Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সিলনের পরাধীনতা থেকে শ্রীলঙ্কার ‘নিদাহাস’: সাড়ে চারশ বছরের ইতিহাস

রক্তক্ষয়ী কোনো ইতিহাস নেই তাদের। আজ থেকে ৭০ বছর আগে ১৯৪৮ সালে এক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আরব সাগর আর ভারত মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত ৬৫ হাজার ৬১০ বর্গ কিলোমিটারের একটি স্বাধীন দ্বীপ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। ‘সিলন’ থেকে যার নাম হয়েছিল ‘শ্রীলঙ্কা’। দীর্ঘ সাড়ে চারশ বছরের পরাধীনতা পেরিয়ে সিংহলী ভাষায় ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দ ‘নিদাহাস’ তথা ‘স্বাধীনতা’ কীভাবে এলো এই দ্বীপদেশে, তা নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।

এই দ্বীপের প্রথম পর্তুগিজ শাসকগণ সেইলাও নামে ডাকতো সিলনকে। সেইলাও থেকে নাম হয় সিলন। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে ব্রিটিশরা। দীর্ঘদিন পর ১৯৪৮ সালে সিলন ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে এর নাম সিলন থেকে শ্রীলঙ্কায় পরিবর্তিত হয়।

লংকা‘ শব্দের অর্থ ‘দ্বীপ’। তার পূর্বে ‘শ্রী’ শব্দটি ‘মহান’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাচীন রামায়ণে দ্বীপ অর্থে লংকা শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যেখানে রাবণ সীতাকে চুরি করে লংকায় নিয়ে যায়। পরে রাম, বানর রাজার সহায়তায় সীতাকে রাবণের হাত থেকে উদ্ধার করে। মূলত সেই সূত্র ধরেই সিলনের নাম শ্রীলঙ্কা হয়।

রামায়ণ অনুসারে লংকায় রাম রাবণের যুদ্ধ ঘটে, যেখান থেকে শ্রীলঙ্কা নামের উদ্ভব; Source: theculturetrip.com

১৫০৫ সালে প্রথম পর্তুগিজ কমান্ডার লরেন্সো দে আলমেইদা’র আগমনের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। এক ঝড়ের কবলে পড়ে আলমেইদার জাহাজ তৎকালীন সিলনের দক্ষিণ পশ্চিমের উপকূলীয় শহর গ্যালেতে পাড়ি জমায়। দ্বীপটির বাণিজ্যিক ও কৌশলগত মূল্যবোধ দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে আরো অনেক পর্তুগিজ কমান্ডার তাদের বাহিনী নিয়ে সিলনে পাড়ি জমায়। ১৫১৮ সালে পর্তুগিজরা কলম্বোতে একটি দুর্গ নির্মাণের অনুমতি পায়। পাশাপাশি ব্যবসার সকল ধরনের সুযোগ সুবিধাও দেওয়া হয় তাদের। এমন সুযোগ ব্যবহার করেই তারা ধীরে ধীরে সিলনের ৩টি রাজ্যই নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। তখন সিলন ক্যান্ডি, সিত্তকা, কোটো, জাফিনা নামক চারটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল।

শ্রীলঙ্কায় পর্তুগিজদের তৈরি করা বিখ্যাত গ্যালে দুর্গ; Source: tayafinchonline.com

সিনহালির এক সেনা সদস্য কন্যাপু বন্দরার সহায়তায় পর্তুগিজরা ক্যান্ডি রাজ্যের দখল পায় ১৫৯১ সালে। ডন ফিলিপ নামে এক রাজ পরিবারের সন্তানকে ক্যান্ডির সিংহাসনে বসায় পর্তুগিজরা। কিন্তু ডনের অকস্মাৎ মৃত্যুর পর কন্যাপু বন্দরা নিজেকে ক্যান্ডির রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন। ক্যান্ডিই ছিল পর্তুগিজ ও ডাচ শাসনামলে সিলনের একমাত্র স্বাধীন রাজ্য। ১৬০২ সালে ডাচ কমান্ডার জরিস ভ্যান স্পিলবার্গেন তিনটি জাহাজ নিয়ে ক্যান্ডিতে আসেন। ক্যান্ডির রাজাকে একত্রে পর্তুগিজদের হটানোর আশ্বাস দিয়ে তিনি সিনহালা বাহিনীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৬৫৮ সালে সিলনে পর্তুগিজ আধিপত্যের অবসান ঘটে এবং ডাচরা সিলনকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নেয়।

