Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফ্লি সার্কাস: ভিক্টোরীয় যুগের বিচিত্র এক বিনোদন মাধ্যম

বিশাল এক ফাঁকা মাঠে কার্নিভাল জমে উঠেছে। নানা বেশের নানা রকম মানুষ ভিড় জমিয়েছে চারপাশে। হরেক রকম স্টল, হরেক রকম মজার মজার জিনিস। এত কিছুর মধ্যেই মাঠের এক কোণে একটা জায়গায় মানুষের ভীড় যেন একটু বেশি। কী হচ্ছে সেখানে? সেখানে সার্কাস চলছে। এমন এক সার্কাস যা হয়তো আপনার খালি চোখে দেখতে একটু কষ্টই হবে। কারণ, সার্কাসে যারা কসরত করছে তাদের আপনি পকেটে নিয়েই ঘুরে বেড়াতে পারবেন। কী? অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, এ আবার কেমন সার্কাস? হ্যাঁ, এমন একধরনের সার্কাসই একটা সময় ছিল মানুষের অন্যতম একটি বিনোদনের মাধ্যম। নাম তার ফ্লি সার্কাস।

ফ্লি সার্কাসের একটি সেট; Image Source: Wikimedia Commons

ফ্লি হলো একধরনের ক্ষুদ্র পোকা। অনেকটা মাছির মতোই, কিন্তু ডানা নেই এদের। বিড়াল কিংবা কুকুরের মতো লোমশ পশুর গায়ে এরা থাকে। মানুষের গায়েও অনেক সময় দেখা যায় এদের। রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে এরা। তো এই পিচ্চি একটি পোকা কিভাবে সার্কাস দেখাবে? কিভাবেই বা তাকে দিয়ে নানা রকম কসরত করানো হবে? চলুন আজকে তবে জেনে নিই এসব প্রশ্নের উত্তর, আর সেই সাথে বিস্তারিত জেনে নিই এই অদ্ভুত ফ্লি সার্কাস সম্পর্কে।

বহুগুণ বড় করে তোলা একটি ফ্লির ছবি; Image Source: cloudinary.com

মাছির মতো ক্ষুদ্র পোকা বা ফ্লি দিয়ে গাড়ি টানা, ফুটবল খেলা সহ নানা রকম কসরত দেখানোর সার্কাস ছিল একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় একটি বিনোদন মাধ্যম। ১৮০০ সাল থেকে ১৯০০ সালের প্রথমদিকে এই ফ্লি সার্কাস সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেসময় ভ্রাম্যমাণ মেলার মতো কার্নিভালগুলো ছিল মানুষের সবচেয়ে বড় বিনোদনের উৎস। আর এই কার্নিভালের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল ফ্লি সার্কাস।

তবে বেশিরভাগ ফ্লি সার্কাসই ছিল নকল ও লোক ঠকানো। সেসময় মানুষজন ছিল অনেকটাই সহজ সরল। ফলে বেশিরভাগ ফ্লি সার্কাসে জীবিত ও আসল পোকা ব্যবহার না করে নানা ধরনের চুম্বক ও ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ দিয়ে নানা কসরত দেখানো হতো। তবে আসল ফ্লি সার্কাস যে ছিল না তা কিন্তু নয়। 

ফ্লি সার্কাসের পোস্টার; Image Source: alamy.com

সবচেয়ে প্রাচীন ফ্লি সার্কাসের কথা দেখতে পাওয়া যায় ১৮৮৯ সালের এনসাইক্লোপিডিয়া অফ আউটস্ট্যান্ডিং ফ্যাক্টস এন্ড ইউজফুল ইনফরমেশনে। সেখানে একটি বলা হয়,

“রানী এলিজাবেথের রাজত্বকালীন বিংশতম বছরে (১৫৭৮) মার্ক স্কালিওট নামের এক কামার ১১টি টুকরা লোহা, ইস্পাত ও পিতল দিয়ে একটি তালা তৈরি করেন। তালাটির চাবির ওজন ছিল একটি শস্যকণার সমান। এরপর তিনি সোনা দিয়ে খুব সূক্ষ্ম একটি শিকল তৈরি করেন যার সাথে ৪৩টি লুপ যুক্ত ছিল। এরপর তিনি এই শিকলটি একটি ফ্লির ঘাড়ে যুক্ত করে দেন, যে এই সবকিছু টেনে নিয়ে গিয়েছিল।”

