Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য গুচ্চি মার্ডার: ইতালির অভিজাতপাড়ার এক কলঙ্কিত অধ্যায়

বিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড গুচ্চির (Gucci) কথা আমরা অনেকেই জানি। এই ব্র্যান্ডের যেসব পণ্যসামগ্রী বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলোর দাম আকাশছোঁয়া, চাইলেই যে কেউ সেগুলো কিনতে পারবে না। এই ব্র্যান্ডের ফ্যাশন সামগ্রীর দাম এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মানুষেরাই সেসব ব্যবহারের ক্ষমতা রাখে।

ব্র্যান্ডটির ইতিহাসের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে এটা উপলব্ধি করা যাবে যে- এই ফ্যাশন ব্র্যান্ড একদিনে তৈরি হয় নি। গুচ্চি পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মারিয়া গুচ্চি ইতালি থেকে ফ্রান্সে গিয়েছেন, সেখানে বিলাসবহুল স্যাভয় হোটেলে লাগেজ ওঠা-নামার কাজ করেছেন। এই কাজ করতে গিয়ে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর রুচি সম্পর্কে তার ধারণা হয়ে গিয়েছিল। তিনি এরপর তার মাতৃভূমি ইতালির ফ্লোরেন্সে এসে ফ্যাশন সামগ্রী তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবার শত্রুপক্ষের দেয়া নিষেধাজ্ঞায় দেউলিয়া হওয়ার শঙ্কা জেগেছিল। কিন্তু সব শঙ্কা উড়িয়ে গুচ্চি নিজের মতো করে এগিয়েছে।

Jgohpkv
বিশ্ববিখ্যাত গুচ্চি ফ্যাশন ব্র্যান্ডের লোগো; image source: inmylogo.com

মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রায় সত্তর বছর ধরে ফ্যাশন ব্র্যান্ড গুচ্চির মালিকানা ইতালির ফ্লোরেন্সে বিখ্যাত গুচ্চি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীতে সেই মালিকানা গুচ্চি পরিবারের বাইরে চলে যায়। সব ধরনের চড়াই-উৎরাই পেরোনোর পর যখন পুরো বিশ্বে নামকরা ফ্যাশন ব্র্যান্ড হিসেবে ‘গুচ্চি’ শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে যায়, তখনই এই ব্র্যান্ডের মালিকানায় পালাবদল ঘটে।

১৯৮০’র দশক থেকেই উত্তরাধিকার নিয়ে বেশ ঝামেলা শুরু হয়েছিল গুচ্চি পরিবারের মধ্যে। সেই ঝামেলা থেকেই একসময় গুচ্চি পরিবারের সদস্য হিসেবে ব্র্যান্ডের শেষ মালিক মরিজিও গুচ্চি অন্য উত্তরাধিকারদের সামলে ব্র্যান্ডের প্রধান কর্তাব্যক্তি হয়ে বসলেও শেষপর্যন্ত আইনি লড়াইয়ের ফলাফল হিসেবে তার ভাগের অংশ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। এভাবে গুচ্চি পরিবারের হাত থেকে তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও প্রায় সত্তর বছর ধরে নিয়ন্ত্রিত ফ্যাশন ব্র্যান্ডের মালিকানা চলে আসে বাহরাইনভিত্তিক বিনিয়োগকারী ব্যাংক ইনভেস্টকর্প-এর (Investcorp) হাতে। তবে এর বিনিময়ে মরিজিও গুচ্চি বিশাল অংকের অর্থ পান। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, মালিকানা ছেড়ে দেয়ার আঠারো মাসের মাথায় মরিজিও আততায়ীর হাতে খুন হন।

