Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রবল বিতর্কের হেলেন জুয়েট হত্যাকাণ্ড

মানব-ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে নৃশংসতা ও হত্যাকাণ্ড তার নিজের ছাপ রেখেছে। হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাতের নানা ধরন ও প্রেক্ষাপট থাকে। সব ধরন ও প্রেক্ষাপটের ঘটনা সমাজে সমান প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। হতে পারে, আলোচিত কোনো যুদ্ধে চরম নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েও কেউ রয়ে যান অবহেলিত ও বিস্মৃত। আবার ক্ষুদ্র পরিসরে সংঘটিত হওয়া অখ্যাত কারো হত্যাকাণ্ডও ইতিহাসে দাগ রেখে যায়।

উনিশ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া এমনই এক হত্যাকাণ্ড গভীর দাগ রেখে গিয়েছিল ইতিহাসে।

১৮৩৬ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে হেলেন জুয়েট নামের একজন নারী যৌনকর্মী নৃশংসভাবে খুন হন। হত্যাকারী হিসেবে সন্দেহের দৃষ্টি পড়ে তার অন্যতম খদ্দের রিচার্ড রবিনসনের দিকে। তখনকার খবরের কাগজগুলো এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাঠকের মেজাজ উসকে দেবার মতো সংবাদ ছাপতে থাকে। হেলেন জুয়েট ও রিচার্ড রবিনসন সংবাদ জগতে একরকম অখণ্ড মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ান। নিউইয়র্ক হেরাল্ড পত্রিকা সেসব খবরের কাগজের মধ্যে অন্যতম।

হেলেন জুয়েটের প্রতিকৃতি
হেলেন জুয়েটের প্রতিকৃতি; Image Source: nypost.com

হেলেন জুয়েট এক সাধারণ ও হতভাগ্য মার্কিন নারী। ১৮১৩ সালে জন্ম নেওয়া এই নারী বিরূপ পরিবার, একচোখা সমাজ ও প্রতিকূল সময়ের নির্মমতায় নিতান্ত পেটের দায়ে নেমেছিলেন যৌনকর্মীর পেশায়। পোর্টল্যান্ড ও বোস্টন হয়ে শেষে নিউ ইয়র্কে থিতু হয়েছিলেন। 

কিন্তু ভাগ্য মাঝেমাঝে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতা দেখায়। ভাগ্যাহত মানুষের প্রাপ্য, বাঁচার অতি সামান্য সম্বলও কেড়ে নেয়। এক্ষেত্রেও তা-ই হলো।

১৮৩৬ সালের ১০ এপ্রিল। পতিতালয়ের বয়স্ক মহিলা রোজিনা টনসেন্ড রাত ৩টায় হেলেন জুয়েটের মৃতদেহ দেখে আঁতকে উঠলেন। মাথায় ধারালো অস্ত্রের তিনটি গভীর জখম পাওয়া গিয়েছিল। বিছানায় পাওয়া লাশের আশেপাশে কোনো ধ্স্তাধস্তির চিহ্ন নেই। খুনী তার কাজ শেষে ঘরটিতে আগুন লাগানোর চেষ্টা করেছিল। সেজন্য রোজিনা ঘরে ঢুকে প্রচুর ধোঁয়া দেখতে পান।

হেলেন জুয়েটের নিহত হওয়ার দৃশ্য
হেলেন জুয়েটের নিহত হওয়ার দৃশ্য; Image Source: thoughtco.com

সেখানকার এক মহিলার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ১৯ বছর বয়স্ক রিচার্ড রবিনসনকে গ্রেফতার করা হলো। জড়িত থাকার কথা সরাসরি অস্বীকার করলেন রিচার্ড। উপরন্তু অনেক দিনের পুরনো খদ্দের হওয়ার পরও, নিহত হেলেনের প্রতি তার বিশেষ সহানুভূতি দেখা গেল না। পতিতালয়ের আরো কয়েকজন কর্মীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলা আদালতে উঠলো।

২ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো বিচারের কাজ। সাক্ষীদের বড় অংশ হেলেন জুয়েটের মতোই হতভাগ্য ছিল। বিজ্ঞ আদালত তাদের সাক্ষ্যকে নির্ভরযোগ্য মনে করলেন না। রিচার্ড রবিনসন সমস্ত জুরিদের সিদ্ধান্তে নির্দোষ সাব্যস্ত হলেন।

