যেকোনো আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে বছরের পর বছর গবেষণা আর সাধনার গল্প। রয়েছে বিজ্ঞানীদের দিন-রাত পরিশ্রমের গল্প। কিন্তু সব বড় বড় আবিষ্কার কেবল গবেষণা লব্ধ ফলাফল হতেই আসেনি। এমন অনেক আবিষ্কার রয়েছে যা নিছক দুর্ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। স্যার অ্যালেক্সান্ডার ফ্লেমিংয়ের কথাই ভাবুন। তিনি তার গবেষণাগারে কিছু রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজ করছিলেন। ব্যাকটেরিয়াগুলো খোলা অবস্থায় কালচার পাত্রে রেখেই তিনি পরিবারের সাথে ছুটি কাটাতে চলে যান। দুই সপ্তাহ পর ফিরে এসে দেখেন, পেনিসিলিয়াম নামক এক ছত্রাকের আক্রমণে সকল ব্যাকটেরিয়া মারা গেছে। এভাবেই তিনি আবিষ্কার করেন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ সৈনিকের প্রাণ বাঁচিয়েছিল।
কাকতালীয়ভাবে ঘটে যাওয়া এমন আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু সকল আবিষ্কার ফ্লেমিংয়ের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ আবিষ্কারের মতো আশীর্বাদস্বরূপ ছিল না। এদের মধ্যে এমন একটি আবিষ্কার রয়েছে, যা মানুষ হত্যার প্রধান উপকরণ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। এর নাম হলো গানপাউডার। এই লেখাটিতে গান পাউডারের আবিষ্কার এবং কিভাবে এটি আধুনিক যুদ্ধের মূল অস্ত্র হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে তা জানানো হবে।
অমরত্বের ওষুধের বদলে তৈরী হয়ে গেল মানুষ মারার অস্ত্র
নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। চীনা বিজ্ঞানীরা এমন একটি ওষুধ বানাতে চেয়েছিলেন, যা মানুষকে অমরত্ব দান করবে। নানা রকম প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে তারা পরীক্ষা করতে থাকেন। এরকম বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে একটি ছিল সল্টপিটার। এই সল্টপিটারের সাথে অন্যান্য কিছু উপাদান মেশানোর পর তা দাহ্য পদার্থে পরিণত হয়। আগুনের সংস্পর্শে আসলেই তা প্রচন্ড আলো ও বিস্ফোরণ সহকারে জ্বলে ওঠে। চীনা বিজ্ঞানীরা এই সল্টপিটার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়েই অঘটনটি ঘটিয়ে ফেলেন।
তীব্র আলো সহকারে এক বিস্ফোরণ ঘটে তখন। বিস্ফোরণের ফলে গবেষণারত বিজ্ঞানীদের শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে যায়। তারা যে বাড়ির মধ্যে কাজ করছিলেন সেটিও ধ্বংস হয়ে যায়। আর এভাবেই আগমন ঘটে গানপাউডার নামের নতুন এক মরণাস্ত্রের। গানপাউডার বা বারুদ প্রথম থেকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো না। এটি প্রথমে বিভিন্ন আতশবাজি বানানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। চীনের জনগণ এই আতশবাজি তাদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসব পালনের সময় ব্যবহার করতো। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অসুরদের দমনের জন্যও এটি সে সময়ে অনেক প্রচলিত ছিল। তখন থেকেই কিছু বিজ্ঞানী একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার কৌশল বের করতে থাকে।
প্রথমবারের মতো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার
বিভিন্ন সূত্র মোতাবেক, আবিষ্কারের সাথে সাথেই চীনা সৈন্যরা যুদ্ধে গান পাউডার কাজে লাগানো শুরু করে। তখন তারা যুদ্ধে এর ব্যবহার নিয়ে তেমন দক্ষ ছিল না। এটি তৈরীর কৌশলেও কিছুটা ঘাটতি ছিল। তখন এই বস্তু কেবল আগুনের সংস্পর্শে তীব্র আকারে জ্বলে উঠতো আর বিভিন্ন বর্ণের আলোকসজ্জা তৈরী করতো। একারণে আতশবাজি ফাটানোর সাথে যে ছোটখাট বিস্ফোরণ ও আগুন তৈরী হতো সেটিই যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেওয়ার জন্য কাজে লাগানো হয়। যুদ্ধে প্রতিপক্ষরা বিচিত্র বর্ণের আগুন আর ফুলকি দেখে মনে করতো হয়তো এগুলো হয়তো কোনো যাদুকরী অস্ত্র!
