Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অভাবনীয় এক কোর্ট মার্শাল: যে বিচারের রায় নাড়িয়ে দিয়েছিল ফরাসি সমাজকে

সামরিক কর্তৃপক্ষের ষড়যন্ত্রে দোষী সাব্যস্ত হলেন আর্টিলারি অফিসার আলফ্রেড দ্রেফুজ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি জার্মান সেনাদের কাছে সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ নথি পাচার করেছেন। কিন্তু বিচারিক আদালতে দ্রেফুজ সবসময় বলে গেছেন, তিনি নির্দোষ। আসলে কী ঘটেছিল? কেনই বা তাকে সাজা পেতে হয়েছিল? কীভাবে উন্মোচিত হয়েছিল সেসময়ের ফ্রান্সের বিচার ব্যবস্থার এক কুৎসিত রূপ। সেসব অজানা কাহিনী নিয়ে আজকের এই লেখা।

ক্যাপ্টেন আলফ্রেড দ্রেফুজ। ফরাসি সেনাবহিনীতে কর্মরত একজন আর্টিলারি অফিসার। এক উদ্ধত অফিসার। মানুষটি ধর্মে ইহুদি। ইহুদি বিরোধী ফরাসি সেনাবাহিনীতে যাদের যোগদান ছিল নিতান্তই নগন্য। সামান্য যে কয়জন ইহুদি সেনাবহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে পদমর্যাদায় ও সাহসীকতায় দ্রেফুজই ছিলেন অন্যতম। আর সেকারণে ইহুদি বিদ্বেষী সেনা অফিসারদের প্রতিহিংসার শিকার হন দ্রেফুজ।

ক্যাপ্টেন আলফ্রেড দ্রেফুজ; Source: cojs.org

১৮৯৪ সালের ২০ জুলাই ফার্ডিনান্দ এসথারজে নামের এক ফরাসি মেজর প্যারিসে অবস্থানরত জার্মান মিলিটারি অ্যাটাশের কাছে একটি গোপন চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে তিনি জানান, বার্লিনে তিনি গোপনে ফরাসি সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ ও অন্যান্য বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সব নথিপত্র পাঠিয়ে দেবেন। বলা বাহুল্য, সেই চিঠিতে কোনো স্বাক্ষর ছিল না। অস্বাক্ষরিত সেই চিঠিটি জার্মানদের কাছে না পড়ে ফরাসিদের হাতে ধরা পড়ে যায়। ফলে ফরাসি সেনাবাহিনীতে এই চিঠি নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে যায়।

এই ঘটনার কিছুদিন পরেই ফ্রান্সের গোয়েন্দা বিভাগ প্যারিসের ইতালিয়ান মিলিটারি অ্যাটাশের পাঠানো এক সাঙ্কেতিক চিঠি ধরে ফেলে। ফরাসি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার সম্পর্কে সাবধান থাকতে বলা হয় সেই চিঠিতে। চিঠিতে জানানো হয়, অফিসারের নামের আদ্যক্ষর ইংরেজিতে ‘ডি’। এই সূত্রটুকু পেয়েই ফরাসি গুপ্তচর এবং বিভিন্ন বিভাগের এজেন্টরা তড়িৎগতিতে কাজে নেমে পড়ে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে সেনাবাহিনীতে কর্মরত বিভিন্ন অফিসারদের ব্যক্তিগত নথিপত্র। সেনাবাহিনীর প্রতিটি অফিসারের ব্যক্তিগত ফাইলই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খুঁটিয়ে দেখা হতে লাগলো। অবশেষে ডি আদ্যক্ষরে পাওয়া গেল সেই নাম।

এতদিন ধরে এই নামটাই খোঁজার চেষ্টা হচ্ছিল। আর তার মধ্য দিয়ে সবার মুখে যেন জয়ের হাসি ফুটে উঠলো। ষড়যন্ত্রকারী, তিনি আর কেউ নন ক্যাপ্টেন আলফ্রেড দ্রেফুজ। সেই গোপন চিঠির হাতের লেখার সঙ্গে এবার দ্রেফুজের হাতের লেখা মিলিয়ে দেখা হলো। চিঠির লেখা সাথে দ্রেফুজের হাতের লেখার পুরো মিল পাওয়া না গেলেও সামান্য কিছু মিল আছে, এই যথেষ্ট। কালবিলম্ব না করে দ্রেফুজকে সঙ্গে-সঙ্গে গ্রেফতার করা হলো। দ্রেফুজ বারবার নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করলেও কেউই তার কথায় কোনো সাড়া দিল না। তার পক্ষে এগিয়ে এলো না কোনো অফিসার। তড়িঘড়ি করে দ্রেফুজের বিচার শুরু হলো।

