প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সংযোগস্থলে অটোম্যান নামের নয়া সাম্রাজ্যের উত্থান বদলে দেয় ইতিহাসের গতিমুখ। একদিকে বাইজ্যান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপোল আর অন্যদিকে মামলুক সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু মিশরকে পদানত করেছে নিতান্তই অনায়াসে। নিয়ন্ত্রণ করেছে পুণ্যনগরী জেরুজালেম, মক্কা এবং মদিনাকে। সে তো গেল কেবল ধর্ম আর রাজনৈতিক আখ্যান। গোটা ভূমধ্যসাগরকেন্দ্রিক বাণিজ্য অনেকাংশে নির্ধারণ করেছে অটোম্যানদের ইচ্ছা। এশিয়া ও ইউরোপের সংস্কৃতিকে একীভূত করে তারা জন্ম দিয়েছে স্বতন্ত্র এক সংস্কৃতি, এক নতুন স্বর্ণযুগ।
চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে। নানা গুণে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অটোম্যান সাম্রাজ্যের পিঠও তাই কালো দাগ থেকে মুক্ত ছিল না। অজস্র নিষ্ঠুর আর ট্র্যাজিক গল্পে ভরা সমালোচিত এক দাগের নাম ভ্রাতৃহত্যা আইন বা Law of Fratricide। ল্যাটিন শব্দ Frater এর অর্থ ভাই এবং Caedere অর্থ খুন করা। শাব্দিকভাবে কেবল ভাই হত্যাকে বোঝালেও Fratricide এর পারিভাষিক পরিধি আরো বিস্তৃত। ভাই, ভাইয়ের ছেলে, পিতা, চাচা, পুত্র, নাতি কিংবা অনুরূপ যেকোনো পুরুষ আত্মীয়ের মধ্যে যারা ক্ষমতাসীন সুলতানের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গণ্য, তাদের হত্যা করাই ভ্রাতৃহত্যার অন্তর্গত।
আর যে আইনবলে সুলতান এই হত্যাযজ্ঞের পূর্ণ ক্ষমতা লাভ করতেন, তাকে বলা হয় ভ্রাতৃহত্যা আইন। সাধারণত নারীরা সিংহাসনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দণ্ডায়মান হয়নি বলে বেঁচে যেত। তবে অনেক সন্তানসম্ভবা নারীকেও সুলতানের কোপদৃষ্টিতে পড়তে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
প্রাচীন তুর্কি রাজনীতির বৈশিষ্ট্যই ছিল সাম্রাজ্যকে বংশের সাধারণ সম্পদ হিসাবে গণ্য করা। ইসলাম গ্রহণের পর তাদের জীবনযাত্রায় অনেক কিছুর বদল এলেও এর পরিবর্তন হয়নি। কেউ কেউ অবশ্য গৃহযুদ্ধ এড়ানোর জন্য রাজ্যকে ভাগ করে যুবরাজদের দিয়ে যেতেন। এ কারণে রাজ্যে বিভাজন এবং অবক্ষয় নেমে আসত। অটোম্যান আমলে সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তৃতি পেলে তার ঐক্য ধরে রাখার একটি পন্থা হিসাবে ভ্রাতৃহত্যা পদ্ধতি গৃহীত হয়।
পূর্বসূত্র
বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হলেও অটোম্যানরা কিন্তু এ পদ্ধতির উদ্ভাবক নয়। তাদের বহু আগে সাসানীয়, রোমান, বাইজ্যান্টাইন এমনকি স্পেনের উমাইয়া আমলেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সিংহাসনকে কেন্দ্র করে ইউরোপের গৃহযুদ্ধ আর লোকক্ষয়ের সাথে তুলনা করে একেই যৌক্তিক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করেছিল তারা। ক্যাস্টাইলের রাজা পেড্রো তার ভাই ডন ফাদরিককে হত্যা করেন ক্ষমতার জন্য। ত্রিবিযোন্দের শাসক তৃতীয় এন্ড্রোনিকাস কমনেসাস সিংহাসনে আসার আগে হত্যা করেন নিজের দুই ভাই মাইকেল এবং জর্জকে।
