Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হারকিউলিস মুলিগান: দর্জি থেকে গুপ্তচর

জর্জ ওয়াশিংটন, বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন- আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিস্মরণীয় কিছু নাম। কিন্তু প্রতিটি বিজয়ের গল্পে এমন কিছু দুঃসাহসী বীর থাকেন যারা ইতিহাসের পাতার গভীরে হারিয়ে যান। তাদেরই একজন ছিলেন হারকিউলিস মুলিগান।

হারকিউলিস মুলিগান; image source: founder of the day

হারকিউলিস মুলিগান কোনো সাধারণ সৈন্য ছিলেন না। তিনি জর্জ ওয়াশিংটনকে দুবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়েছেন, আলেকজান্ডার হ্যামিলটনকে দেশপ্রেমিকে রূপান্তরিত করেছেন, আরো ভালো কোনো পেশায় যেতে পারলেও বেছে নিয়েছেন দর্জির জীবনকে, সেই পেশায় নিজের চেষ্টায় সফল হয়ে দেখিয়েছেন। তার সফলতা শুধু সেই নিখুঁত বোনা শার্টগুলোতে নয়, তার গল্প ব্যবসাকে কাজে লাগিয়ে রুই-কাতলা ইংরেজদের মাঝে পাহাড়সম জনপ্রিয়তা নিয়ে একজন গুপ্তচর হয়ে ওঠার।

হারকিউলিস জন্মেছিলেন ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৭৪০ সালে, আয়ারল্যান্ডে। তার বয়স যখন কেবল ছয় বছর, তার পরিবার তখন নিউ ইয়র্কে পাড়ি জমায়, জীবনের মান উন্নত করতে। একাউন্টিং ফার্ম খুলে সফল হতে দেরি হয়নি হারকিউলিসের বাবার।

লেখাপড়া শেষ করে দর্জির দোকান দিলেন হারকিউলিস। যে সে দোকান নয়, তার কাছে জামা বানাতে আসতো ইংরেজ হোমরাচোমরা ব্যক্তিত্বরা। নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ভাগ্নিকে বিয়ে করে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর মাঝে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। তার দোকানে কয়েকজন কর্মচারী থাকলেও তিনি নিজেই ক্রেতাদের সম্ভাষণ জানাতেন, তাদের গায়ের মাপ নিতেন। মিষ্টি মিষ্টি কথায় তাদের গোপন খবর বের করে ছাড়তেন।

একাধারে তিনি ছিলেন ‘সানস অব লিবার্টি’ নামের এক গুপ্তসংঘের সদস্য। এই সংঘ ১৩টি পরাধীন উপনিবেশের অধিকার রক্ষায় কাজ করতো। ব্রিটিশবিরোধী লেখালেখিতেও জড়িত ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার যুদ্ধের দশ বছর আগেই তিনি নিজের মাঝে প্রবল স্বাধিকারবোধের খোঁজ পেয়েছিলেন।

হারকিউলিস এবং আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন

আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন; image source: washington post

হারকিউলিস কিংস কলেজে (বর্তমান কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশ হয় এখানেই। ১৭৭৩ সালে তিনি দরজা খুলে দেখলেন, বড় ভাই এক ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে-ও নাকি কিংস কলেজে পড়বে। এভাবে তার সাথে দেখা হয় আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের, তারা দুজন ক্রমশ বন্ধু হয়ে ওঠেন। তাদের এই বন্ধুত্ব কত বড় রাজনৈতিক ঘটনা হতে পারে, তা কয়েক বছরের মাঝেই স্পষ্ট হয়েছিল। 

হ্যামিল্টন ইংরেজ উপনিবেশের সমর্থনে ছিলেন। কিংস কলেজে আসার আগে উইলিয়াম লিভিংস্টোনসহ (আমেরিকার সংবিধানে স্বাক্ষরকারীদের একজন) আরো অনেকের কাছে দেশপ্রেমের পাঠ নেওয়া শুরু করেন। কিংস কলেজে হারকিউলিসের সাথে রাত জেগে এসব নিয়ে আলোচনা করতেন। দেশের স্বাধীনতাকল্পে হ্যামিল্টনকে হারকিউলিস এতটাই প্রাভাবিত করেছিলেন যে তিনি ‘সানস অব লিবার্টি’তে যোগ দেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে। এ সময় তিনি রচনার মতো করে একটা চিঠি লিখেছিলেন, চিঠিটাকে বিপ্লব ত্বরান্বিতকারী হাজারো চিঠির অন্যতম ভাবা হয়।

লং আইল্যান্ডে ওয়াশিংটন হেরে যাওয়ার পর ১৭৭৫ সালের এপ্রিলে বিপ্লব শুরু হয়। হারকিউলিস নিউ ইয়র্ক ছাড়তে চেয়েছিলেন, পালিয়েও যাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় দিনে ধরা পড়লেন, তাকে ধরে বেঁধে নিউ ইয়র্ক ফিরিয়ে আনা হলো। অনিচ্ছার সাথে ফিরে দর্জির ব্যবসা শুরু করলেন। কে জানে, ঈশ্বর বোধহয় এমনটাই চাইছিলেন। একদিন জেনারেল ওয়াশিংটন হ্যামিল্টনের সাথে এক আলোচনায় বললেন, তাদের গুপ্তচর দরকার। এমন কোনো গুপ্তচর, যে নিউ ইয়র্ক শহরেই থাকে। হ্যামিল্টন তখন তার পুরোনো বন্ধু হারকিউলিসের কথা বলে, যে একইসাথে দেশপ্রেমিক আর নিউ ইয়র্কে আছে। হারকিউলিস ওদিকে বিপ্লবে যোগ দিতে না পেরে মনে মনে ধুঁকছিলেন। এমন সুযোগ হাতছাড়া করেন কিভাবে? সানন্দে জীবন বাজি রাখতে রাজি হলেন। সেদিন থেকে হারকিউলিসের কাজ ছিল বেছে বেছে বড় অফিসারদের কাপড় বানানো।

