Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হ্যারল্ড ফ্রেডরিক শিপম্যানঃ ডাক্তারের আড়ালে লুকনো এক ভয়ঙ্কর খুনি

নৃশংসভাবে কাউকে হত্যা করা কোনো মানুষের নেশা হতে পারে তা সত্যিই অকল্পনীয়। স্থির মাথায়, প্ল্যান করে কোনো ব্যক্তিকে খুন করা হয়তো গল্প-উপন্যাসে পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু বাস্তব জীবনে? গল্প উপন্যাসকে হার মানা এমনই এক চরিত্র- হ্যারল্ড শিপম্যান। হ্যারল্ড ফ্রেডরিক শিপম্যান পেশায় একজন চিকিৎসক। দাড়ি চশমায় তাকে দেখতে অনেকটা দার্শনিকের মতো মনে হলেও এই লোকটাই ভয়ানক দুর্দান্ত এক হত্যাকারী। কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার হিসেবে এই চিকিৎসকের জুড়ি মেলা ভার।

হ্যারল্ড ফ্রেডরিক শিপম্যান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই, ১৯৪৬ সালের ১৫ জানুয়ারি নটিংহামের এক শ্রমজীবী পরিবারে হ্যারল্ডের জন্ম। তার বাবা ছিলেন একজন ট্রাক ড্রাইভার। যুদ্ধবিধ্বস্ত শ্রমজীবী পরিবারের দৈনন্দিন সংগ্রাম আর বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই কেমন তা ছোটবেলা থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন শিপম্যান।

মাত্র সতেরো বছর বয়সে মাকে হারান তিনি। তার মা ভেরা ভেট্রন ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের শেষ দিকে ভেরা ব্যথা কমানোর জন্য মরফিন ইঞ্জেকশন নিতেন, যা হ্যারল্ডের জীবনে তীব্র রেখাপাত করে। মায়ের খুব ঘনিষ্ট ছিলেন হ্যারল্ড। মায়ের শেষ দিনগুলোতে তার পাশে থেকে হ্যারল্ড স্বচক্ষে দেখেছেন মায়ের কষ্ট এবং তা লাঘবের জন্য ঘরেই ডাক্তারের সহায়তায় মরফিন ইঞ্জেকশন নেয়া। এসবই হ্যারল্ডের পরবর্তী জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং এই মরফিন ঔষধকেই পরবর্তী সময়ে খুনের উপাদান হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন।

কিশোর হ্যারল্ড শিপম্যান

পড়াশোনা ও খেলাধুলায় শিপম্যান বেশ প্রতিভাধরই ছিল। স্কুল জীবনে যুব রাগবী দলের সদস্য ছিলেন তিনি এবং স্কুল জীবনের শেষ বছরে তিনি স্কুলের অ্যাথলেট দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৭০ সালে লিডস্ থেকে ডাক্তারি পাস করেন হ্যারল্ড। তিনি ইয়র্কশায়ারে পোর্টফ্রেট জেনারেল ইনফরমারিতে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৭৪ সালে পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের আব্রাহাম অরমেরড মেডিক্যাল সেন্টারের জেনারেল প্রসিকিউটর (জিপি) হিসেবে প্রথম স্থান লাভ করেন। কিন্তু এরপর নিজের ব্যবহারের জন্য প্যাথিড্রিন জোগাড় করতে প্রেসক্রিপশন জালিয়াতির কর্মকান্ডে ধরা পড়েন তিনি। বেশ মোটা জরিমানা এবং ড্রাগ রিহ্যাবিলিটেশন মাধ্যমে নিজেকে শুধরে আবার মূল পেশায় ফিরে আসেন হ্যারল্ড।