বাইজান্টাইন সম্রাটেরা তাদের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের অঙ্গহানি করে ফেলে রাখতেন জীবন্মৃত অবস্থায়। গ্রিকরা অবলম্বন করেছিল আরেকটু ভিন্ন পন্থা। অক্ষিগোলক উপড়ে ফেলে অকেজো অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা হতো। অন্ধ হতভাগ্য বংশধর মৃত্যুর আগেই মৃতের মতো জীবনযাপন করত। মাইকেল পেলিওলোগাস কাজটাকে একটু সহজভাবে সমাধা করার জন্য নিজের ভাই চতুর্থ জন এবং লায়েক্যারিসকে অন্ধ করতে উত্তপ্ত লৌহশলাকা ব্যবহারের নির্দেশ দেন।
প্রাচ্যেও এর চর্চা ছিল কমবেশি। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রসঙ্গ সবার আগে আনা যায়। খোদ হুমায়ুনকে সিংহাসন পোক্ত করার জন্য ভাইদের সাথে লড়তে হয়েছে। আওরঙ্গজেবকে ক্ষমতায় আসার আগে হত্যা করতে হয়েছে সুজা, দারাশিকো এবং মুরাদকে। পূর্ববর্তী চীনা সাম্রাজ্যেও ভ্রাতৃহত্যার নজির দেখা যায়।
অটোম্যান আইন
তুর্কিরা আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নেয় গল্পটাকে। বহু বছর ধরে চলে আসা সেই পুরাতন গল্প। সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ তার কানুন-নামায় ভ্রাতৃহত্যা আইন পাশ করেন। ঘোষণা দেয়া হয়,
“আমার বিচারকগণের অধিকাংশই এই সিদ্ধান্তে একমত যে, আমার পরে যে বংশধরেরা সিংহাসনের অধিকার লাভ করবে; তারা তাদের ভাইকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে পারবে, যাতে সাম্রাজ্যের বিকাশমানতা থেমে না যায়। আর একে যথাযথভাবে সম্পাদন করা তাদের দায়িত্ব।”
(H. A. Gibbons, Foundation of the Ottoman Empire, Oxford, 1916, page- 180)
শেষ লাইনেই মোটামুটি আইনটির দাপট ঠাহর করা যায়। বাস্তবিক অর্থেই তাদের দৌরাত্ম্য এতদূর পৌঁছায় যে, ইসলাম ধর্মের মূল গ্রন্থ কুরআন থেকে সমর্থন লাভের তোড়জোর চলতে থাকে আইনের পক্ষে। পাশও করা হয় উলেমা সম্প্রদায়ের পূর্ণ সমর্থনে। দাবি করা হয়, একটি প্রদেশ বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে একজন রাজকুমারকে হত্যা করাটা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতির। কুরআনের সমর্থনের কথা বলতে টানা হয় সুরা কাহাফের ৮০-৮১ নম্বর আয়াত। যেখানে মুসা (আ.) একজন বালক হত্যার জন্য খিজিরকে তিরস্কার করলে তিনি উত্তর দেন,
“তার পিতামাতা বিশ্বাসী। কিন্তু তার ভেতরে সীমালঙ্ঘন আর কুফরীর আশঙ্কা পেলাম। তাই চাইলাম, প্রতিপালক সেই পিতামাতাকে এর পরিবর্তে পবিত্রতা ও দয়ামায়ায় উত্তম সন্তান দান করবেন।”
দলিল হিসেবে আসে খ্রিস্টিয় গ্রন্থ গসপেল অব জনও। সেখানে ১৮ নম্বর ভার্স-এ বলা হয়েছে,
“একজন মানুষের জীবন নিয়ে যদি গোটা জাতিকে বাঁচানো যায়; তবে সেটাই উত্তম।”