প্রায় ৫০০ বছর আগের হারানো স্বাধীনতা ফিরে পেতে সিলনের তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের ২০০ বছরের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের সাথে তুলনা করলে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতা আন্দোলন অনেকাংশেই ছিল শান্তিপূর্ণ।

অর্থনৈতিক বিস্তার

১৬৫৮ সাল থেকে ইংরেজদের আগমনের আগপর্যন্ত ডাচদের সময়কালে সিলনে ব্যপক অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে। সিলনে উৎপাদিত দারুচিনি, পানপাতা, নানারকম শষ্য, বার্নিশ, নারিকেলের তেল, নারিকেলের ছোবরা দিয়ে বানানো দড়ি, বিভিন্ন সামুদ্রিক উপাদান দিয়ে তৈরি কপর্দ, শাঁখা ইত্যাদি রপ্তানী হতো বিশ্বের নানা প্রান্তে। বিভিন্ন ধরনের খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কাজ শুরু হয় ডাচদের সময়ে। এছাড়াও ব্যাপক হারে সমুদ্রের তলদেশ থেকে মূল্যবান পাথর উত্তোলন করা হতো।

তবে প্রযুক্তিগত অজ্ঞতার কারণে পাথর উত্তোলনের এই কাজটি ছিল বিপজ্জনক। কোনোরকম অক্সিজেনের সহায়তা ছাড়াই ডুবুরিরা গভীর তলদেশ থেকে মুক্তা উত্তোলন করতো। ডাচ শাসনামলে সিলনে বেকারত্ব কমে আসে।

শিল্পীর তুলিতে ডাচ শাসনামল; Source: lanka.com

হাতি রপ্তানী ছিল ডাচ অধ্যুষিত সিলনের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। দক্ষিণ ভারত ও বাংলা ছিল সিলনের হাতি রপ্তানির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। হাতির এত মূল্য থাকার প্রধান কারণ ছিল তৎকালীন রাজা-বাদশাহদের হাতি পালনের প্রতি ব্যপক আকর্ষণ। শখের বশে তৎকালীন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা একাধিক হাতি পালন করতেন। এ চাহিদা পূরণে সিলনের ব্যপক সমাদর ছিল তখন। আবার যুদ্ধক্ষেত্রেও হাতি অন্যতম বাহন, এমনকি যোদ্ধা হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। তাই উপমহাদেশে হাতির চাহিদা পূরণে সিলনের ভূমিকা অগ্রগণ্য ছিল।

বাণিজ্য ও কৃষির মধ্যে যে সংযোগটি এ সময়ের মধ্যে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছে, তা ঘটেছে কেবল তামাক এবং কফির বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার মাধমে। ডাচরা স্থানীয় জনগনদের ব্যাপক হারে তামাক ও কফি চাষে উৎসাহিত করত। জাফনা উপদ্বীপের তামাক দক্ষিণ ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় সুমাত্রায় প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হতো। এছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলীয় মালয় উপদ্বীপের বন্দরগুলো তামাকের মৌসুমে জমজমাট থাকত তামাক ক্রেতা-বিক্রেতায়। ১৮ শতকের প্রথমার্ধে সিলন জুড়ে কফি উৎপাদন তীব্রভাবে বিস্তার লাভ করে। এই দ্বীপের কফি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য সহ প্রতিবেশী উপমহাদেশের বাজারেও খুঁজে পাওয়া যেত।

ব্রিটিশদের কৌশলী আগমন

১৭৯২ থেকে ১৮০১ সাল পর্যন্ত চলমান ফরাসী বিপ্লবের সময় ব্রিটিশরা সিলনে প্রবেশ করে। শত চেষ্টা করেও ডাচ সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত সিলনে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে পারেনি। ১৭৯৬ সালে ইংরেজরা ডাচদের পুরোপুরি বিতাড়িত করে দেয়। সিলন থেকে ডাচদের বিতাড়িত করা ব্রিটিশদের জন্য সহজ কাজ ছিল না। কারণ তখন কলম্বোতে অবস্থান করছিল ডাচ গভর্নরের ভাড়া করা সুইস সৈন্যদের একটি বিশাল শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী। এক্ষেত্রে ব্রিটিশদের ধূর্ততা ছিল ভয়ানক। ব্রিটিশরা তাদের কৌশল ব্যবহার করে নিজেরা কোনোরকম যুদ্ধে লিপ্ত না হয়েই ডাচদের পরাভূত করে। এক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন, তিনি হলেন ৩৪ বছর বয়সী হিউজ ক্লেগহর্ন নামক একজন প্রফেসর।