লিডসে ডাক্তারি পড়ার সময় হ্যারল্ড

আশির দশকের শুরুতে হাইড শহরে ডাক্তারি চেম্বার সাজিয়ে সমাজে ভদ্রলোক হিসেবে জাঁকিয়ে বসেন হ্যারল্ড। এসময় তার বেশ প্রসার ঘটে। নাম ডাক, প্রভাব প্রতিপত্তিও হয়েছিল বেশ। কিন্তু ছেলেবেলার দিনগুলো তার মাথায় প্রতিনিয়ত ঘোট পাঁকাতো। মায়ের অসুস্থতা, অর্থকষ্ট এবং হাজারও বঞ্চনা সবকিছুই শিপম্যানের সারা জীবনে ছায়া ফেলেছিল। এসব মানসিকভাবেও তাকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করতো। কিন্তু সবকিছুই অসাধারণ দক্ষতায় তিনি মোকাবেলা করতেন। সমাজে মানসিক ব্যাধিগ্রস্তদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত ইত্যাদি নিয়ে ১৯৮৩ সালে টেলিভিশনে শিপম্যান নিজে একখানি বক্তৃতা দেন, যা সেসময় প্রশংসিতও হয়। কিন্তু মনের গহীনে অপরাধমূলক প্রবৃত্তির অঙ্কুরটি কেমনে জন্মায় তা নিয়ে কোনো বিস্তারিত বলা ছিল না সেই বক্তৃতাতে। যেন অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তিনি তা এড়িয়ে গেছেন।

সমাজে মানসিক ব্যাধিগ্রস্তদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত তা নিয়ে ১৯৮৩ সালে টেলিভিশনে এক বক্তৃতা দেন শিপম্যান

হাইড শহরের ‘ফ্র্যাঙ্ক মেসি অ্যান্ড সন্স’ নামক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আয়োজনকারী একটি সংস্থার কর্ণধার ডেবোরা মেসি ব্রুক সার্জারির ডক্টর লিন্ডা রেনল্ডসকে জানান যে, হ্যারল্ড শিপম্যানের কাছে আগত রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি। ডক্টর লিন্ডা ব্যাপারটি সাউথ ম্যাঞ্চেস্টার ডিস্ট্রিকটের করোনার জন পোলার্ডের কানে তোলেন এই বলে যে, বৃদ্ধাদের নামে বড্ড বেশি সংখ্যায় ক্রিমেশন ফর্ম তুলে সইসাবুদের জন্য পাঠানো হচ্ছিল তাঁর কাছে। কিন্তু পুলিশের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ ছিল না। ফলে শিপম্যানকে ধরতে পারছিল না পুলিশ। কেসটি প্রায় ধামাচাপা পড়ে যায় সেসময়। তবে অনভিজ্ঞ পুলিশকর্মীদের হাতে এই কেসটির দায়িত্বভার ছেড়ে রাখার সিদ্ধান্তটিকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি৷

ডাক্তারি পেশার আড়ালে একজন নির্দয় খুনি

পুলিশ ১৯৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল অনুসন্ধান বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে শিপম্যান গ্রেফতার হওয়া আগ পর্যন্ত আরও তিন জনকে খুন করেন। তার শেষ শিকার ক্যাথলিন গ্রান্ডি৷ ক্যাথলিনের সঙ্গে শিপম্যানের শেষ দেখা হয় এবং তিনিই মহিলার ডেথ সার্টিফিকেটে সই করেন।

শিপম্যানের শিকার ক্যাথলিন গ্রান্ডি

বয়সজনিত কারণেই গ্রান্ডির মৃত্যু হয়েছিল লিখে দেন শিপম্যান। কিন্তু বাঁধ সাধে গ্রান্ডির মেয়ে অ্যাঞ্জেলা উডরাফ। তার প্রথম সন্দেহ জাগে যখন তিনি দেখেন যে তার মা নিজের সমস্ত সম্পত্তিই হ্যারল্ড শিপম্যানের নামে দান করে যান। তখনকার দিনে যার মূল্য ছিল  তিন লক্ষ ছিয়াশি হাজার পাউন্ড। বিষয়টি অনেকের মনেই খটকা জায়গায়। খবর পেয়ে পুলিশও নড়েচড়ে উঠে।

গ্রান্ডির মেয়ে অ্যাঞ্জেলা উডরাফ

পুলিশ ফের অনুসন্ধান শুরু করে। কবর খুঁড়ে গ্রান্ডির শবদেহ বের করে ফের কাটা ছেঁড়া শুরু করা হয়। পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর গ্রান্ডির শরীরে ডায়ামর্ফিন পাওয়া যায়। ১৯৯৮-সালের ৭ সেপ্টেম্বর শিপম্যানকে গ্রেফতার করা হয়। ঐসময় তার বাসা থেকে সম্পত্তির উইল জালিয়াতির কাজে ব্যবহৃত একখানি টাইপরাইটার পাওয়া যায়। ফলে পুলিশের তৎপরতা আরো বেড়ে যায়। তারা শিপম্যানের দাখিল করা ডেথ সার্টিফিকেটে নাম আছে এমন পনেরোটি মৃতদেহকে ফের কবর খুঁড়ে বের করে মর্গে পরীক্ষার জন্য পাঠানোর বন্দোবস্ত করে।

