সময়টা ১৯২৪ সালের বসন্ত। উত্তর জার্মানির ছিমছাম শান্ত শহর হ্যানোভারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার রেশ কাটতে না কাটতেই পুরো শহরজুড়ে জেঁকে বসে অন্য এক আতঙ্ক। এ আতঙ্ক কোনো যুদ্ধের নয়, কিন্তু যুদ্ধের পাশবিকতার চেয়েও অনেক বেশি নির্মমতার। শহর থেকে হারিয়ে যেতে থাকল কমবয়সী ছেলেদের দল, নদীর পাড় থেকে উদ্ধার করা হলো সারি সারি মাথার খুলি। বাজার থেকে কিনে আনা মাংসের উপর সন্দেহ পড়তেই দলবেঁধে গৃহিণীরা মাংস নিয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হতে শুরু করলেন। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগল এক নেকড়েমানবের গল্প।
কর্মব্যস্ত নাগরিক থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অসংলগ্ন কথা বলা ক্ষ্যাপাটে যুবক থেকে শিশুদের দল- সবাই তখন এই নেকড়েমানবের ভয়ে তটস্থ। কিন্তু শহরের কর্তৃপক্ষ এই নেকড়েমানবের কথা কানেই তুলছিলেন না। তারা এই নেকড়েমানবের গল্পকে স্রেফ 'ম্যাস হিস্টিরিয়া' (Mass Hysteria) বলে উড়িয়ে দেন। এমনকি ১৭ মে'তে যখন লিন নদীর তীরে বাচ্চারা অনেকগুলো মাথার খুলি আবিষ্কার করে তখনও এ ঘটনাকে মেডিকেল ছাত্রদের কারসাজি বলে উড়িয়ে দেয়া হয়। ঈশপের গল্পের মতো অলৌকিক কোনো নেকড়েমানব না থাকলেও একজন লৌকিক নেকড়েমানব সত্যিই ছিল সেসময়। তার নাম ফ্রিটজ হারম্যান, যার বিরুদ্ধে কমবয়সী ছেলেদের ধর্ষণ করা থেকে শুরু করে তাদের মাংস বিক্রি করাসহ বহু অভিযোগ ছিল, এবং সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে ।
ফ্রিটজ ছিল একজন জার্মান সিরিয়াল কিলার। নেকেড়েমানব ছাড়াও 'হ্যানোভারের কসাই' ও 'হ্যানোভারের ভ্যাম্পায়ার' নামেও সে মানুষের কাছে পরিচিত। ফ্রিটজ হারম্যান একাই এসব কাজ করতো না। এ কাজে তার সহযোগী হিসেবে ছিল হ্যান্স গ্র্যান্স, যে ফ্রিটজকে আরো বেশি খুন করতে উৎসাহিত করতো। কিন্তু হ্যান্সের কথা পরেই হবে। মূল হোতা ফ্রিটজ হারম্যানের দিকেই বরং নজর দেয়া যাক প্রথমে।
ফ্রিটজের জন্ম ১৮৭৯ সালের ২৫ অক্টোবর, জার্মানির হ্যানোভারে। ফ্রিটজ হিসেবে পরিচিতি পেলেও তার পুরো নাম ফ্রেডরিখ হেইনরিখ কার্ল হারম্যান। ফ্রিটজকে জন্ম দেয়ার পর তার মা সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে পড়েন। ফ্রিটজ তার মাকে ভীষণ ভালবাসত, আর ঠিক ততটাই ঘৃণা করত বাবাকে। বাবার প্রতি ফ্রিটজের ঘৃণা আরো তীব্র হয়ে ওঠে যখন ছোটবেলায় তার বাবা তাকে পাগলা গারদে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু চিকিৎসকেরা তাকে পাগলাগারদে রাখতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের ভাষ্যমতে, ফ্রিটজ রগচটা হলেও পাগল নয়।
ফ্রিটজ তার সারাজীবন কাটিয়েছে ভবঘুরে ফেরিওয়ালা হিসেবে। বড় হয়ে উপার্জনের তাগিদে শহরের পর শহরে ঘুরে বেড়াত। শহরের পুলিশ আর অপরাধীরা তাকে ভালমতোই চিনত ও জানত। অপরাধীরা চিনত কারণ তাদের সাথে ফ্রিটজ খুব দয়ালু আচরণ করত এবং তার চেয়ে গরীবদের সে বিভিন্নভাবে সাহায্য করত। আর পুলিশেরা তাকে পছন্দ করত কারণ পুলিশদের সাথে সে ভালো আচরণ তো করতোই, পাশাপাশি কারাগারের সমস্ত নিয়ম-কানুন ঠিকমতো মেনে চলত। কিন্তু পুলিশের তাকে পছন্দ করার আরও একটা কারণ ছিল। বিভিন্ন অপরাধীচক্রের সাথে তার গোপন আঁতাত থাকায় সে পুলিশকে সেসব চক্রের অনেক গোপন সংবাদ এনে দিত। অর্থাৎ একসময় ফ্রিটজ হয়ে ওঠে পুলিশের 'ইনফর্মার'।