হিউজ ক্লেগহর্ন, ব্রিটিশদের হয়ে ডাচদের ভাড়টে সৈনিকদের ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে সিলন থেকে ডাচদের উৎখাত করেছিলেন যিনি; Source: ed.ac.uk

যেহেতু সিলনে অবস্থানকারী সুইস সৈন্যরা শুধুমাত্র ডাচদের সাথে চুক্তির অধীনে ছিল, তাই ব্রিটিশরা কৌশলস্বরূপ সেই সুইস ভাড়াটে সৈন্যদের যিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন, চার্লস ডি মিউরন, তাকে ঘুষ হিসেবে ডাচদের চেয়েও বেশি টাকা দেওয়ার পরিকল্পনা করে। তাদের এই পরিকল্পনাকে সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করেন এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সেই প্রফেসর ক্লেগহর্ন। তিনি সুইজারল্যান্ডে একটি গোপন যাত্রা করেন এবং ডাচদের কাছ থেকে চার্লসের সৈন্য প্রত্যাহার করার জন্য তাকে ডাচদের চাইতেও বেশি অর্থ প্রদান করেন।

বার্তা পৌঁছানোর সাথে সাথে ১৭৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডাচরা বুঝে উঠার আগেই সুইজারল্যান্ডের সৈন্যদল তাদেরকে সিলনের মাটি হতে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয়। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা এই সাফল্যের জন্য ক্লেগহর্নকে ৫ হাজার পাউন্ড পুরষ্কার দিয়েছিল। এর মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে সিলনও যোগ হয় কোনোরকম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছাড়াই।

ব্রিটিশরা দ্রুত সিলনের সামাজিক প্রথার সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করে। তবে তারা সিলনের ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতিগুলো সংস্কার করতে অনিচ্ছুক ছিল। তারা দাসপ্রথা বিলোপ করে, কৃষিকাজে স্থানীয়দের উৎসাহিত করে, যা ডাচদের শাসনামলেও দেখা যায়। ব্রিটিশদের শাসনামলে সিলনে দারুচিনি, মরিচ, আখ, তুলা এবং কফির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো প্রসারিত হয়। জমির উপর ইউরোপীয় মালিকানার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়, এবং খ্রিস্টান মিশনারি কার্যকলাপ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।

স্বাধীনতার স্মৃতিস্বরূপ শ্রীলঙ্কা সরকার ইন্ডেপেন্ডেন্স স্কয়ার তৈরি করে ২০০৮ সালে; Source: culturaldept.gov.lk

স্বাধীনতা আন্দোলন

শ্রীলংকার স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন, যার লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে সিলনের স্বাধীনতা ও স্বশাসন অর্জন। আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালের ৪ই ফেব্রুয়ারি, এই দিনটিতে সিলন ব্রিটিশদের অধিরাজ্য হিসেবে স্বাধীনতা পায় এবং ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অধিরাজ্য হিসেবেই বজায় থাকে। ১৯৭২ সালের ২২ মে সিলন থেকে শ্রীলঙ্কা একটি নতুন প্রজাতন্ত্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা তোলে। আনন্দ, উৎসবের মধ্য দিয়ে ৭০ বছর ধরে ৪ ফেব্রুয়ারিকে শ্রীলঙ্কানরা নিজেদের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

যারা শ্রীলংকার স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন বলে মনে করা হয় তাদেরকে ‘ন্যাশনাল হিরো’ হিসাবে সম্মানিত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছেন ডন স্টিফেন সেনানায়েক, ফ্রেডরিক রিচার্ড, সেনানায়েক, স্যার জেমস পেরিস প্রমুখ।

ফিচার ইমেজ: channel4.com

Related Articles