Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফোর্ড আর ফেরারির মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাস

সময়টা ছিল ১৯৬৬। ফোর্ড মোটর কোম্পানি তাদের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি নিলো। অটোমেকারদের রেসিং টিম জিততে চাইলো টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস অফ লে মাঁ, বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ অটোমোবাইল রেস। এই ঐতিহাসিক রেস এবং তার পরবর্তী ইভেন্ট বা ঘটনাগুলো নিয়েই গড়েই উঠেছে সাম্প্রতিককালের বহুল প্রশংসিত মুভি ‘ফোর্ড ভার্সাস ফেরারি’। মুভির মূল দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ম্যাট ডেমন এবং ক্রিশ্চিয়ান বেল। মুভিটি ছিল ড্রামা, অ্যাকশন এবং চোখের পানি মেশানো কিছু মেলোড্রামা দিয়ে  দিয়ে ভরপুর। তবে এর মধ্যে বাস্তব ঘটনার কতটুকু উঠে এসেছে? ফোর্ড কীভাবে গাড়ি রেসিংয়ের ইতিহাসই পালটে দিয়েছিল, সে নিয়েই আমাদের আজকের এই আয়োজন। এখানে মুভির বেশ কিছু প্লট উঠে এসেছে। সুতরাং স্পয়লার অ্যালার্ট!

‘ফোর্ড ভার্সাস ফেরারি’ মুভির একটি দৃশ্য; Image Credit: Twentieth Century Fox

কাহিনীর প্রেক্ষাপট ১৯৬৩ সাল। জেনারেল মোটর্সের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে ছিল ফোর্ড কোম্পানি, সে সেলসের দিক দিয়েই হোক বা রেসিংয়ের দিক দিয়ে। পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে আনার জন্য ফেরারি কোম্পানি কিনে ফেলার পরিকল্পনা করলেন হেনরি ফোর্ড দ্য সেকেন্ড। ফেরারির রেসিং টিম তখন রেসের মাঠ শাসন করছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল ইতালিয়ান এই ব্র্যান্ডের সাথে রেসিং করা, এর পাশাপাশি ফোর্ডের প্রভাব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেয়া।

কিন্তু ফেরারির মালিকপক্ষের মনোভাবের কারণে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যায়। তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে দাম্ভিক মানুষদের একজন, এঞ্জো ফেরারি বলে বসেন, “ফোর্ড তাদের কুৎসিত কারখানাগুলোয় পিচ্চি পিচ্চি কুৎসিত কিছু গাড়ি বানায়” । এর ফলে মোটর স্পোর্টসের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। ফোর্ড তখন মনে করেন, ফেরারির ওপর প্রতিশোধ নেবার একটাই উপায় আছে, রেসট্র্যাকে ওদেরকে হারিয়ে ওদের নাক ভোঁতা করে দেয়া।

সেজন্য ফোর্ড যে রেসকে বেছে নেন, সেটা ছিলো টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস অফ লে মাঁ। সহনশীলতার চরম পরীক্ষা নেবার জন্য এই রেস জগদ্বিখ্যাত। অন্যান্য যেকোনো মোটরস্পোর্টস প্রতিযোগিতার চেয়ে এর খ্যাতি ছিল বেশি। ডেট্রয়েটের এই অটোমেকার লামার প্রোগ্রামের পেছনে বিনিয়োগ করলেন কোটি কোটি ডলার। কিন্তু ১৯৬৪ লে মাঁতে হেরে গেলো ফোর্ড প্রতিষ্ঠান। শুধু এই রেসে নয়, পুরো বছর জুড়েই তাদের পারফরম্যান্স ছিল জঘন্য।

চরম হতাশ হয়ে ফোর্ড অবশেষে লামার প্রোগ্রামের দায়িত্ব দিলেন ক্যারল শেলবিকে। ক্যারল শেলবি ছিলেন শেলবি আমেরিকান কোম্পানির মালিক এবং ইঞ্জিনিয়ার। তাছাড়া লামার প্রোগ্রামের হয়ে আগে একবার জেতার রেকর্ডও ছিল তার। মুভিতে তার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ম্যাট ডেমন। ফোর্ড তার জিটিফোর্টি রেস কারটি তুলে দিলেন শেলবির হাতে। এই রেসকারটি ইঞ্জিনিয়ারেরা লোলা কারস কোম্পানির সাহায্য নিয়ে বানিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এই রেসকারটি বেশ কয়েকবার হেরেছে, তাই শেলবিকে জেতা এবং কেবলমাত্র জেতার গোল ঠিক করে দেন ফোর্ড। শুধু কাগজে-কলমে হিসাব করলে চলবে না, যাও ক্যারল, যুদ্ধে নেমে পড়ো।

