Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রুয়ান্ডান গণহত্যায় ফ্রান্সের বিতর্কিত ভূমিকা (পর্ব–২)

১৯৯০ সালের অক্টোবরে ফ্রান্সের সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালির দিকে তুতসি বিদ্রোহী দল ‘রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্টে’র (আরপিএফ) অগ্রযাত্রা প্রতিহত হয় এবং রুয়ান্ডার হুতু–নিয়ন্ত্রিত সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে সক্ষম হয়। এরপর আরপিএফ রুয়ান্ডান সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে এবং প্রায় এক বছর এভাবে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। এই সময়ে রুয়ান্ডান সরকার ব্যাপকভাবে তুতসিবিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকে এবং এর ফলে হুতু জনসাধারণের মধ্যে তীব্র তুতসিবিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। একই সময়ে রুয়ান্ডান সরকার তুতসিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে নিপীড়ন শুরু করে এবং হুতু মিলিট্যান্টরা হাজার হাজার তুতসিকে হত্যা করে।

রুয়ান্ডান সরকারের প্রধান মিত্র ফ্রান্স রুয়ান্ডায় বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত ছিল এবং রুয়ান্ডায় যে একটি তুতসিবিরোধী গণহত্যার পূর্বপরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটিও তারা ভালোভাবেই জানত। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফরাসি সরকার এই ধরনের ঘটনা রোধ করার জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং এ সময় তারা রুয়ান্ডান সরকারকে পূর্ণ সামরিক সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখে। এদিকে ১৯৯২ সালের শেষদিকে রুয়ান্ডান সরকার ও আরপিএফের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি সম্পাদিত হয়, কিন্তু রুয়ান্ডান সরকার কর্তৃক তুতসিদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে ছয় মাসের মধ্যেই এই যুদ্ধবিরতি অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

রুয়ান্ডায় ফ্রান্সের দ্বিতীয় সামরিক অভিযান

১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরপিএফ একটি ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে রুয়ান্ডার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে নেয় এবং রাজধানী কিগালির ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে এসে পৌঁছায়। রুয়ান্ডান সরকারি বাহিনী তাদেরকে প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। আরপিএফ যেকোনো মুহূর্তে কিগালির ওপর আক্রমণ চালিয়ে শহরটি দখল করে নিতে পারে, এই আশঙ্কায় রুয়ান্ডান রাষ্ট্রপতি হাবিয়ারিমানা ফ্রান্সের কাছে জরুরি সহায়তার জন্য আবেদন করেন। যথারীতি ফ্রান্স এই আহ্বানে সাড়া প্রদান করে এবং প্রথমে ১৫০ ও পরবর্তীতে ২৫০ জন সৈন্যকে রুয়ান্ডায় প্রেরণ করে। ৪০০ সৈন্যবিশিষ্ট এই ফরাসি সৈন্যদলটির নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল দিদিয়ে তুজাঁ।

কিগালি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একজন ফরাসি সৈন্য। রুয়ান্ডান শিশু–কিশোররা তার কার্যকলাপ দেখছে; Source: Wikimedia Commons

ফরাসি সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে রুয়ান্ডান সেনাবাহিনী আরপিএফের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ আরম্ভ করে এবং ফরাসিদের সরবরাহকৃত কামানের গোলা আরপিএফের অবস্থানের ওপর আঘাত হানতে শুরু করে। এর ফলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এমতাবস্থায় ফরাসিদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ এড়ানোর জন্য এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতু জনসাধারণের মধ্যে বিদ্যমান তীব্র তুতসিবিরোধী মনোভাবের প্রেক্ষাপটে কিগালি দখল করলেও সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয় এই উপলব্ধি থেকে আরপিএফ কিগালি আক্রমণ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয় এবং পশ্চাৎপসরণ করে। এভাবে ফ্রান্স দ্বিতীয় বারের মতো আরপিএফের বিজয় রোধ করে এবং রুয়ান্ডান সরকারকে রক্ষা করে। কিন্তু একই সঙ্গে রুয়ান্ডান গণহত্যাকে এড়ানোর আরেকটি সুযোগ হারিয়ে যায়।

