বিভিন্ন সময়ে এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এর অন্যতম কর্ণধার এডওয়ার্ড গিবন ওয়েকফিল্ডকে অপহরণের এক মামলায় তিন বছরের হাজতবাসের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তবে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েই চলছিল। নিউজিল্যান্ডের বেশিরভাগ এলাকা থেকে আদিবাসী বসতি ও সংস্কৃতি ক্রমশ অপসারিত হয়ে যাচ্ছিল। এছাড়া চার্চ অভ ইংল্যান্ডের নেওয়া বিশেষ নীতির অধীনে বিভিন্ন মাওরি গোষ্ঠীর মানুষকে খ্রিস্টান ধর্ম ও ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে দীক্ষিত করা হচ্ছিল।
এদিকে মাওরিদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ‘ট্রিটি অভ ওয়াতানাগি’ নিয়ে অসন্তোষ ধীরে ধীরে বেড়ে চলছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল চুক্তিপত্রের ব্রিটিশ ও মাওরি সংস্করণের মধ্যে থেকে যাওয়া মতভেদ ও পার্থক্য। এই চুক্তিপত্রের ইংরেজি সংস্করণে নিউজিল্যান্ডের রাজনৈতিক আধিপত্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়া হয়, মাওরি সংস্করণে যা অস্পষ্ট আকারে থাকায় ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করেছিল। নতুন অঞ্চলের রাজধানী অকল্যান্ডে স্থানান্তরিত করা হয়। মাওরিদের ব্যবসা ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে বেশ কিছু বিধিনিষেধও আরোপ করা হয়েছিল। তাদের নৌযাত্রায় নতুন কর আরোপ করা হয়।
মাওরিদের প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হন হেকে পোকাই। তিনি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন। চুক্তির পরে ঘটতে থাকা কার্যকলাপে তিনি রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বিশেষ করে, ১৮৪০ সালে উপনিবেশের রাজধানী অকল্যান্ডে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াতে মাওরিদের মধ্যে নিদারুণ ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল।
এদিকে ১৮৪২ সালে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে। উপনিবেশের ব্রিটিশ অধিবাসী টমাস বুল তার এক মাওরি পরিচারকের হাতে খুন হলেন। সেই পরিচারকের নাম ছিল মাকেতু হোয়ারেতুতারা। পুরনো নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, টমাস বুল ও তার পরিবার এই মাওরি যুবকের সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাসকে প্রতিনিয়ত পদদলিত করছিলেন। বিক্ষুব্ধ এই মাওরি যুবক হয়তো নিজেদের ভূমিতে বাইরে থেকে আসা প্রভুদের এই বাড়াবাড়ি সহ্য করতে না পেরে নির্মমতার পথ বেছে নিয়েছিল।
উপনিবেশের আদালত ৭ মার্চ, এই আদিবাসীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। এসময় মাওরি গোষ্ঠীগুলোর বংশীয় ঐতিহ্যের কোনো তোয়াক্কাই করা হয়নি। আদিবাসীরা দেখলো, তাদের নিজেদের মাটিতে যেকোনো আইনগত অধিকার ধীরে ধীরে শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের হাতে চলে যাচ্ছে।
হন হেকে পোকাই এই ঘটনায় তীব্রভাবে আহত হয়েছিলেন। মাওরিদের বিভিন্ন গোত্রে তিনি বিদ্রোহের জন্য প্রচারণা চালালেন। বে অভ আইল্যান্ডস এলাকার কাছাকাছি মাইকি পাহাড়ে উড়তে থাকা ব্রিটিশ পতাকা দেখিয়ে আদিবাসীদের সংঘবদ্ধ হবার ডাক দিলেন।
১৮৪৪ সালের ৮ জুলাই। মাওরি পাকারাকা গোত্রের প্রধান হারাতুয়া মাইকি পাহাড়ে উড়তে থাকা ব্রিটিশ ঝাণ্ডা নামিয়ে ফেললেন। এই খবর ব্রিটিশদের কাছে পৌঁছতে দেরি হলো না। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে সশস্ত্র শক্তি আনা হলো। মাওরিদের কয়েকটি গোষ্ঠী ব্রিটিশদের সাথে আপোষ করতে চাইলো। হন হেকে পোকাই আপোষ করতে অস্বীকার করলেন। ব্রিটিশ পতাকা আবার টাঙানো হলে হন হেকে নিজেই ১৮৪৫ সালের ১০ জানুয়ারি নামিয়ে ফেললেন। ১৮ জানুয়ারি সশস্ত্র প্রহরায় আরেকটি নতুন পতাকা মজবুতভাবে টাঙিয়ে দেওয়া হলো। সশস্ত্র পাহারা থাকার পরও এই পতাকাও পরের দিন নামিয়ে ফেলা হয়।
যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল। সে বছরের ১১ মার্চ ৬০০ মাওরি’র এক সশস্ত্র দল তৎকালীন কোরোরারেকা (বর্তমানে রাসেল) এলাকায় হামলা চালাল। হন হেকে পোকাই আরেক লক্ষ্যবস্তুতে দল নিয়ে হামলা করলেন। ব্রিটিশরাও প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়ল। লেফটেন্যান্ট ফিলপট কারোরারেকায় বোমাবর্ষণের আদেশ দিলেন। তবে তা ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়া বিশেষ কাজ দিলো না। মাওরিদের মাস্কেট, দোনলা বন্দুক ও কুঠারের আচমকা হামলায় ব্রিটিশরা সাময়িকভাবে পালাতে বাধ্য হলো। পেছনে ফেলে গেল প্রচুর হতাহতের লজ্জা।
ব্রিটিশরা বুঝতে পারছিল, আদিবাসীদের নিজেদের মতবিরোধকে কাজে লাগাতে না পারলে সফল হওয়া যাবে না। হন হেকে পোকাইয়ের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী তামাতি ওয়াকা ব্রিটিশদের সহায়তা করতে রাজি হলেন। ২৮ মার্চ কর্নেল উইলিয়াম হিউমের নেতৃত্বে কংগ্রিভ রকেট ও অন্যান্য বিস্ফোরক সমৃদ্ধ বেশ কয়েকটি রেজিমেন্ট একটি মাওরি গ্রামে আকস্মিক হামলা চালাল। নিরীহ মানুষ হত্যা ছাড়াও যত্রতত্র লুটতরাজ চলল।
এদিকে হন হেকে কয়েক ফ্রন্টে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রাথমিক সফলতার পর এবার তাদের যোদ্ধাদের জন্য কিছুটা কঠিন সময় যাচ্ছিল। ব্রিটিশরা তার গ্রাম আক্রমণ চালাতে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যার পড়ে। ইউরোপীয় কায়দায় এটি দুর্গের মতো সুরক্ষিত ছিল। ব্রিটিশরা কংগ্রিভ রকেট চালিয়েও সুবিধা করতে পারলো না। এদিকে মাওরিদের হামলা শুরু হলে ব্রিটিশরা কোনোমতে তা ঠেকাতে পারলো। এই হামলায় ১৩ ব্রিটিশ সৈন্য নিহত ও ৩৯ জন গুরুতর আহত হলো।
৮ জুলাই ব্রিটিশরা হন হেকের আত্মগোপনের খবর পেয়ে এক মাওরি গ্রামে আক্রমণের খবর পেয়ে সশস্ত্র অভিযান চালাল। গুলিবর্ষণের উত্তর না পেয়ে তারা জনশূন্য গ্রাম আবিষ্কার করলেন। শত্রুর শক্তি রোধ করতে গ্রামটি পুড়িয়ে দেওয়া হলো। তবে ব্রিটিশরা আদিবাসী মাওরিদের শক্তিকে উপেক্ষা করার পথ থেকে সরে আসছিল।
এবার আরো বেশি শক্তি নিয়ে উত্তর নিউজিল্যান্ডের রুয়াপেকাপেকা এলাকায় ব্রিটিশ ও মাওরি শক্তি মুখোমুখি হলো। এতদিনে ব্রিটিশরা তাদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর শক্তি বুঝতে পারছিল। মাওরি যুদ্ধকৌশল অনুযায়ী ব্রিটিশরাও এবার প্রস্তুত ছিল। এই যুদ্ধে দুপক্ষেই অনেক হতাহত হলো, তবে ব্রিটিশরা আগের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে এল। রক্তপাত ও মৃত্যু ঠেকাতে হন হেকে ও তার অনুসারীদের সন্ধির প্রস্তাব দেওয়া হলো।
ব্রিটিশ গভর্নর গ্রে’র মধ্যস্থতায় সন্ধি হলো। মাওরি নেতা হন হেকে সাধারণ ক্ষমা পেলেন। আর ব্রিটিশরা পেলো আদিবাসী বলে কাউকে উপেক্ষা না করার শিক্ষা।
This Bangla article is about the Flagstaff War between the Maori and the British force.
References:
01. https://nzhistory.govt.nz/war/northern-war
02. https://timespanner.blogspot.com/2009/04/many-flagstaffs-of-flagstaff-war.html
03. http://www.britainssmallwars.co.uk/the-flagstaff-war-new-zealand-1845.html
04. https://weaponsandwarfare.com/2018/08/22/the-flagstaff-war-1845-6-part-i/