এভাবে বিভিন্ন জায়গা ঘেঁটে দলিল বের করে ভ্রাতৃহত্যায় ধর্মীয় বৈধতা প্রমাণ করা হলো। সিরিয়ার হাম্বলি পণ্ডিত কারমি এর প্রশংসাই করলেন। তিরিশজনকে বাঁচানোর জন্য তিনজনের হত্যাকে সমর্থন করে তিনি দুটি বিপজ্জনক পথের থেকে উত্তমটি বেছে নেবার ফতোয়া দিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মরোক্কো সালতানাতের পতনের প্রধান কারণ উত্তরাধিকার সমস্যা।
হত্যার আগে প্রধান মুফতি বা শায়খুল ইসলামের অনুমোদন গ্রহণ করা হতো। অটোম্যান আইনে পাণ্ডিত্য থাকার পরেও অনেক ক্ষেত্রেই মুফতি হত্যার জন্য ফতোয়া দিতে অস্বীকার করতেন। দ্বিতীয় উসমান যুদ্ধে যাবার আগে তার ভাই মুহম্মদকে মৃত্যুদণ্ড দেবার ফতোয়া চাইলে মুফতি ইসাদ আফেন্দী অস্বীকার করেন। তাই বলে ঠেকে থাকেনি সুলতানের ইচ্ছা কিংবা অটোম্যান সংস্কার। পরে রুমেলি কাজি আসকার (সামরিক কাজি) এবং কামাল উদ্দীন আফেন্দীর নিকট থেকে ফতোয়া পাওয়া যায়।
গৃহীত পদ্ধতি
ভ্রাতৃহত্যায় অন্যান্য অনেক রাজবংশের সাথে সাদৃশ্য থাকলেও অটোম্যানরা ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। পশ্চিমা সাম্রাজ্যগুলোর মুণ্ডুপাত প্রথাকে সরিয়ে তারা উদ্ভাবন করেছিল কামান-কিয়িশী নামের একপ্রকার ধনুকী ফাঁসের ব্যবহার। ফাঁসটি গলায় পরিয়ে হত্যার কাজ সমাপ্ত করা হতো। উদ্দেশ্য ছিল রাজকুমারদের রক্ত যেন মাটি না পড়ে, এতে করে রাজবংশের 'মানরক্ষা' হতো।
হত্যা পরিচালনা করত জল্লাদ-বাশী বা প্রধান জল্লাদ। তাকে সহায়তা করত হেরেমের কয়েকজন বোবা। টানাহেঁচড়া করে কোনোমতে একবার ধনুকী ফাঁসটি গলায় পরিয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। তারপর কষাকষি করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস বের হয়ে যেত। তবে অন্য পদ্ধতিও গৃহীত হতো মাঝে মাঝে। প্রথম মুরাদ তার বিদ্রোহী পুত্র সাউজির চোখ উপড়ে দেন; যার ফলে শাহজাদা মারা যান। আমিল মুসা তার ভাইপো ঔরখানকে অন্ধ করে দিলে মারা যান তিনিও। দ্বিতীয় মুরাদের হাতে অন্ধ হন তার তিন ভাই আহমাদ, মুহাম্মদ এবং ইউসুফ।
ভ্রাতৃহত্যার নমুনা
১২৯৮ সালে প্রথম কঠিন সিদ্ধান্তটি নেন প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং উসমান গাজি। চাচা দুন্দার বে-কে হত্যার নির্দেশনা দেয়া হয় বাইজ্যান্টাইন ভূ-স্বামীদের সহযোগিতার জন্য। প্রথম শতকগুলোতে শাহজাদারা প্রায়ই সালতানাতের ঐক্যের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিত। আনাতোলিয়ার অন্যান্য রাজ্য এবং বিশেষ করে বাইজ্যান্টাইন শাসকের মদদ পেয়ে বিদ্রোহ করে বসত প্রায়ই। আঙ্গোরার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৪০২ সালে। যুদ্ধে অটোম্যান সুলতান বায়েজিদের পরাজয়ের ঘটনা রাজ্যের উপর দারুণ প্রভাব পড়ে। পরবর্তী কয়েক বছর বংশধরদের মধ্যে কোন্দলের মীমাংসা হয়নি। কারণ প্রায় সবার পক্ষেই ছিল পর্যাপ্ত সমর্থন। শেষ পর্যন্ত ছোট ভাই প্রথম মুহম্মদ সিংহাসন নিশ্চিত করতেই বাকি ভাইদের হত্যা করেন।