রুয়ান্ডান গণহত্যা এবং ফ্রান্স

১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল হুতু উগ্রপন্থীদের নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে রাষ্ট্রপতি হাবিয়ারিমানাকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয় এবং তিনি নিহত হন। হুতু উগ্রপন্থীরা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তুতসিদের দায়ী করে এবং ৭ এপ্রিল থেকে রুয়ান্ডা জুড়ে তুতসিদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত গণহত্যা আরম্ভ করে। মাত্র তিন মাসের মধ্যে হুতু মিলিট্যান্টদের হাতে অন্তত ৮ লক্ষ তুতসি ও মধ্যপন্থী হুতু নিহত হয়।

গণহত্যা চলাকালে রুয়ান্ডায় ফ্রান্সের ভূমিকা পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। গণহত্যা আরম্ভ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ফরাসি সৈন্যরা রুয়ান্ডায় পৌঁছায় এবং সেখান থেকে ফরাসি নাগরিকদের সরিয়ে নেয়। কিন্তু মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা তুতসিদেরকে কোনো প্রকার সহায়তা প্রদান করতে তারা অস্বীকৃতি জানায়। তারা কিগালিতে অবস্থিত ফরাসি দূতাবাসের কুকুরটিকে পর্যন্ত নিরাপদে সরিয়ে নেয়, কিন্তু অন্য কোনো তুতসি তো পরের কথা, ফরাসি দূতাবাস ও ফরাসি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের তুতসি কর্মচারীদেরকেও তারা সহায়তা করেনি। শুধু তা-ই নয়, যেসব তুতসি নারী/পুরুষ ফরাসি নাগরিকদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিল, তাদেরকেও ফরাসিরা রুয়ান্ডায় ফেলে যায়।

অবশ্য ফরাসি সৈন্যরা কিছু হুতুকে উদ্ধার করে। এদের মধ্যে ছিলেন নিহত রাষ্ট্রপতি হাবিয়ারিমানার স্ত্রী এবং কিছু হুতু রাজনীতিবিদ, যাঁরা এই গণহত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্য দিয়ে রুয়ান্ডায় তুতসিবিরোধী গণহত্যার প্রতি ফ্রান্সের যে সুস্পষ্ট সমর্থন ছিল, সেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

১৯৯৪ সালে গ্যাবনের লিব্রেভিলে একটি ফরাসি ‘সি–১৩০ হারকিউলিস’ পরিবহন বিমান। এই বিমানটি ব্যবহার করে ফরাসিরা রুয়ান্ডায় সৈন্য মোতায়েন করেছিল; Source: Wikimedia Commons

ফরাসিরা একে তো গণহত্যার শিকার তুতসিদের কোনো প্রকার সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানায়, তদুপরি তারা রুয়ান্ডায় যে গণহত্যা ঘটছে, এই বিষয়টিও স্বীকার করতে চায়নি। ফ্রান্সের আফ্রিকা সেলের প্রধান জাঁ ক্রিস্তফ মিতেরা দাবি করেন যে, রুয়ান্ডায় কোনো গণহত্যা সংঘটিত হওয়া সম্ভবই নয়, কারণ আফ্রিকানরা ‘এতটা সংগঠিত নয়’। তার বাবা এবং ফরাসি রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া মিতেরা গণহত্যার বিষয়টি অস্বীকার করেননি, কিন্তু তিনি মত প্রকাশ করেন যে, এই জাতীয় দেশগুলোতে গণহত্যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়! উভয়ের বক্তব্যেই তাদের তীব্র বর্ণবাদী মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

অপারেশন তুর্কোয়া: রুয়ান্ডান গণহত্যাকারীদের রক্ষায় ফ্রান্স

রুয়ান্ডান গণহত্যা চলাকালে আরপিএফ রুয়ান্ডান সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণাভিযান শুরু করে এবং একের পর এক অঞ্চল আরপিএফের হস্তগত হতে থাকে। এমতাবস্থায় রুয়ান্ডান সরকারের পতন নিশ্চিত হয়ে ওঠে। কিন্তু রুয়ান্ডান সরকার কর্তৃক তুতসিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যার কারণে এবার আর ফ্রান্সের জন্য সরাসরি আরপিএফের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব ছিল না, কারণ সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ফ্রান্সের মর্যাদা ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ হতো। এজন্য রুয়ান্ডান সরকারকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ফ্রান্স একটি নতুন কৌশল অবলম্বন করে।