জিটি গাড়ির উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন দলের সদস্য শেলবির কেন মাইলস। মুভিতে তার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ক্রিশ্চিয়ান বেল। মাইলস ছিলেন একজন ব্রিটিশ ড্রাইভার এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। শেলবি কোম্পানির দারুণ সফল এসি কোবরা রেসকারগুলো নির্মাণে তিনি ইতিমধ্যেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।

শেলবি টিমের সবাই মিলে ফোর্ড গাড়িগুলোর বেশ কিছু ত্রুটি ধরে ফেলতে সক্ষম হন। তারা সেগুলোর ওপরে ব্যাপক আকারে পরীক্ষা- নিরিক্ষা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৬৫ সালের টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স লে মাঁ রেসের ঠিক আগমুহূর্তে এসে ফোর্ড গাড়ির ইঞ্জিন পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন। সেবারে তার একটা জিটিফোর্টি গাড়িও রেস শেষ করতে পারেনি, সবগুলো তার আগেই অচল হয়ে গেছে। ফেরারি জিতলো আবারও, এই নিয়ে পরপর পাঁচবার লে মাঁ রেস জেতা হলো তাদের।

এদিকে ফেরারিকে হারানোর জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছেন ফোর্ড। শেলবিরও জেতার তাগিদ আগের থেকে বেড়ে গেছে বহুগুণে। শেলবি এবং মাইলসের দলবল মিলে তাদের গাড়ির হর্সপাওয়ার বাড়ালেন এক আদিম পদ্ধতিতে। মুভির একটি দুর্দান্ত দৃশ্যে দেখানো হয় যে টিমের সবাই স্কচ টেপ দিয়ে তুলার বল লাগাচ্ছে গাড়ির গায়ে। গাড়িটি চলন্ত অবস্থায় বায়ুপ্রবাহের দিক নির্ধারণের জন্য একাজটি করেন তারা।

কেন মাইলস এবং ক্যারল শেলবি; Image Source: Getty Images

এয়ার ডাক্টিং নিয়েও কিছু ঝামেলা আবিষ্কৃত হয় এরপর। সামান্য কিছু জিনিস সারিয়ে ফেলার পরে গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষমতা ৭৬ হর্সপাওয়ার বেড়ে যায়। তারা সেই সাথে ম্যাগনেসিয়াম দিয়ে বানানো কম ওজনের চাকা, দৃঢ়মানের টায়ার এবং উন্নতমানের ব্রেকও যোগ করেন। ১৯৬৬ সালের রেসিং মৌসুম শুরু হবার পরে ফোর্ডের এই ইমপ্রুভড জিটিফর্টি জেতে টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস অফ ডেয়টোনা এবং টুয়েলভ আওয়ারস অফ সিবরিং এনডুরেন্স রেস। দুবারেই চাকার পেছনে ছিলেন কেন মাইলস। এদিকে সামনে এগিয়ে আসছে লে মাঁ। হঠাৎ করেই এই রেসের গুরুত্ব বেড়ে গেলো কিছুটা। এমনিতেই ফেরারির সাথে ফোর্ডের জেতার সম্ভাবনা বেড়ে যাবার চেয়েও বড় ঘটনা ছিল মাইলসের আরেকবার জেতার সুযোগ। ইতিহাসে কোনো ড্রাইভারেরই এরকম ত্রিমুকুট জেতার রেকর্ড নেই।

১৯৬৬ লে মাঁ রেসে ফোর্ড কোম্পানি ৮টি গাড়ি পাঠায়। তার মধ্যে তিনটি গাড়ির দায়িত্বে ছিলেন ক্যারল শেলবি। প্রথম টিমে ছিলেন মাইলস এবং নিউজিল্যান্ডের ড্যানি হম। দ্বিতীয় টিমে ছিলেন আমেরিকান ড্রাইভার ড্যান গার্নি এবং জেরি গ্রান্ট। আর তৃতীয় টিমে ছিলেন নিউজিল্যান্ডের দুই রেসার ব্রুস ম্যাকলারেন এবং ক্রিস অ্যামন।

এদিকে ফেরারি রেসে মাত্র ২টি গাড়ি পাঠায়। পরপর পাঁচ দফা জিতে তাদের আত্মবিশ্বাসের পারদ তখন আকাশ ছুঁয়েছে। তারা ভেবেছিল, অ্যান্টিক্লাইম্যাটিকভাবেই জিতে যাবে তারা। ফেরারির দুটি গাড়িই রেস শেষ করতে ব্যর্থ হয়। ২২৭তম ল্যাপ দেবার পরে তাদেরকে ‘রেসের অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়। রেসের মাঝামাঝি পর্যায়েই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এবার কোনো ফোর্ড গাড়ি জিতে নিতে যাচ্ছে সেই আরাধ্য ট্রফি।