৯০৪ খ্রিস্টাব্দে চীনের সাথে মঙ্গোলিয়ানদের যুদ্ধে প্রথম গান পাউডার ব্যবহার করা হয়। এ যুদ্ধে চীনা সৈন্যরা তীরের মাথায় একটি নল তৈরী করে তাতে পাউডার সংরক্ষণ করতো। এরপর সেই তীরের মাথায় আগুন জ্বালিয়ে তা প্রতিপক্ষের দিকে ছুড়ে মারতো। এতে নিমিষেই প্রতিপক্ষের তাবূতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। আকাশে তীব্র আলোকচ্ছটা দেখে যুদ্ধের ঘোড়াগুলো ভয় পেয়ে আর সামনে আগাতো না।
কেবল এভাবেই যুদ্ধে গান পাউডারের ব্যবহার থেমে থাকেনি। চীনা বিজ্ঞানীরা নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকে এটি দিয়ে আরো বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরী করার জন্য। অতঃপর তারা বিভিন্ন আধুনিক সমরাস্ত্র যেমন- হ্যান্ড গ্রেনেড, ফ্লেমথ্রোয়ার বা অগ্নি-বর্ষক যন্ত্র, ল্যান্ড মাইন ইত্যাদি তৈরী করে ফেলে।
চীনের গোপন এই অস্ত্র দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যায়
চীনারা বেশিদিন গান পাউডারের অস্তিত্ব গোপন রাখতে পারেনি। মঙ্গোলিয়ানদের সাথে যুদ্ধের সময় তারা প্রথমবারের মত এটি ব্যবহার করে। ধারণা করা হয় যে, এই মঙ্গোলিয়ানরাই সারা পৃথিবীতে এর নাম ছড়িয়ে দেয়। চীনের সাথে যুদ্ধের পর তারা নিজেরা এই পাউডার প্রস্তুত করা শিখে ফেলে। পরবর্তীতে ভারতসহ অন্যান্য বিভিন্ন দেশে অভিযানের সময় তারা এটি যুদ্ধের ময়দানে প্রয়োগ করে। বাইরে নিজেদের আবিষ্কারের এমন বিস্তৃতি দেখে তৎকালীন চীনের শাসকগণ শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এর ফলস্বরূপ বিদেশীদের কাছে সল্টপিটার বিক্রির উপর পুরোপুরি নিষেদ্ধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু তাতেই এই বিধ্বংসী বস্তুর প্রচার ও প্রসার থেমে থাকেনি।
ইউরোপে কিভাবে গান পাউডারের প্রসার ঘটে তা নিয়ে কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারে না। কিছু ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, মঙ্গোলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ থেকে তারা এই মরণাস্ত্র বানানোর কৌশল রপ্ত করেছে। আবার এমনও তত্ত্ব রয়েছে যে, ইউরোপিয়ানরা নিজেরাই কোনো বহিরাগত সাহায্য ছাড়া গান পাউডারের প্রস্তুত প্রণালী শিখে ফেলে। বেশ কিছু ঐতিহাসিকগণের মতে, ১২৪২ খ্রিস্টাব্দে রজার বেকন নামের একজন ব্রিটিশ গবেষক একটি পাণ্ডুলিপিতে গান পাউডার তৈরীর প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছিলেন। ইউরোপে এটি ব্ল্যাক পাউডার হিসেবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু এর প্রস্তুত প্রণালী ছিল হুবুহু চীনা বিজ্ঞানীদের অনুরূপ।
ধীরে ধীরে গান পাউডারের প্রস্তুত প্রণালী পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিভিন্ন দেশের গবেষকরা এটি ব্যবহার করে নানা প্রকৃতির আধুনিক সমরাস্ত্র তৈরী করা শুরু করে। নিজেদের সৃজনশীলতা ব্যবহার করে এই বিস্ফোরক দ্রব্যটি দিয়ে কিভাবে আরো বেশি ভয়ংকর অস্ত্র তৈরী করা যায়, সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় সবাই।
গানপাউডারের মাধ্যমেই আধুনিক যুদ্ধ পদ্ধতির সূত্রপাত হয়
মানুষ যখন থেকে সামাজিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছে, রাষ্ট্র গঠন করা শুরু করেছে, তখন থেকেই পৃথিবীর বুকে নানা যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই আছে। কখনো এই যুদ্ধ ছিল ক্ষমতা প্রদর্শনের। আবার কখনো ছিল রাষ্ট্র দখলের। মধ্যযুগে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ ছিল একটি নিয়মিত ঘটনা। তরবারি হাতে ঘোড়সওয়ার সৈনিক ও তীর নিক্ষেপণ ছিল এসময় যুদ্ধের প্রধান উপাদান । গানপাউডার আসার সাথে সাথে এই পুরনো যুদ্ধ পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। মধ্যযুগীয় এবং আধুনিক যুদ্ধ পদ্ধতির মাঝে এই বিস্ফোরক বস্তুটি একটি নতুন সংযোগ সৃষ্টি করে।