১৯৯৪ সালের জুনে ফ্রান্স জাতিসংঘের অনুমতিক্রমে রুয়ান্ডায় একটি ‘মানবিক অভিযান’ শুরু করে। ‘অপারেশন তুর্কোয়া’ নামক এই অভিযানটি আনুষ্ঠানিকভাবে ছিল ‘বহুজাতিক’, কিন্তু ৩২ জন সেনেগালিজ সৈন্য ব্যতীত ২,৫০০ সৈন্যবিশিষ্ট এই ‘বহুজাতিক’ বাহিনীর বাকি সকল সদস্যই ছিল ফরাসি। এই বাহিনীটিতে ছিল ১০০টি আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার, এক ব্যাটারি ১২০ মি.মি. মর্টার, ৪টি ‘জাগুয়ার’ ফাইটার–বম্বার, ৮টি ‘মিরেজ’ ফাইটার এবং ১০টি হেলিকপ্টার। আনুষ্ঠানিকভাবে, এই সুসজ্জিত বাহিনীটির দায়িত্ব ছিল রুয়ান্ডায় চলমান গণহত্যা বন্ধ করা এবং অবশিষ্ট তুতসি জনসাধারণকে রক্ষা করা। এই উদ্দেশ্যে রুয়ান্ডার পশ্চিমাঞ্চলে রুয়ান্ডান সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে তারা একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ (safe zone) স্থাপন করে।

পরবর্তীতে ফ্রান্স দাবি করে যে, এই অভিযানের ফলে তারা হাজার হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে এবং উপদ্রুত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তারা দাবি করে যে, এই অভিযানের অংশ হিসেবে তারা রুয়ান্ডান সরকারি বাহিনী ও বিভিন্ন হুতু মিলিশিয়া বাহিনীকে আংশিকভাবে নিরস্ত্র করতে সক্ষম হয়েছে। এই দাবিগুলোর মধ্য দিয়ে ফ্রান্স রুয়ান্ডায় তাদের ভূমিকাকে গৌরবান্বিত করার প্রয়াস পায়।

মানচিত্রে ‘অপারেশন তুর্কোয়া’র প্রথম পর্যায়; Source: Wikimedia Commons

কিন্তু ফ্রান্সের প্রকৃত উদ্দেশ্য ‘মানবিক’ ছিল না। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল রুয়ান্ডান সরকারকে নিশ্চিত পতনের হাত থেকে রক্ষা করা, আরপিএফের পরিপূর্ণ বিজয় রোধ করা এবং আরপিএফ যাতে রুয়ান্ডার নতুন সরকার হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করতে না পারে ও তদানীন্তন রুয়ান্ডান সরকারের সদস্যদের বন্দি করে বিচারের সম্মুখীন করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা। এজন্য হুতুরা সোৎসাহে ফরাসি সৈন্যদের আগমনকে স্বাগত জানায়। ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ হুতু মিলিট্যান্টরা তুতসিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনা অব্যাহত রাখে এবং হাজার হাজার তুতসিকে হত্যা করে। ফরাসি সৈন্যরাও তুতসিদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড ও নারী নির্যাতনে জড়িত ছিল, তুতসি ভুক্তভোগীরা এরকম অভিযোগও উত্থাপন করেছে।

এদিকে ১৯৯৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে আরপিএফ ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত ‘তুর্কোয়া অঞ্চল’ বাদে রুয়ান্ডার বাকি অংশ অধিকার করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। এ সময় তুতসিবিরোধী গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ফরাসি ‘নিরাপদ অঞ্চলে’র মধ্য দিয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র জায়ারে ও অন্যান্য রাষ্ট্রে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং এর মধ্য দিয়ে নিশ্চিত শাস্তি থেকে রক্ষা পায়। লক্ষ লক্ষ হুতু জনসাধারণও আরপিএফ/তুতসিদের প্রতিশোধের ভয়ে ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে জায়ারেতে পালিয়ে যায়। অবশেষে ১৯৯৪ সালের ২১ আগস্ট সর্বশেষ ফরাসি সৈন্য রুয়ান্ডা ত্যাগ করে এবং এরপর আরপিএফ রুয়ান্ডার প্রাক্তন ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলটিও হস্তগত করে।