তবে সর্বপ্রথম এই ছোট্ট পোকার ঘাড়ে লাগাম লাগান ঘড়ি মেরামতকারীরা। তারা ফ্লি দিয়ে নানা কসরত দেখাতেন ও তা তাদের নিজেদের দক্ষতার বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করতেন।

গাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে দুটি পোকা; Image Source: pinterest.com

বিনোদন হিসেবে ফ্লি সার্কাস শুরু হয় প্রথম ইংল্যান্ডে, ১৮৩০ সালে। সিগনর বার্টোলট্টোর ‘পরিশ্রমী ফ্লি’ নামের শোটি সেসময় সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। এই শো পরিচালনা করতেন লুইস বার্টোলট্টো। তিনি নানা রকম রাজনৈতিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে পোকাদের দিয়ে নানা কসরত দেখতেন। তিনি তার ফ্লিগুলোর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নামে নাম দিয়েছিলেন, যা স্থানীয় মানুষের কাছে ছিল অনেক জনপ্রিয়। এরপরের ১০০ বছরে ফ্লি সার্কাস আমেরিকার মতো আরো অনেক দেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ এর মধ্যবর্তী সময়েও এটি জনপ্রিয় ছিল। এখনো অনেক কার্নিভালে এই ফ্লি সার্কাস দেখতে পাওয়া যায়।

নিজের ওজনের বহুগুণ ভারী জিনিস টানতে পারে ফ্লি; Image Source: hswstatic.com

আগেই বলা হয়েছে অনেক ফ্লি সার্কাসই ছিল নকল। সেসব ফ্লি সার্কাসে মৃত পোকা দিয়ে নানা কসরত দেখানো হতো। কোনো কোনো সার্কাসে তো আবার সেটিও থাকতো না। তারা নানা ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ নিয়ে নানা রসালো কথাবার্তা বলে উপস্থিত দর্শককে বোঝাতো যে, এগুলো জীবিত ফ্লি। গোপন চুম্বক ও নানা কলাকৌশলের মাধ্যমে তারা এই কসরতগুলো দেখাতো।

তবে আসল ফ্লি সার্কাসে জীবিত ফ্লি ব্যবহার করা হতো। ফ্লি বা ক্ষুদ্র এই পোকাগুলো আসলে লাফানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। তবে এরা তাপ, আলো কিংবা চাপের মতো নানা পরিস্থিতিতে সাড়া দেয়। এছাড়াও এরা নিজেদের ওজনের ৭০০ গুণ বেশি ওজনের জিনিস টেনে নিয়ে যেতে পারে, ৬০ গুণ বেশি ওজনের জিনিস উপরে তুলতে পারে এবং নিজেদের উচ্চতার চেয়ে প্রায় ১৫০ গুন বেশি উচ্চতায় লাফ দিতে পারে।

ফ্লির টানা একটি গাড়ির আকার দেখানো হয়েছে; Image Source: darkroastedblend.com

তবে এই পোকাদের আসলে তেমন কিছুই শেখানো যায় না। কারণ কোনো কিছু শেখার মতো বুদ্ধি এদের নেই। তাহলে কীভাবে এরা নানা রকম কসরত করে? হ্যাঁ, এদের জটিল কোনো কসরত শেখানো যায় না ঠিকই, তবে এদের একটি জিনিস শেখানো যায়। স্বাভাবিকভাবেই এরা খুব জোরে লাফ দিতে পারে। তবে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এরা যাতে লাফ না দেয় সেরকম প্রশিক্ষণ এদের দেওয়া যায়। যদি একটি পোকাকে একটি ছোট শিশিতে রাখা হয় তবে এরা স্বাভাবিকভাবেই পালিয়ে যাওয়ার জন্য জোরে লাফ দিতে থাকে। তবে শিশির মুখ থাকে বন্ধ। পোকাটি যতবার লাফ দেয় ততবার ছোট শিশির দেয়ালে পোকাটির মাথা আঘাত লাগতে থাকে। ফলে একসময় লাফাতে লাফাতে পোকাটি ক্লান্ত হয়ে পড়ে ও সে শিখে নেয় লাফালেই তার মাথায় আঘাত লাগবে। ফলে পোকাটি পরবর্তীতে আর খুব জোরে লাফায় না।