আগে থেকে অটোম্যান তুর্কিদের মধ্যে উত্তরাধিকারের কোনো নীতি ছিল না। শাহজাদাদের আট বছর বয়সে হেরেম থেকে সেলামলিক-এ সরানো হতো। সেখানে চলত শিক্ষাদীক্ষা। তারপর শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রাদেশিক দায়িত্ব পেতেন। পিতার মৃত্যুর পরে যিনি সবার আগে রাজধানীতে পৌছাঁতেন; তিনিই হতেন সুলতান। দ্বিতীয় মুহম্মদের মাধ্যমে ভ্রাতৃহত্যা আইন কার্যকর হলে পরিস্থিতির বদল ঘটে। বংশধরদের যে শক্তিশালী আর ভাগ্যবান সিংহাসনে আসীন হতেন, তিনি পেতেন নিজের পথ পরিষ্কার করার বৈধ ক্ষমতা।
এই হত্যার পেছনে তিনটি কারণ বেশ স্বচ্ছ। প্রথমত, শাহজাদাদের বিদ্রোহ এবং সিংহাসন দখল করার সম্ভাবনা। যেমনটা ঘটেছিল ১৪৮১ সালে মুহম্মদের মৃত্যুর পর। ভাইয়ের থেকে সাম্রাজ্য ভাগের প্রস্তাব এলে বায়েজিদ তা প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর, অভ্যন্তরীণ কোন্দল পার হয়ে মসনদে আসীন হন। দ্বিতীয় কারণ, সরাসরি বিদ্রোহের কারণ না থাকলেও একটা অভ্যুত্থানের লক্ষণ থাকত। জনমনে শাসকের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টি একধরনের অপরাধ। প্রথম সেলিমের হাতে শাহজাদা কোরকুত কিংবা সুলতান সুলাইমানের হাতে পুত্র মোস্তফার হত্যার পেছনে এই কারণ বিদ্যমান।
তৃতীয় কারণ বিদ্রোহ বা প্রস্তুতি নিয়ে নয়; বৈধতা নিয়ে। অটোম্যানদের মধ্যে শাহজাদাদের হত্যা করার বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সাম্রাজ্য অখণ্ড রাখার অজুহাতে। সাধারণ মানুষ অটোম্যান বংশধরদের জন্যই মসনদকে মেনে নিয়েছিল। সুতরাং বাইরে থেকে শত্রু আসাটা প্রায় অসম্ভব। সামরিক বাহিনী কিংবা যে কেউ বিদ্রোহ করলে অন্য কোনো অটোম্যান বংশধরকেই সামনে রাখতে হবে। তাই বর্তমানে ক্ষমতাসীন সুলতান শত্রুমুক্ত থাকার জন্য সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের সরিয়ে ফেলতেন।
ফলাফল
ভ্রাতৃহত্যা আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যের সংহতি বজায় এবং গৃহযুদ্ধের হাত থেকে অক্ষত থাকা। আইন কার্যকর করার মাধ্যমে উদ্দেশ্য অনেকাংশেই ফলপ্রসূ হয়েছে। সাম্রাজ্য তেমন কোনো অভ্যন্তরীণ হুমকির সম্মুখীন হয়নি। সেইসাথে বহু সম্ভাবনাময় ও করিৎকর্মা শাহজাদাকেও হারাতে হয়েছে। সুলতান সুলাইমনের ছেলে শাহজাদা মুস্তফার কথাই ধরা যাক। ভাই সেলিমের থেকে তার যোগ্যতা সকল দিক দিয়েই এগিয়ে ছিল। তার মতোই অনেক যোগ্য শাহজাদার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অপাত্রের হাতে সিংহাসনের দায় অর্পিত হয়েছে।
এই আইনের মাধ্যমে অন্তত ৮০ জন শাহজাদাকে হত্যা করা হয়। এ কারণে অটোম্যান সমাজে রক্তের দিক হতে কোনো কুলীন সম্প্রদায় গড়ে উঠতে পারেনি। সাম্রাজ্য বা সালতানাতের উপজাত হিসেবে সেই শ্রেণিটা পাওয়া যায়। হাল আমলের সৌদি আরবের রাজপুত্রদের হাল-হকিকত সম্পর্কে ধারণা থাকলে আন্দাজ করা সহজ হবে। প্রায় সাড়ে ছয়শো বছরের অটোম্যান সাম্রাজ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো গৃহযুদ্ধ হয়নি। অথচ ঐ সময়ে পশ্চিমে খ্রিস্টান রাজন্যবর্গের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ছিল অতি সাধারণ ব্যাপার। সুলতান মুহম্মদ 'সানজাক বে'- আইনের মাধ্যমে শাহজাদীর বংশধরদেরও উচ্চতর সম্প্রদায়ে পরিণত হওয়াতে বাঁধ সাধলেন।