রুয়ান্ডান ডোমিনো: জায়ারের পতন

রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে আরপিএফের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের আশঙ্কা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। রুয়ান্ডা ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্ব থেকে ক্রমশ দূরে সরে যায় এবং অ্যাংলোফোন বিশ্বের নিকটবর্তী হতে শুরু করে। এদিকে রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধের অবসানের পর পার্শ্ববর্তী জায়ারে হুতু বিদ্রোহীদের একটি ঘাঁটিতে পরিণত হয় এবং সেখান থেকে তারা রুয়ান্ডার অভ্যন্তরে আক্রমণ চালাতে শুরু করে। জায়ারের ফরাসি–সমর্থিত রাষ্ট্রপতি মবুতু সেসে সেকো হুতু বিদ্রোহীদের সমর্থন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালে রুয়ান্ডা হুতু বিদ্রোহীদের দমনের উদ্দেশ্যে জায়ারেতে আক্রমণ চালায় এবং প্রথম কঙ্গো যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্র এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং জায়ারেতে মবুতুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেয়। অবশেষে ১৯৯৭ সালে মবুতুর পতন ঘটে।

অর্থাৎ, রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে আরপিএফ/তুতসিদের বিজয়ের ফলে ক্ষুদ্র রুয়ান্ডা তো বটেই, এর পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী বৃহৎ জায়ারেও ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ক্রমশ অ্যাংলোফোন বিশ্বের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে আফ্রিকার এই অঞ্চলে ফ্রান্সের প্রভাব উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। স্বভাবতই ফ্রান্সের ‘লা ফ্রাঙ্কোফোনি’ ধারণার জন্য এটি ছিল একটি বড় ধরনের ধাক্কাস্বরূপ।

মানচিত্রে ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় প্রতিষ্ঠিত ফরাসি–নিয়ন্ত্রিত ‘তুর্কোয়া জোন’; Source: Wikimedia Commons

গণহত্যার দায়: ফ্রান্স ও রুয়ান্ডার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

যুদ্ধের পর ফ্রান্স রুয়ান্ডান গণহত্যায় তাদের ভূমিকার কথাকে অস্বীকার করেছে এবং নিজেদের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেছে। ১৯৯৮ সালে ফরাসি আইনসভা কর্তৃক গঠিত রুয়ান্ডা সংক্রান্ত কমিশন এবং ২০২১ সালে ফরাসি রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল মাক্রোঁ কর্তৃক গঠিত রুয়ান্ডা সংক্রান্ত কমিশন উভয়েই দাবি করেছে যে, রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যার ক্ষেত্রে ফ্রান্স কিছু ‘ভুল’ করেছে, কিন্তু রুয়ান্ডান গণহত্যার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অবশ্য ২০২১ সালে মাক্রোঁ কর্তৃক গঠিত কমিশনের প্রতিবেদনে এটি স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে, রুয়ান্ডান গণহত্যার প্রতি ফ্রান্স ‘অন্ধ’ ছিল, অর্থাৎ ফ্রান্স এই গণহত্যাকে দেখেও না দেখার অভিনয় করেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে, ফরাসি সরকার স্পষ্টভাবে রুয়ান্ডান গণহত্যার দায় স্বীকার থেকে বিরত থেকেছে।