Jfjgigogog
মরিজিও গুচ্চি; image source: stylecaster.com

পুরো পৃথিবীতেই সমাজের অভিজাত, ধনী পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন পার্টিতে যাওয়া খুবই সাধারণ দৃশ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। ইতালির অভিজাত সমাজও এর বাইরে ছিল না। গুচ্চি পরিবারের ফ্যাশন ব্যবসা ইতালির গন্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক দেশে, তাই ইতালিতে তারা ছিল শীর্ষ ধনী ও সুখ্যাতি পাওয়া পরিবারগুলোর একটি। মরিজিও গুচ্চির বয়স যখন বিশ পার হয়েছে, তখন তিনি নিয়মিত বিভিন্ন পার্টিতে যেতেন, যেসব পার্টিতে ইতালির অন্যান্য অভিজাত পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি দেখা যেত। এরকমই একটি পার্টিতে যুবক মরিজিও গুচ্চি তার সমবয়সী এক নারীর রূপে বিমোহিত হন। তার পাশে থাকা এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, “লাল পোশাকের এই মেয়েটা কে, যাকে দেখতে একদম অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেইলরের মতো লাগছে?” প্রথমে পরিচয়, এরপর খুব দ্রুত প্রণয়ে রূপ নেয় তাদের সম্পর্ক। ১৯৭২ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, যদিও মরিজিও গুচ্চির বাবা এই বিয়ের বিরোধিতা করেন।

বিয়ের পর তারা ছিলেন বিশ্বের ফ্যাশন জগতের সবচেয়ে প্রভাবশালী দম্পতিগুলোর একটি। বিশ্বের তাবৎ ফ্যাশনবিষয়ক ম্যাগাজিনের প্রথম পাতায় তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন খবর ছাপা হতো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাদের দাম্পত্যজীবন স্থায়ী হয় মাত্র তের বছর। ১৯৭২ সালে বিয়ের পর ১৯৮৫ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কিন্তু আদালতে লড়াই চলে আরও এক দশকের মতো। এক সাক্ষাৎকারে প্যাট্রিজিয়া রেগিয়ানি বলেন, তার স্বামী মরিজিও গুচ্চি হুট করেই বাসা থেকে চলে যান। কারণ হিসেবে গুচ্চি বলেন, তিনি ব্যবসায়িক কারণে সংক্ষিপ্ত সফরে ফ্লোরেন্সে যাচ্ছেন। কিন্তু এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। কিছুদিন যাওয়ার পর প্যাট্রিজিয়া রেগিয়ানি তাদের পারিবারিক চিকিৎসকের কাছ থেকে জানতে পারেন, মরিজিও তার সাথে বিচ্ছেদ ঘটাতে চান। আরেক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ১৯৮৩ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর মরিজিও একেবারে বদলে যান, সবকিছুর প্রতি তার নিরাসক্তিভাব দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করে।

১৯৮৩ সালে বাবা রোডোলফো গুচ্চির মৃত্যুর পর সবকিছুর প্রতি নিরাসক্ত হয়ে গেলেও ব্যবসায় তার টান বিন্দুমাত্র কমেনি। উল্টো বাবার অনুপস্থিতিতে তিনি প্রতিষ্ঠানের হাল শক্তভাবে ধরার চেষ্টা চালান, তবে বাধ সাধে তার নিকটাত্মীয়রা। তারা আদালতে গিয়ে অভিযোগ করে, মরিজিও নিজের ইচ্ছামতো প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে খরচ করছেন, এবং এর বিরোধিতা করায় তিনি তার আত্মীয়দের বোর্ড অব ডিরেক্টরস থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। এরপর বিভিন্ন ঘটনাক্রমে ১৯৯৩ সালে মরিজিও গুচ্চি তার ভাগের অংশ, যেটি কোম্পানির প্রায় ৫০% শেয়ারের সমপরিমাণ ছিল, সেটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তবে এর বিনিময়ে তিনি প্রায় ১৭০ মিলিয়ন ডলার পান, যেটি তাকে ইতালির সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজনে পরিণত করে। একই সময়ে আবার তার ও তার সাবেক স্ত্রী পাট্রিজিয়া রেগিয়ানির যে আইনি লড়াই চলছিল, সেটার অবসান ঘটে।প্যাট্রিজিয়া এক মিলিয়ন ডলার পান।