১৮৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি বন্ধ ঘরে সাতজন বিচারকের সামনে শুরু হলো আলফ্রেড দ্রেফুজের কোর্ট-মার্শাল। দ্রেফুজকে দোষী প্রমাণ করার জন্য যোগাড় করা হলো জাল সাক্ষ্য প্রমাণ। এসব জাল সাক্ষ্য প্রমাণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন বিচারকরাও। শেষ অবধি বিচারকরা একমত হলেন। দেওয়া হলো গুপ্তচরবৃত্তির শাস্তি।

দেশের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে শুরু হয় আলফ্রেড দ্রেফুজের কোর্ট মার্শাল; Source: franceculture.fr

বিচারকরা দ্রেফুজকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। তাকে যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি দেয়া হলো। প্রকাশ্যে দ্রেফুজের সামরিক পোশাক খুলে নেওয়া হলো। সঙ্গে কেড়ে নেয়া হলো সামরিক বাহিনীতে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাওয়া সব সামরিক পদক। সেনারা তার তলোয়ার ভেঙে ফেললো। তার অধস্তন সৈন্যদের সামনে দ্রেফুজকে কয়েক মাইল দৌড়াতে হলো। দৌড়ানোর সময় সৈন্যরা ইচ্ছেমতো তাকে প্রহার করতে থাকে এবং যথেচ্ছভাবে গালিগালাজ করতে থাকে। তার একদা সহকর্মী অফিসাররা তখন তার গায়ে থুথু নিক্ষেপ করতে থাকে। এরপর জাহাজে করে দ্রেফুজকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো দ্বীপান্তরে। সেই কুখ্যাত ‘শয়তানের দ্বীপ’ বা ‘ডেভিলস আইল্যান্ড’-এ। ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত এই বিচারের রায় নিয়ে তেমন কাউকে সরব হতে দেখা যায় না।

দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর সৈন্যরা দ্রেফুজের তলোয়ার কেড়ে নেয় এবং তা ভেঙে ফেলা হয়; Source: menachemwecker.com

দ্রেফুজ যখন এভাবে কারাগারে বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন, তখনই সেনাবাহিনীর হাতে এলো আসল তথ্য। এসব তথ্য প্রমাণ বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নথি পাচারের প্রকৃত দোষী ফরাসি সেনাধ্যক্ষ এসথারজে। প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণ থেকে এসথারজেকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেনা বিভাগের ভিতরেও এসথারজের নিজস্ব লোক ছিল। এসথারজের পক্ষের এসব সেনা অফিসারদের বক্তব্য ছিল, যে সিদ্ধান্ত একবার নেওয়া হয়ে গেছে তা নিয়ে আবার নতুন বিচারে বসানোর কোনো অর্থ নেই। তাই তারা নতুন করে বিচার বসানোর ব্যাপারে বাধা দিতে লাগলো। কিন্তু পানি তখন অনেক দূর গড়িয়েছে।

শেষ অবধি প্রবল জনমতের চাপে পড়ে সরকার এবং ফ্রান্সের সেনা বিভাগ এসথারজের বিচার শুরু করতে রাজি হলো। ১৮৯৮ সালের জানুয়ারি  মাসে একই বিষয় নিয়ে আবার কোর্ট মার্শাল শুরু হলো। কিন্তু তাতে বিচারের রায়ে কি কোনো পরিবর্তন এলো? আদতে তেমন কিছুই ঘটলো না। বিচারের বাণী যেন নিরবে নিভৃতে শোক প্রকাশে ব্যস্ত রইলো। বিচারকরা নতুন প্রাপ্ত নথিপত্র আমলে না নিয়ে এক ঘন্টার মধ্যেই বেকসুর খালাস করে দিলেন মেজর ফার্ডিনান্দ এসথারজেকে।