রেলস্টেশনে তখন প্রচুর শরণার্থীর ভীড়। আশ্রয়হীন নিঃস্ব মানুষেরা দলে দলে এসে আশ্রয় নিয়েছে এই স্টেশনে। তাদের খাবারের অভাব, থাকার জায়গার অভাব, বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি দিন লড়তে হয় তাদের। এসব মানুষের ভীড়ে অনেক কমবয়সী ছেলেরাও ছিল। এদের কেউ এখানে এসেছে বাবা-মায়ের সাথে, কেউ এসেছে বাড়ি থেকে পালিয়ে। ফ্রিটজ জানত এসব ছেলেদের কী করে হাত করতে হয়। ফ্রিটজ তাদের দুঃখের কথা শুনত মন দিয়ে। কখনও তাদেরকে ভালো পরামর্শ দিয়ে, কখনও লোভ দেখিয়ে তাদের মন জয় করে নিত। সেসব ছেলেদের, যারা এই অগুনতি নিঃস্ব মানুষের দল থেকে হারিয়ে গেলে কখনও কেউ তাদের খোঁজ নিতে আসবে না।
এসব ছেলেদের সে চকলেট, সিগারেট ও খাবার দিত। এমনকি তাদের কখনও একবেলা খাবার আর একটা ভালো জায়গায় ঘুমাতে দেয়ার লোভ দেখিয়ে তার কাছে নিয়ে আসত। এসব হতভাগা ছেলেদের উপর সে অমানুষিক নির্যাতন চালাত ও তাদেরকে ধর্ষণ করত। এরপর তাদের গলা কামড়ে তাদেরকে হত্যা করত। কিন্তু না, এখানেই শেষ না। মৃতদেহগুলোর চামড়া ছিলে মাংস টুকরো টুকরো করে সেগুলোও বিক্রি করত এই নরপিশাচ। আর মাথার খুলি ও হাড়গোড় ফেলে দিত লিন নদীতে। পরবর্তীতে লিন নদীর পাড় থেকে উদ্ধার করা খুলি ও হাড় থেকেই লোকের মুখে মুখে নেকড়েমানবের গল্প ছড়িয়ে পড়ে।
১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রিটজের পরিচয় হয় হ্যান্স গ্র্যান্স নামের বিশ বছর বয়েসী এক ছেলের সাথে। হ্যান্স নিজেও বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল। এই সুদর্শন ছেলেটিকে ফ্রিটজ তার সহযোগী করে নেয় এবং পূর্ণোদ্যমে তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। আগের চেয়ে তার খুন করার পরিমাণও বেড়ে যায়।
পত্রিকাগুলো হ্যানোভারে এসে বাচ্চাদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে সংবাদ প্রচার করতে শুরু করে। এক পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় যে, নিখোঁজের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ছয়শোতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, ১৯২৪ সালের ১৭ মে লিন নদীর তীর থেকে সারি সারি মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়। ২৯ মে'তে পাওয়া যায় আরও একটি খুলি। ১৩ জুন পাওয়া যায় আরো ছয়টি।
২৪ জুলাই মাঠে খেলার সময় কিছু ছেলে একটি বস্তায় বেশ কিছু দেহাবশেষ পায়। পরে সেখান থেকে প্রায় ৫০০ হাড় উদ্ধার করা হয়। পুলিশের ভাষ্যমতে, গ্রেপ্তারের আগের ষোল মাসে ফ্রিটজ ও হ্যান্স সপ্তাহে অন্তত দুটি করে খুন করত। এত সংখ্যার উপস্থাপন শেষেও একটি খটকা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। লোকচক্ষুর সামনেই অবাধ চলাচল করেও, লিন নদীর খুব কাছেই বসবাস করেও এতদিন ফ্রিটজ কী করে ফাঁকি দিচ্ছিল পুলিশের চোখকে?
কী করে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিচ্ছিল ফ্রিটজ?