উল্টো ২০০৬ সালে ফ্রান্সের একটি সন্ত্রাসবাদবিরোধী আদালত ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডান রাষ্ট্রপতি হাবিয়ারিমানাকে হত্যার জন্য আরপিএফকে এবং রুয়ান্ডার বর্তমান রাষ্ট্রপতি পল কাগামেকে দায়ী করেছে, যদিও এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী, আরপিএফ নয়, হুতু মিলিট্যান্টরা এই খুনের জন্য দায়ী ছিল। কিন্তু হাবিয়ারিমানার খুনের মধ্য দিয়েই যেহেতু রুয়ান্ডান গণহত্যা আরম্ভ হয়েছিল, তাই এই খুনের দায় আরপিএফ তথা রুয়ান্ডার বর্তমান সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ফ্রান্স কার্যত রুয়ান্ডান গণহত্যার দায় তুতসিদের ওপরেই চাপিয়ে দিতে চায়। সেক্ষেত্রে ফ্রান্স নিজে এই গণহত্যার দায় থেকে পুরোপুরি অব্যাহতি পাবে।

কিন্তু এই ঘটনাটি ফরাসি–রুয়ান্ডান সম্পর্কে নতুন তিক্ততার সৃষ্টি করেছিল। ফরাসি আদালতের এই রায়ের পর রুয়ান্ডান সরকার রুয়ান্ডা থেকে ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছিল, ফরাসি স্কুল ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছিল এবং রুয়ান্ডায় ফরাসি রেডিওর সম্প্রচার বন্ধ করেছিল। পরবর্তীতে অবশ্য রাষ্ট্র দুটির মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত ফ্রান্স ও রুয়ান্ডার মধ্যবর্তী সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।

অন্যদিকে, গৃহযুদ্ধের পর আরপিএফ–নিয়ন্ত্রিত রুয়ান্ডান সরকারও কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে এবং এই কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে রুয়ান্ডান গণহত্যায় ফ্রান্সের ভূমিকা বিস্তৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ২০২১ সালের এপ্রিলে রুয়ান্ডান সরকার এই সংক্রান্ত ৬০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এবং উক্ত প্রতিবেদনে রুয়ান্ডান গণহত্যার জন্য ফ্রান্স ‘বহুলাংশে দায়ী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফ্রান্স চাইলে ১৯৯৪ সালের গণহত্যা রোধ করতে পারত, কিন্তু তারা সেটা করা থেকে বিরত ছিল এবং উল্টো এ সময় রুয়ান্ডান হুতু–নিয়ন্ত্রিত সরকারকে নানা ধরনের সহায়তা প্রদান করে কার্যত তারা গণহত্যা পরিচালনার জন্য রুয়ান্ডান সরকারকে সমর্থ করে তুলেছিল।

গণহত্যা–পরবর্তী ফরাসি–রুয়ান্ডান সম্পর্ক

কার্যত রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে ফ্রান্সের ভূমিকা যুদ্ধোত্তর সময়ে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি করেছে। বেশ কয়েকবার ফ্রান্স ও রুয়ান্ডার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। বহু রুয়ান্ডান উক্ত গণহত্যায় ফ্রান্সের ভূমিকার জন্য তাদের ওপর ক্ষিপ্ত এবং রুয়ান্ডায় ফরাসি প্রভাব সীমিত রাখতে আগ্রহী। গৃহযুদ্ধ শেষে রুয়ান্ডান সরকার সক্রিয়ভাবে রুয়ান্ডাকে ফরাসি প্রভাব বলয় থেকে দূরে সরিয়ে নিতে শুরু করে। এর অংশ হিসেবে রুয়ান্ডা ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং ইংরেজিকে একটি সরকারি ভাষা ঘোষণা করে। এমনকি রুয়ান্ডা ব্রিটিশ–নেতৃত্বাধীন ‘কমনওয়েলথ অফ ন্যাশন্স’–এ যোগদান করেছে, যদিও রুয়ান্ডা কখনো ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল না।

১৯৯৪ সালের আগস্টে আরপিএফ নেতা (ও রুয়ান্ডার বর্তমান রাষ্ট্রপতি) পল কাগামে (বামে) এবং মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী উইলিয়াম পেরি (ডানে)। কাগামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন; Source: Wikimedia Commons