Unit ygog
মরিজিও গুচ্চির শেষকৃত্যানুষ্ঠানে সাবেক স্ত্রী পাট্রিজিয়া রেগিয়ানি ও তার দুই কন্যা; image source: thesun.co.uk

বিচ্ছেদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে পর্যাপ্ত অর্থ পেলেও প্যাট্রিজিয়া কোনভাোবেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি সাবেক স্বামীর প্রতি এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে, রীতিমতো একজন ভাড়াটে খুনির সন্ধান করছিলেন। তিনি প্রথমে তার বাসার পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে বলেন, স্বামীকে হত্যায় যেন তাকে সহযোগিতা করা হয়। এছাড়া তিনি তার বিশ্বস্ত আইনজীবীরও দ্বারস্থ হন এটা জানতে যে, সাবেক স্বামীকে হত্যা করলে কী ধরনের আইনি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এরপর প্যাট্রিজিয়া এক বান্ধবীর কাছে যান এবং তার পরিকল্পনা খুলে বলেন। সেই বান্ধবীর নাম ছিল পিনা অরিয়েম্মা। প্যাট্রিজিয়া বলেন, যদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে তাকে মোট সাড়ে চার লাখ ডলার দেয়া হবে। অরিয়েম্মা এবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ইভানো স্যাভিওনি নামের এক হোটেল কর্মচারীর সাথে যোগাযোগ করেন। ইভানো স্যাভিওনি আবার ওরেজিও চিচালা নামের আরেক ব্যক্তির সাথে অর্থের ব্যাপারে আলোচনা করে সবকিছু ঠিক করে ফেলেন।

এরপর যা হয়েছিল, সেটি ইতালির গণমাধ্যমের শিরোনাম হয় প্রায় দুই বছর ধরে। ১৯৯৫ সালের ২৭ মার্চ অফিসের সামনে গেটে দাঁড়ানো মরিজিও গুচ্চিকে লক্ষ্য করে এক আততায়ী গুলি ছোড়ে, এবং মরিজিও মারা যান। যে ব্যক্তি গুলি ছুড়েছিলেন, তিনি নিরাপদে পালাতে সক্ষম হন। প্রাথমিকভাবে সবাই সন্দেহ করেছিলেন, মরিজিওর হত্যার পেছনে পাট্রিজিয়ার হাত রয়েছে। কারণ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিতেন। কিন্তু কারও কাছে শক্ত প্রমাণ না থাকায় তাকে পুরোপুরি দোষী বলা যাচ্ছিল না।

Jcucilglv
গ্রেফতারের পর আদালতে নেয়া হচ্ছে গুচ্চি হত্যাকান্ডের মূল হোতা প্যাট্রিজিয়া রেগিয়ানিকে; image source: vogue.com

ঘটনাক্রমে পুলিশ হত্যাকান্ডের প্রায় দুই বছর পর এক বেনামী ফোনকলের প্রেক্ষিতে নাটকীয়ভাবে প্যাট্রিজিয়া, খুনী বেনেদিত্তো চেরাউলো, ওরেজিও চিচালা, পিনা অরিয়েম্মা ও ইভানো স্যাভিওনি– পাঁচজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। প্রায় এক বছর বিচারকাজ চলে। আদালতে প্যাট্রিজিয়াসহ অন্যরা বরাবরই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছিলেন, কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করে তাদের অপরাধের সত্যতা পাওয়া যায়। ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে প্যাট্রিজিয়া ও ওরেজিওকে ২৯ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। একইসাথে খুনী বেনেদিত্তোকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড, পিনা অরিয়েম্মাকে ২৫ বছর কারাদণ্ড, ও ইভানো স্যাভিওনিকে ২৬ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়।

মরিজিও গুচ্চির হত্যাকান্ড ছিল ইতালির অভিজাত সম্প্রদায়ের ইতিহাসে এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। পুরো বিশ্বের ফ্যাশন জগত কেঁপে উঠেছিল তার হত্যাকান্ডের খবর শোনার পর।

Related Articles