উচ্ছেদের দিনপঞ্জি
১৬০৩ সালে সিংহাসনে আরোহণের পর সুলতান প্রথম আহমদ তার ভাইদের হত্যা করেননি, যা তার সহনশীল নীতির নজির হিসেবে পরিগণিত। ১৬১৭ সালে তার মৃত্যুর পর তার ভাই সিংহাসনে আরোহন করেন। অথচ তখন তার পুত্র উপস্থিত ছিলেন। প্রথমবারের মতো অটোম্যান ইতিহাসে সুলতানের ভাই সুলতানের মৃত্যুর পর স্থলাভিষিক্ত হলেন। এর আগে পর্যন্ত উত্তরাধিকার পেয়েছে কেবল পুত্রেরা।
এরপর থেকে শাহজাদাদের আর সানজাক-এ পাঠানো হতো না। বরং প্রাসাদে রেখেই প্রয়োজনীয় শিক্ষার মাধ্যমে প্রস্তুত করা হতো পরবর্তী সিংহাসনের অধিকর্তা হবার জন্য। শাহজাদাদের হত্যা করার নীতিও রহিত করা হয়। অনেক ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, প্রাসাদে থাকার কারণে পরবর্তী উত্তরাধিকারীরা আগের চাইতে অযোগ্য হয়ে বেড়ে উঠতে লাগলো। বৃদ্ধি পেল প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের তৎপরতা। উজির, উলেমা এবং সৈন্যরা প্রভূত ক্ষমতার মালিক বনে গেল, যা তাদের পতনের পথে নতুন প্রভাবক হিসাবে যুক্ত হয়েছে।
ধীরে ধীরে ভ্রাতৃহত্যার প্রতি অনাগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুলতান আবদুল হামিদ তার ভ্রাতুষ্পুত্র তৃতীয় সেলিমকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন। ঊনবিংশ শতকের দিকে প্রায় রহিত হয়ে যায় এই প্রথা। আবদুল মজিদ সরাসরি পিতার সিংহাসন লাভ করে ভাই আবদুল আজিজকে স্বাধীন রাখেন। আবদুল আজিজও ক্ষমতায় এসে ভাইপোদের সকল প্রকার সুবিধা প্রদান করেন। এমনকি ১৮৬৭ সালে মুরাদ ও আবদুল হামিদ নামে দুই ভাইপোকে নিয়ে লন্ডন ঘুরে আসেন। সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ তার ভাই এবং ভাতিজাদের সুবিধা প্রদান করেন আরো বর্ধিত হারে। এমনকি পদচ্যুত সুলতানদের সাথেও করা হয় মানবোচিত ব্যবহার। সুলতান আবদুল মজিদকে সিংহাসনচ্যুত করা হলে রাজবংশের সকল সদস্যসহ ইউরোপ প্রেরণ করা হয়।
অটোম্যান ভ্রাতৃহত্যা আইনকে রাজনৈতিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর পেছনের মনস্তত্ত্ব কিছুটা আঁচ করতে পারা যায়। সরাসরি ভালো বা খারাপ বলে দেওয়াটা বোকামি হবে; শুধু উপলব্ধি করা যাবে পরবর্তী পরিণাম। এর মাধ্যমে সাম্রাজ্যের জন্য সাময়িক স্থিতিশীলতা লাভ ঘটেছে সত্য, কিন্তু সুদূরপ্রসারী গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। যা ত্বরান্বিত করেছে দীর্ঘকালের এক সাম্রাজ্যের পতনকে।
This Bengali article is about The law of fratricide in the ottoman empire and its consequences in a nutshell.
References:
1) ইসলাম: রাষ্ট্র ও সমাজ, ড. শেখ মুহাম্মদ লুৎফর রহমান, ফেমাস বুকস, জুলাই ২০১৭, পৃষ্ঠা ১৪৭-১৫৫
2) H. A. Gibbons, Foundation of the Ottoman Empire, Oxford, 1916, page- 180
and which are hyperlinked.
Featured Image: historiafactory.wordpress.com