ফরাসি সাংস্কৃতিক প্রভাব প্রতিহত করার জন্য রুয়ান্ডান সরকার দেশটিতে সক্রিয়ভাবে ইংরেজি ভাষার চর্চাকে উৎসাহিত করেছে। রুয়ান্ডান রাষ্ট্রপতি কাগামে মন্তব্য করেছিলেন যে, তিনি ফরাসি ভাষা শিখতে আগ্রহী নন। বর্তমানে রুয়ান্ডান সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ফরাসি ভাষাকে বিবেচনা করে ‘মৃত্যুর ভাষা’ হিসেবে, যে ভাষাটির ব্যবহারকারীরা রুয়ান্ডায় ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। অন্যদিকে, ইংরেজি ভাষাকে তারা বিবেচনা করছে ‘প্রতিরোধের ভাষা’ হিসেবে, কারণ ইংরেজিভাষী তুতসিরাই গণহত্যা মোকাবিলা করতে সমর্থ রয়েছে। তদুপরি, দেশটিতে অ্যাংলোফোন প্রভাব জোরদার করার জন্য রুয়ান্ডান সরকার ক্রিকেট খেলার ব্যাপক প্রচলন ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছে এবং একটি ক্রিকেট বোর্ড গঠন করেছে। শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে আফ্রিকায় চলমান তুর্কি–ফরাসি ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে রুয়ান্ডান সরকার দেশটিতে প্রথমবারের মতো তুর্কি ভাষার কোর্সও চালু করেছে।

অনুরূপভাবে, গৃহযুদ্ধোত্তর সময়ে ফ্রান্সও বিভিন্ন ক্ষেত্রে রুয়ান্ডার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আচরণ করেছে। বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে রুয়ান্ডার উন্নয়নের জন্য সহায়তা লাভের প্রচেষ্টায় তারা বাধা প্রদান করেছে। আরপিএফ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে রুয়ান্ডা সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক সহায়তা লাভ করত ফ্রান্সের কাছ থেকে। কিন্তু আরপিএফ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর রুয়ান্ডা বিদেশি শক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম সহায়তা লাভ করেছে ফ্রান্সের কাছ থেকে। সব মিলিয়ে ফ্রান্স এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, রুয়ান্ডায় আরপিএফের উত্থানে তারা মোটেই সন্তুষ্ট নয়।

সামগ্রিকভাবে, রুয়ান্ডা ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় ফ্রান্স রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে হুতু–নিয়ন্ত্রিত রুয়ান্ডান সরকারকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করে এবং তুতসিবিরোধী গণহত্যা রোধের পরিবর্তে গণহত্যাকারীদের সহায়তা প্রদান করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের আশঙ্কাই বাস্তবে পরিণত হয়। রুয়ান্ডা নিজে তো ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়ই, পার্শ্ববর্তী জায়ারেকে ফ্রাঙ্কোফোন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ, রুয়ান্ডান গণহত্যাকে সমর্থন করে ফ্রান্সের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থোদ্ধার হয় নি, উল্টো এর মধ্য দিয়ে তাদের ইতিহাসে একটি নেতিবাচক অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে।

এক্ষেত্রে ফ্রান্স যদি রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধের সময় বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করত, সেক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ রক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বেশি। যদি তারা রুয়ান্ডার তদানীন্তন সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আরপিএফের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে বাধ্য করত, সেক্ষেত্রে রুয়ান্ডায় হুতু–নিয়ন্ত্রিত একটি সরকারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সম্ভাবনা বেশি হতো এবং রুয়ান্ডায় ফ্রান্সের প্রভাব বজায় থাকত। কিংবা ফ্রান্স যদি রুয়ান্ডান গৃহযুদ্ধে পূর্ণ নিরপেক্ষতা অবলম্বন করত এবং রুয়ান্ডান গণহত্যা রোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখত, সেক্ষেত্রেও গৃহযুদ্ধের পর তারা রুয়ান্ডার নতুন তুতসি–নিয়ন্ত্রিত সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হতো। কিন্তু বর্ণবাদী মানসিকতা ও অ্যাংলোফোন তুতসি জনগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র বিদ্বেষ থেকে ফ্রান্স রুয়ান্ডান গণহত্যাকে মৌন সমর্থন প্রদান করে, এবং ফলশ্রুতিতে রুয়ান্ডা স্থায়ীভাবে তাদের ‘হাতছাড়া’ হয়ে যায়।

Related Articles