এমন একটি পোকাকে যখন একটি ফাঁকা জায়গায় ছেড়ে দেওয়া হয় তখন এটি আর লাফিয়ে বাইরে যেতে পারে না। তারা তখন ছোট ছোট লাফ দেয় যাতে তাদের মাথায় আর আঘাত না লাগে। আর এই ছোট ছোট লাফকেই একজন ফ্লি সার্কাস পরিচালক ‘হাঁটা’ বলে চালিয়ে দেন। এ ধরনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফ্লি-কে বলা হয় হাঁটতে শেখা ফ্লি।

এই গাড়িগুলো যুক্ত করে দেওয়া হতো পোকার সাথে; Image Source: pinterest.com

এই হাঁটতে শেখা পোকাগুলোর সাথে এখন কোনো ক্ষুদ্র গাড়ি যুক্ত করে দিলেই তারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং সেই সাথে গাড়িটিকে টেনে নিয়ে যায়। গাড়ি টানার জন্য পোকাগুলোর ঘাড়ে আমাদের চুলের চেয়েও চিকন ও সূক্ষ্ম একটি তার বেঁধে দেওয়া হয়। আপাতদৃষ্টিতে এটি অসম্ভব মনে হলেও আতশকাচ ব্যবহার করে সহজেই এটি করা যায়। আর সূক্ষ্ম তারটিকে এমনভাবে তাদের ঘাড়ে বেঁধে দেওয়া হয় যাতে পোকাটি মরে না যায়।

আধুনিক ফ্লি সার্কাসের একটি সেট; Image Source: twitter.com

পোকার গায়ে আঠা দিয়ে তার যুক্ত করে সহজেই এই জটিল প্রক্রিয়াটি এড়ানো যায়, তবে অনেক সার্কাস পরিচালকের কাছে এই পদ্ধতিটি নিষ্ঠুর বলে মনে হয়েছিলো। তাই তারা আঠা ব্যবহার না করে তার ব্যবহার করতেন। এ তো গেল গাড়ি টানার কথা। ফ্লি সার্কাসের অন্যতম আকর্ষণ ছিল এই পোকাদের ফুটবল খেলা। এক্ষেত্রে ছোট্ট ও হালকা একটি বলের গায়ে এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ লাগানো হতো যা পোকাগুলো সহ্য করতে পারতো না। এখন তার দিয়ে আটকানো একটি পোকার সামনে যখন এমন একটি বল রাখা হতো তখন পোকাটি বলটির হাত থেকে লাফিয়ে পালাতে চেষ্টা করতো। কিন্তু পোকাটি আটকানো অবস্থায় থাকায় শুধু তার পাগুলো নড়তো এবং সজোরে বলটিতে আঘাত লাগতো। ফলে বলটি সামনে গড়িয়ে যেতো এবং মনে হতো পোকাটি বলটিকে লাথি মেরেছে। একইভাবে অন্য পাশে আরেকটি পোকা একই কাজ করতো। এভাবে দুই দলের মধ্যে ফুটবল খেলা চলতো।

ফ্লি সার্কাসের মজার পোস্টার; Image Source: darkroastedblend.com

ফুটবল খেলা ছাড়াও দড়ির উপরে হাঁটা, সাইকেল চালানো প্রভৃতি নানা কসরত দেখাতো এই পোকারা, যা আকর্ষণ করতো দর্শকদের। তবে একসময় পোকাদের দিয়ে এসব করিয়ে নেওয়াকে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ ‘পোকাদের উপর নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতন’ হিসেবে অভিযুক্ত করেন এবং ফ্লি সার্কাসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এছাড়াও ধীরে ধীরে অন্যান্য নানা রকম বিনোদন মাধ্যমের বিস্তার লাভ করে। ফলে কমতে থাকে ফ্লি সার্কাসের জনপ্রিয়তা। একটা সময় একদম হারিয়ে যায় এই অদ্ভুত ফ্লি সার্কাসের প্রচলন। নিচে এমনই এক ফ্লি সার্কাসের একটি ভিডিও ক্লিপ যোগ করে দেওয়া হলো। আগ্রহী পাঠকরা দেখে নিতে পারেন ক্লিপটি।

ফিচার ইমেজ – pinterest.com

Related Articles