পুলিশের সাথে সখ্য
পুলিশের কাছে ফ্রিটজ ছিল একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ। বিভিন্ন অপরাধীচক্রের সঠিক খবর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সংগ্রহ করে দিত সে। অপরাধজগতের এসব খবর সংগ্রহ করে দেয়ায় সবার মুখে মুখে তার নতুন উপাধি হয়ে দাঁড়ায় 'গোয়েন্দা'। ১৯২৩ সালে সে নিজেকে পুলিশের কাছে অপরিহার্য করে তোলে। পরবর্তীতে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সে একটি বড়সড় গোয়েন্দা সংস্থা খুলে বসে। অনেক নিখোঁজ ছেলের বাবা-মা তাদের ছেলেকে শেষবারের মতো 'গোয়েন্দা'র সাথেই দেখেছিল। সেসব বাবা-মাকে ফ্রিটজের ঘরে নিয়ে আসলেও কোনো প্রমাণ পাওয়া যেত না। পুলিশও তাদের আস্থাভাজন ফ্রিটজকে খুব একটা ঘাঁটাত না।
ফ্রিটজের ব্যবসা
হ্যানোভারে ফিরে এসে ফ্রিটজ নতুন ব্যবসা শুরু করে। ব্যবহৃত কাপড় ও মাংস বিক্রি করাই ছিল তার কাজ। পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে কম দামে জিনিস কিনে এসে বিক্রি করত সে। শহরের মানুষরাও কিছুদিনের মধ্যে জেনে গেল যে ফ্রিটজের কাছে কম দামে ভাল জিনিস পাওয়া যায়।
তবে হ্যাঁ, প্রথমে ভালো জিনিস বিক্রি করলেও পরে ফ্রিটজ মাংসের পরিবর্তে সেসব ছেলেদের মৃতদেহ বিক্রি করতে শুরু করে। কিন্তু কেউ তাকে সন্দেহ করে না। লিন নদীর তীরে তার এক প্রতিবেশী তার হাতে রক্তের বালতি দেখলে তাকে কিছুটা সন্দেহ করে এবং তার কাছে থেকে কেনা শুকরের মাংসকে পুলিশের কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠায়। কিন্তু সেখানেও সন্দেহজনক কিছু ছিল না। তার ঘরে রক্তের দাগ বা তার ঘর থেকে মাংস কাটার শব্দেও কেউ সন্দেহ করেনি। কেননা সে কসাই ছিল এবং মাংসের ব্যবসা করত। সুতরাং তার হাতে রক্তের বালতি থাকা কিংবা তার ঘর থেকে মাংস কাটার শব্দ আসাটা অস্বাভাবিক নয়।
ফ্রিটজ ১৯২৪ সালের ২২ জুন ফ্রোম নামের একটি ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইলে ছেলেটি প্রতিবাদ করে। একপর্যায়ে ছেলেটির সাথে তার মারামারি ও ধস্তাধস্তি হয়। এরপরই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যায়। তার বাড়ি তল্লাশি করে পুরনো কাপড়ের স্তূপ ও মাংস পাওয়া যায়। এবারেও ফ্রিটজ দাবি করে যে তার ঘর থেকে এসব পাওয়া অস্বাভাবিক নয়, কেননা সে একজন মাংস ও পুরনো কাপড় বিক্রেতা। কিন্তু এরই মাঝে কাপড়ের স্তূপ থেকে একজন মা তার ছেলের জামা খুঁজে পান। এরপরই পুলিশ তদন্তে নেমে পড়ে।
ডিসেম্বরের চার তারিখে ফ্রিটজ ও হ্যান্সকে সাতাশটি ১২-১৮ বছর বয়েসী ছেলেকে খুন করার দায়ে মামলার শুনানির জন্য আদালতে আনা হয়। ফ্রিটজকে জিজ্ঞেস করা হয়, "আজ পর্যন্ত তুমি কতজনকে খুন করেছ?" সে উত্তর দেয়, "ত্রিশ থেকে চল্লিশজন হতে পারে। আমার সঠিক সংখ্যাটি মনে পড়ছে না।" এরপর তাকে আরও জিজ্ঞেস করা হয়, "তুমি কীভাবে তোমার শিকারদের খুন করতে?" সে নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেয়, "আমি তাদেরকে গলায় কামড়ে মারতাম।"
বিচারকরা তার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। তার সহযোগী হ্যান্সের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। মৃত্যুর আগপর্যন্ত ফ্রিটজ তার বাবাকে অভিশাপ দিয়েছে। ১৯২৫ সালের ১৫ এপ্রিল শিরচ্ছেদের মাধ্যমে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ২৪-২৭ জনকে খুনের অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কিন্তু ফ্রিটজ হারম্যানের খুনের আসল সংখ্যা আজও কারও জানা নেই।
This Bengali article is about the famous German serial killer Fritz Haarmann.
Featured Image Source : murderpedia.org
References:
1. Book : The World's Most Infamous Murders by Nigel Blundell, Roger Boar
2. Murderpedia