বিজ্ঞ বিচারকরা দেহজীবীদের সাক্ষ্য নির্ভরযোগ্য মনে না করায় রিচার্ড নির্দোষ সাব্যস্ত হন
সাক্ষ্য নির্ভরযোগ্য মনে না করায় বিজ্ঞ বিচারকর রিচার্ডকে নির্দোষ সাব্যস্ত করেন; Image Source; timeline.com

প্রসঙ্গক্রমে রিচার্ড রবিনসনের কথা একটু বলে নিলে ভালো হয়। ১৮১৮ সালে জন্ম নেওয়া এই ভদ্রলোক সুশিক্ষিত ছিলেন। কাজের সন্ধানে নিউইয়র্কে এসে চাকরি নেন ম্যানহাটনের এক বড় দোকানে। তখন তার বয়স বেশি নয়, নিতান্ত টিনএজার।

‘ফ্রাঙ্ক রিভার্স’ নাম নিয়ে সে পতিতালয়ে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করে। নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুসারে, ১৭ বছর বয়সে ম্যানহাটন থিয়েটারের বাইরে কোনো এক স্থানীয় গুণ্ডার সাথে মারপিট করার পর, আহত অবস্থায় হেলেন জুয়েটের ঘরে ঢুকে পড়েন রিচার্ড। হেলেন জুয়েট এই টিনএজারের সাহস ও উদ্যম দেখে কিছুটা মুগ্ধ হয়। দিয়েছিলেন কলিং কার্ডও।

রিচার্ড রবিনসনের প্রতিকৃতি
রিচার্ড রবিনসনের প্রতিকৃতি; Image Source: murderbygaslight.com

এভাবে তাদের সম্পর্ক শুরু হয়। তবে ১৮৩০ এর দশকে হেলেন জুয়েট নিজের পেশাগত জীবনে বেশি জড়িয়ে গেলে এই সম্পর্ক মাকড়শার জালের মতো জটিলতর হয়ে রূপ নেয়। ১৮৩৫ সালে তাদের সম্পর্ক ভেঙে গেল।

১৮৩৬ এর দিকে রিচার্ড রবিনসনের বিয়ের গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। কয়েকটি সূত্র অনুসারে, হেলেন জুয়েট রিচার্ডকে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্য কয়েকটি সূত্র অনুসারে, হেলেন জুয়েটকে রিচার্ড টাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন, যাতে সে চুপ থাকে।

তৎকালীন পত্রিকায় সে নির্মম খুনের কল্পিত দৃশ্য
তৎকালীন পত্রিকায় সে খুনের কল্পিত দৃশ্য; Image Source: ranker.com

তখনকার দিনে দৈনিক পত্রিকায় ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির আকর্ষণীয় খবরকেই মূলত ফলাও করে প্রচার করা হতো। স্থানীয় অপরাধ ও হত্যাকাণ্ডের খবর সেই তুলনায় কমই আলোচিত হতো। কিন্তু হেলেন জুয়েট হত্যাকাণ্ড এই ধারা কার্যত বদলের শুরু করেছিল।

হেলেন জুয়েটের এই কাহিনী রাতারাতি সংবাদমাধ্যমের খোরাকে পরিণত হলো। সাংবাদিকরা এই হত্যাকাণ্ডকে চটকদার উপায়ে উপস্থাপন করতে লাগলেন। এদের মধ্যে পরিষ্কার দুটি ভাগ স্পষ্ট হয়ে উঠলো অল্পদিনেই।

একদল পেশাগত কারণে হেলেনকে হেয় প্রতিপন্ন করার পাশাপাশি রিচার্ড রবিনসনকে নির্দোষ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগলেন। তাদের কাছে মৃত্যু ছিল হেলেনের জন্য স্বাভাবিক পরিণতি। অন্যদিকে, আরেকটি দল রিচার্ড রবিনসনকে খুনী হিসেবে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হলেন। নিহত হেলেন জুয়েটকে অসম সমাজের নির্মম বলি হিসেবে প্রচার করলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছোট ট্যাবলয়েড ধাঁচের পত্রিকাগুলোকে পেনি পেপারস বলা হতো। এই জাতীয় পত্রিকাগুলো এই সংবাদ লুফে নিয়েছিল। সান, কুরিয়ার ও এনকুয়েরার এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল।