শিপম্যানের জাল করা উইল

পনেরটি লাশের শরীরের ময়নাতদন্তে দেখা যায়, সকলের শরীরের বেশি মাত্রায় ডায়ামর্ফিনের প্রয়োগ। শিপম্যান মারাত্মক রকমের বেশি ডায়ামর্ফিন রুগির শরীরে ঢুকিয়ে তাঁদের খুন করতেন এবং পরে মেডিক্যাল রিপোর্ট জাল করে নানা ধরনের অসুখের কারণ দেখিয়ে তাদের ডেথ সার্টিফিকেট দিতেন ।

বেশি মাত্রায় ডায়ামর্ফিন রুগির শরীরে ঢুকিয়ে হ্ত্যা করা হয় বলে হ্যারল্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ

এই উইল জাল করা নিয়ে দুটো তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন প্রেসক্রিপশন ফর মার্ডার বইটির লেখকদ্বয়- ব্রায়ান হুটল্ এবং জাঁ রিচি। প্রথম তত্ত্বটি ছিল, টানা খুনখারাপির ফলে জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলেন শিপম্যান। ক্রমশ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটি ক্ষীণ হয়ে আসছিল তার জীবনে। দ্বিতীয় তত্ত্বটি হয়তো অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য- পঞ্চান্ন বছর বয়সে সবকিছু আত্মসাৎ করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ইংল্যান্ড ছেড়ে পালানোর মতলব এঁটে রেখেছিলেন তিনি৷

মরফিন ওষধ ইনঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ

৫ অক্টোবর, ১৯৯৯ শিপম্যানের বিচার শুরু হয়। মোট পনেরোটি খুনের দায় চাপানো হয় তার ঘাড়ে। যদি মনে করা প্রায় আড়াইশোর অধিক লোক তার ভিক্টিম ছিল যাদেরকে তিনি হত্যা করেন। শিপম্যানের হাতে খুন হওয়া আশি শতাংশই মহিলা এবং সব চাইতে কম বয়সী ব্যক্তিটির, ইনি ঐ হাতে গোণা পুরুষদের একজন, বয়স ছিলো একচল্লিশ।

ডেম জেনেট স্মিথের নেতৃত্বে একটি দল শিপম্যান বিরুদ্ধে তদন্ত করে

২০০০ সালের ৩১ জানুয়ারি পনেরো জনকে হত্যা এবং ক্যাথলিন গ্রান্ডির উইল জাল করার দায়ে জুরি তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে। আদালত শিপম্যানকে পনেরোটি খুনের দায়ে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। আদালত তাদের রায়ে এমন ব্যবস্থা করে যেন শিপম্যান কখনোই ছাড়া না পায়।

কোর্টের ট্রায়ালরুমে হ্যারল্ড শিপম্যান (স্কেচ ছবি)

শিপম্যান ২০০৪ সালের ১৩ জানুয়ারি জেলখানায় আত্মহত্যা করেন। যদিও পনের জনের হত্যাকারী হিসেবে বিচারে তার সাজা হয়। কিন্তু সে সময়কার অনেকগুলো খুনেরই কিনারা করা যায়নি। একটি চার বছর বয়সি মেয়ের খুনও শিপম্যানই করেছিলেন কি না সেই নিয়ে আজও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে, যেমন কিনা আরও অনেক মৃত্যু নিয়েও।

হ্যারল্ডের শিকার যেসব মহিলারা

তথ্যসূত্র

১) biography.com/people/harold-shipman-17169712

২) en.wikipedia.org/wiki/Harold_Shipman

৩) murderpedia.org/male.S/s/shipman-harold.htm

৪) telegraph.co.uk/culture/4724155/The-Killing-Fields-of-Harold-Shipman.html

Related Articles