লে মাঁ ৬৬ রেস শুরু হবার দৃশ্য; Image Source: Getty Images

কিন্তু বিচিত্র এক কারণে ১৯৬৬ লে মাঁ ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত একটি রেসে পরিণত হয়। ফাইনাল ল্যাপ শুরু করার সময়ে ফোর্ড সামনে থাকা চারটি গাড়ির তিনটিই ছিল ফোর্ডের। যথারীতি সামনের গাড়ির দায়িত্বে ছিলেন মাইলস, তারপরেই ছিলেন ম্যাকলেরেন আর অ্যামন মাইলস। ঐতিহাসিক ত্রিমুকুট তখন মাইলসের হাতের নাগালে চলে এসেছে প্রায়। কিন্তু ফোর্ডের পাবলিক রিলেশন টিমের পরিকল্পনা ছিল একটু অন্যরকম। তারা আক্ষরিক অর্থেই একটি ফটো ফিনিশ চেয়েছিল। এগিয়ে থেকে নয়, বরং ম্যাকলারেনের পাশে থেকে রেস শেষ করার জন্য মাইলসকে অনুরোধ করে ফোর্ড কোম্পানি। এর ফলে তাদের কোম্পানির ঐতিহাসিক রাজত্বটা একদম নিখুঁতভাবে ফুটে উঠবে।

একগুঁয়ে মাইলস প্রথমে হালকা প্রতিবাদ জানালেও পরে কী ভেবে এ কাজটি করতে রাজি হন। তিনি ভেবে নেন, এর ফলে ফোর্ডের দল যৌথভাবে জিতে যেতে পারবে। মাইলস, ম্যাকলারেন এবং অ্যামনের গাড়ি একত্রে রেস শেষ করে। কিন্তু টাই ঘোষণার পরিবর্তে লে মাঁ অরগানাইজারেরা সিদ্ধান্ত নেন, যে গাড়িটা সবচেয়ে বেশি পথ পাড়ি দিয়েছেন, সেটিকেই বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হবে। নিয়মানুযায়ী ম্যাকল্যারেন এবং অ্যামনের গাড়িটি মাইলসের গাড়ি থেকে ৮ মিটার পেছনে থেকে রেস শুরু করেছিল। তাই দ্রুততম ড্রাইভার হওয়া সত্ত্বেও হেরে গেলেন মাইলস। এই বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে অনন্য এক স্বীকৃতির হাত থেকে বঞ্চিত হলেন তিনি। এটি লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট হতে পারত তার।

ফেরারি ড্রাইভার অ্যাটউডকে পার হয়ে যাচ্ছেন ফোর্ড ড্রাইভার ম্যাকলারেন; Image Source: Universal Images

অযথা এই হারে দারুণ হতাশ হন মাইলস, সেই সাথে শেলবিও। এদিকে ফোর্ড তাদের প্রথম লে মাঁ জয় এবং বিশাল অর্থজয় পেয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। প্রবল হতাশ হওয়া সত্ত্বেও মাত্র একমাস বাদেই মাইলস আবার নেমে পড়েন রেসট্র্যাকে। ১৯৬৭ মৌসুমের তারা ফোর্ডের নতুন ডেভেলপড জে কারের ওপর কাজ করা শুরু করেন। এই গাড়িটি টেস্ট করার সময়ে ভয়ানক এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন মাইলস। 

দুর্ভাগ্যবশত, রেসিং কম্যুনিটির বাইরে মাইলসের পরিচিত কিছুটা সীমিতই থেকে যায়। ব্রুস ম্যাকলারেনের নামে গাড়ি কোম্পানি আছে। শেলবি অমর হয়ে আছেন ‘শেলবি কোবরা মাসট্যাঙ’ এর মাধ্যমে। কিন্তু অনবদ্য এই ড্রাইভারের অর্জন কিংবা তার অপঘাতে মৃত্যুর পেছনের মূল কারণ আড়ালেই থেকে গেছে। রেসট্র্যাকের ঘোরালো মোড়গুলো অনায়াসে পার হওয়া মাইলস কেন উষ্ণ এক দিনে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার সাদাসিধে এক রাস্তায় গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারালেন, তা এক রহস্য। এর পেছনে যান্ত্রিক ত্রুটির প্রভাব থাকলেও ফোর্ড কোম্পানি ব্যাপারটি নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করেনি।

‘ফোর্ড ভার্সাস ফেরারি’ মুভির মাধ্যমে অবশেষে নিজের যোগ্য স্বীকৃতিটুকু পাচ্ছেন তিনি। মাইলস আর শেলবির প্রচেষ্টায় ফোর্ড জিতে নেয় ১৯৬৭, ১৯৬৮ এবং ১৯৬৯ লে মাঁ। তারা দুজন মিলে পাল্টে দিয়েছেন আমেরিকান রেসিংয়ের ইতিহাস। মোটরস্পোর্টসের জগতে এক প্রভাবশালী কোম্পানি হিসেবে জায়গা করে নেয় এটি। লে মাঁর শতবর্ষের ইতিহাসে ফোর্ড হলো একমাত্র আমেরিকান কোম্পানি, যারা এই শিরোপা জিততে পেরেছে।

ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

Related Articles