এসব পত্রিকায় এই খুনের ঘটনায় রিচার্ড রবিনসনের মতো প্রতিষ্ঠিত নাগরিকের জড়িত থাকা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়। নরনারীর সম্পর্কের কিছু অন্ধকার দিকের প্রতি নির্দেশ করার মাধ্যমে তারা বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার ত্রুটি তুলে ধরেন। সান পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, রিচার্ডের জড়িত থাকার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই বললেই চলে। বেশ কিছু পত্রিকা এর বিরোধিতা করে।

নিউইয়র্ক হেরাল্ড পত্রিকায় হেলেনের প্রকৃত খুনীর লেখা এক চিঠির হদিস পাওয়ার সংবাদ ছাপা হয়। এই খবর প্রচারের পর পত্রিকার প্রচার সংখ্যা রাতারাতি ২,০০০ থেকে ১৫,০০০ হয়ে যায়। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল, পত্রিকার সম্পাদক গর্ডন বেনেট ৫০ ডলার ঘুষের মাধ্যমে পরিচিত মহলের সাহায্যে কাজটি করেছিলেন।

রিচার্ড রবিনসনকে নির্দোষ হিসেবে সাব্যস্ত করার জন্য গর্ডন বেনেট, পতিতালয় ও এর সাথে জড়িত অন্ধকার জগতের কথা লিখতে লাগলেন। এছাড়া আইনি ব্যবস্থায় থাকা ত্রুটি ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কথাও লেখা হচ্ছিল।

নিউইয়র্ক হেরাল্ডে হেলেনকে স্মাজের বিষ হিসেবে উপস্থাপন
নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড-এ হেলেনকে সমাজের বিষ হিসেবে উপস্থাপন; Image Source: thevintagenews.com

ছোট পত্রিকা হবার কারণে হেরাল্ড পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকা সান-এর সাথে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ভালো যোগাযোগ ছিল। এর সাথে আরো কিছু কারণ মিলিয়ে এই সান পত্রিকা রিচার্ডের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় ছাপলো। ফলে শুরু থেকেই তার অপরাধপ্রবণতা ও তার সাথে খুনের যোগসূত্রের কথা এলো।

উল্লেখ্য, আদালতের সুস্পষ্ট রায়ের পর রিচার্ডের কিছু চিঠি পাওয়া গিয়েছিল, যাতে তার জড়িত থাকার পুরোক্ষ কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু ততদিনে রিচার্ড, নিউইয়র্ক ছেড়ে সুদূর টেক্সাসে গা ঢাকা দিয়েছিল। 

খবরটি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ক্রমে বেড়েই যাচ্ছিল। সে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছিল খবরের কাগজের কাটতি। খবরটি শুধু খুনের পর্যায়ে ছিল না, অপরাধ ও তার সাথে বিদ্যমান বিভিন্ন মানবিক ব্যাপারও এতে উঠে আসছিল। সমাজের নিচুতলা, ভদ্রগোষ্ঠী ও এদের পারষ্পরিক গোপন লেনদেন নিয়ে চমকপ্রদ সম্পাদকীয় ছাপা হতে লাগলো। যা আগে মার্কিন ও অন্যান্য পত্রিকায় কখনো এত গুরুত্ব পেতো না। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের চেয়ে চমক দেওয়া খবর ছেপে প্রচার বাড়ানো হতো। 

এর ফলে এই আলোচিত হত্যাকাণ্ড অনেক রহস্যগল্পেরও উপাদান হয়ে উঠলো। ১৮৪৯ সালে জর্জ উইলকিসের উপন্যাস ‘দ্য লাইভস অব হেলেন জুয়েট অ্যান্ড রিচার্ড পি. রবিনসন’ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল। এছাড়া ইউজিন লুথার ভাইডালের লেখা ‘Gurr’ উপন্যাসটিতে হেলেন জুয়েট উল্লেখযোগ্য চরিত্র হিসেবে এসেছে।

আমেরিকার ইতিহাসে অষ্টাদশ শতক বেশ উল্লেখযোগ্য সময়। গৃহযুদ্ধের বিভীষিকা ও নতুন ভূখণ্ড দখলের পাশাপাশি, সামাজিক অস্থিরতায় আচ্ছন্ন ছিল ঐ সময়ের মার্কিন সমাজ। ফলে বেড়েই চলছিল অপরাধের প্রবণতা। তবে সংবাদের পাতায় সেসব অপরাধ, বিশেষ গুরুত্ব পেতো না। হেলেন জুয়েট হত্যাকাণ্ড মার্কিন সংবাদ জগতের মানচিত্র বদলে দিয়েছিল। 

Related Articles