ইউরোপিয়ানরা গানপাউডার তৈরীর প্রক্রিয়া রপ্ত করার পরপরই এটি ব্যবহার করে নানা আধুনিক অস্ত্র তৈরী করে ফেলে। ফায়ার আর্ম বা আগ্নেয়াস্ত্র তাদের মাধ্যমেই আধুনিকতা লাভ করেছিল। প্রথমেই তারা তৈরী করে কামান। ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গোলিয়ানরা প্রথম কামানের মত অস্ত্র তৈরী করলেও তা ইউরোপিয়ানদের মতো বিধ্বংসী ছিল না। ইউরোপিয়ান কামানের নকশা ছিল আরো আধুনিক। পাউডার মাখানো সুতায় আগুন জ্বালালেই কামানের মুখ থেকে ছুটে যেত বড় বড় গোলা। এক জায়গায় অনেকগুলো শত্রুকে একত্রে দমন করার জন্য এটি ছিল একটি অভিনব অস্ত্র। তাছাড়া কামান আসার পর বড় বড় দুর্গের মাধ্যমে প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনেকটা অকেজো হয়ে যায়। আগে শ্ত্রুপক্ষের প্রাসাদের প্রধান ফটক আক্রমণ করা হতো বড় গাছের গুড়ি দিয়ে। কিন্তু কামান আসার পর আর এর প্রয়োজন পড়ে না। এছাড়াও একের অধিক শত্রু দমনের ক্ষেত্রে তীরের ব্যবহার ছিল বেশি ব্যয়বহুল। তাই যুদ্ধ বিশ্লেষকরা বেশি বেশি কামান ব্যবহারের সুপারিশ করতে থাকে।
শুধু কামান তৈরীর মাঝেই গান পাউডারের ব্যবহার থেমে ছিল না। যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করতে থাকে কিভাবে এই অস্ত্রকে আরো ছোট করে মানুষের বহনযোগ্য করা যায়। আর এভাবেই আবির্ভাব ঘটে পিস্তল আর বন্দুকের। এতে ব্যবহৃত গুলির প্রতিপক্ষের বর্ম ছেদ করার মতো ক্ষমতা ছিল। যুদ্ধ পদ্ধতিতে এবার আসলো এক নতুন সংযোজন। পদাতিক বাহিনী নামে এক নতুন সৈন্য বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হলো। এদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে বন্দুক থাকতো। এসময় যারা ভালো নিশানা জানতো, তাদের রাজপ্রাসাদের টাওয়ারগুলোতে বন্দুক হাতে টহল দেওয়ার জন্য নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়।
সাধারণ বন্দুকের পর আসে মেশিন গান। এতে প্রত্যেকবার গুলি করে রিলোড করার বদলে একসাথে কয়েক দফা গুলি করা যেত। এভাবে আস্তে আস্তে গানপাউডার আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
শেষ কথা
আগেই বলা হয়েছে,প্রত্যেক আবিষ্কার মানুষের জন্য আশীর্বাদসরূপ নয়। গান পাউডারই যুদ্ধে মানুষ মারার প্রধান অস্ত্র নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণের গল্প আমরা সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু এই পারমানবিক শক্তি দিয়েই কিন্তু একটা দেশের ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। সুতরাং কোনো নতুন উদ্ভাবন কিভাবে আমাদের কাজে লাগাতে হবে তা পুরোপুরি আমাদের নিজেদের চিন্তাধারার উপর নির্ভর করে।
উপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর সঠিক সাল ও তারিখ নিয়ে নানা জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন তথ্য রয়েছে। তাই লেখাটিতে সালের ব্যবহার কম করা হয়েছে।
চীন সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) চীন: গ্লোবাল অর্থনীতির নতুন নেতা
২) প্রাচীন সভ্যতা সিরিজ: চীন
This bangla article is about the invention of gunpowder and how it spread all over the world. All the reference are hyperlinked within the article.
Feature Image Source: DailyPooper.com