মেজর ফার্ডিনান্দ এসথারজ; Source: wikimedia commons

ঘটনা এখানেই স্তিমিত হয় যেতো, ফরাসি জনগণ আর পাঁচটা বিচারের মতো এটিও হয়তো ভুলে যেতো যদি না সাহিত্যিক এমিল জোলা এই রায় নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করতেন। মূলত তার হস্তক্ষেপের কারণে কাহিনীটি নাটকীয়ভাবে অন্য মোড় নিল। সরকারকে খোঁচা দিয়ে মানহানির এমন একটা মামলায় নামতে সরকারকে বাধ্য করলেন জোলা, যাতে দ্রেফুজের বিচার আবার নতুন করে শুরু হয়। জোলা ‘লা অরোরে’ পত্রিকায় ফরাসি প্রেসিডেন্টকে রীতিমতো একটা খোঁচা-মারা চিঠি প্রকাশ করলেন। ‘অপরাধী’ শিরোনামে, বড়-বড় অক্ষরে চিঠিটি ছাপাও হলো। যেদিন পত্রিকায় লেখাটি ছাপা হয় সেদিন পত্রিকাটির প্রায় ২ লক্ষ কপি বিক্রি হয়।

ফরাসি সাহিত্যিক এমিল জোলা; Source: Science Source

এই ঘটনার এক মাস পর ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধানকে বিদ্রুপ করার কারণে জোলার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হয়। রায়ে জেল দন্ড দেয়া হলে জোলা ফ্রান্স থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন। কিন্তু এর মধ্যেই জোলার চিঠির প্রভাব হল ব্যাপক। সমাজের এক শ্রেণী: সরকারের সাথে ঘনিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা, ক্যাথলিক চার্চের ধর্মগুরু থেকে শুরু সমাজের পৃষ্ঠপোষকরা সেনাবাহিনীর পক্ষে সমর্থন দিতে থাকে। আবার অপরদিকে, সমাজতন্ত্রী ও উদারপন্থী লোকজন ও বুদ্ধিজীবীরা দ্রেফুজের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন। ফলে সরকার নতুন করে দ্রেফুজের মামলা শুরু করতে বাধ্য হলো। ডেভিলস আইল্যান্ড থেকে ফিরিয়ে আনা হলো দ্রেফুজকে। তার সেই শক্তপোক্ত, গর্বোদ্ধত চেহারা তখন আর নেই। চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে, শরীর প্রায় কঙ্কালসারে পরিণত হয়েছে।

১৮৯৯ সালে দ্রেফুজের দ্বিতীয়বার কোর্ট মার্শাল শুরু হলো। সামরিক আদালতে বিচার। এবার নিশ্চয় তিনি সাজানো অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবেন। হতচকিত হওয়ার তখনও কিছু বাকি ছিল। সেনাবাহিনীর মেজর হুবার্ট হেনরী স্বীকার করেন যে, দ্রেফুজের বিরুদ্ধে যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ সাজানো হয়েছে সব জাল। এরপর এসথারজেকে সাক্ষ্য দিতে বলা হলে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তারপরেও দ্রেফুজ আবার দোষী সাব্যস্ত হলেন। এবারের বিচারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দশ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়।

দ্বিতীয়বার কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি আলফ্রেড দ্রেফুজ; Source: traitsdejustice.bpi.fr

এর পর দশদিনের মধ্যে ফরাসি সরকার বুঝতে পারলো যে, তাদের বিচার ব্যবস্থা এখন সারা পৃথিবীর কাছে এক উপহাসের বস্তু। দ্রেফুজকে তারা ক্ষমা করে দিলেন। ১৯০৬ সালে, দ্রেফুজের ঘটনা নিয়ে আবেগ যখন আস্তে আস্তে থিতিয়ে পড়তে শুরু করেছে, কর্তৃপক্ষ দ্রেফুজকে দোষীর অভিযোগ থেকে মুক্তি দিলেন। দ্রেফুজকে মেজর পদে উন্নীত করে আবার সেনাবিভাগে নেওয়া হলো। পরবর্তীকালে তাকে লিজিয়ন অব অনার পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল। আর এই ঘটনার পর থেকে ফরাসি শাসন ব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব খর্ব করা হয়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ফরাসি বিচার ও শাসন ব্যবস্থায় সেনাবাহিনী এবং চার্চের প্রভাব আস্তে আস্তে হ্রাস পেতে থাকে।

ফিচার ইমেজ: traitsdejustice.bpi.fr

Related Articles