হ্যামিলটন বললেন, তার বন্ধু পারবে সাহায্য করতে; image source: dallasnews.com

হারকিউলিসের কাজ করার নিজস্ব ধরন ছিল। তিনি জানতেন, কেউ তাকে সরাসরি এসে বলবে না, “হারকিউলিস ভাই শুনছেন, আগামীকাল তো আপনাদের অমুক নেতাকে মারতে যাচ্ছি, তারপর তমুক জায়গায় অভিযান চালাবো।” তাকে মাথা খাটিয়ে তথ্য বের করতে হতো। একেক সময় দেখা যেত সৈন্যেরা একের পর এক কাপড় ঠিকঠাক করতে দিচ্ছে। হারকিউলিস তাদের পোশাক কবে লাগবে জানতে চাইতেন। যখন সবাই প্রায় এক তারিখ বলতো, হারকিউলিস বুঝে নিতেন এই দিন কিছু একটা হতে চলেছে, সাবধান করে দিতেন বিপ্লবীদের।

তার কাছে কাজ করতো কেটো। কেটোকে পাঠানো হত নিউ জার্সিতে ওয়াশিংটনের কাছে। হারকিউলিস তার খদ্দেরদের সাথে নানা গল্প জুড়ে দিতেন। এতে তারাও নিজেদের পেটের খবর বলতে থাকতো। আসলে একজন দর্জিকে বেশি ভয়ানক ভেবে ওঠার অবসর পায়নি তারা। সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জর্জ ওয়াশিংটনকে হারকিউলিস প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। 

একরাতে এক কর্মকর্তা উত্তেজিত অবস্থায় তার দোকানে এসে কোটটা ঠিক করে দিতে বলে। হারকিউলিস তার কর্মীদের নির্দেশ দেয় যেন দ্রুত আর আন্তরিকতার সাথে তারা কাজ করে। তারপর কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করে এত গভীর রাতে কোট ঠিক করা, আর তার উত্তেজনার পেছনের কারণ। অফিসার গর্বের সাথে জানালো, সেদিন তারা জর্জ ওয়াশিংটনকে ধরতে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে চমকালেও সামনে তাকে শুভকামনা জানালেন হারকিউলিস। অফিসার দোকান ছেড়ে বেরোতেই কেটোকে পাঠালেন তিনি। ইংরেজরা জেনে গিয়েছিল ওয়াশিংটন তার বিপ্লবীদের সাথে কোথায় দেখা করবেন। হারকিউলিসের দেয়া তথ্যের বরাতে ওয়াশিংটন বেঁচে যান।

দু’বছর পর ১৭৮১ সালে ফেব্রুয়ারিতে স্যার হেনরি ক্লিন্টন নিশ্চিত হন, ওয়াশিংটন কানেকটিকাটের জলপথ ধরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে যাবেন। তিনি তিনশ সেনার এক বহরকে সেই দিনের উদ্দেশ্যে সুসজ্জিত করে তোলেন, যেন তারা পানির মাঝেই ওয়াশিংটনকে আটকাতে পারে। ভাগ্যক্রমে সৈন্যদের নৌকায় রসদ যোগানোর দায়িত্ব ছিল হারকিউলিসের বড় ভাইয়ের। সে হারকিউলিসকে সব জানায়। হারকিউলিস কেটোকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে এবারেও ওয়াশিংটনকে সাক্ষাৎ পরাজয় থেকে রক্ষা করেন।

তবে এতসব কাণ্ড ঘটিয়ে খুব সহজে পার পেয়ে যাননি হারকিউলিস আর কেটো। তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ খুঁজে না পেলেও সন্দেহ করা হতো ভালোমতোই। ওয়াশিংটনের কাছে খবর পৌঁছে দিয়ে আসার পথে একদিন কেটো ধরা পড়ে, তাকে মারধোর করা হয় সত্য আদায়ের জন্য। সন্দেহের কারণে তাদের দুজনকে জেলও খাটতে হয়েছে।

স্বাধীনতার পর হারকিউলিসের কথা মাথায় রেখেছিলেন ওয়াশিংটন; image source: Owlcation

যুদ্ধশেষের দিনগুলো হারকিউলিসের দুশ্চিন্তায় কেটেছিল। হারকিউলিসের গুপ্তচর পরিচয় বেশিরভাগ দেশপ্রেমিক আমেরিকান জানতেন না। তাদের কাছে হারকিউলিস সুবিধাবাদী ইংরেজদের গোলাম, যে নিজ জাতির সাথে বেঈমানী করেছে, এককথায় রাজাকার। সেসময় এই ধরনের লোকেদের হেনস্থা করছিল আমেরিকাবাসী। হারকিউলিসও এর ব্যতিক্রম আশা করেননি। কিন্তু বিপদের এই বন্ধুকে ভুলে যাননি ওয়াশিংটন স্বয়ং। তিনি বুঝেছিলেন হারকিউলিসের বিপদের কথা। প্যারেড শেষে প্রথম যে কাজটি তিনি করেছিলেন তা হলোো হারকিউলিসের বাসায় গিয়ে সকালের নাস্তা খাওয়া। খাওয়াদাওয়া শেষে দোকানে গিয়ে পছন্দমতো কোটও কিনলেন। যুদ্ধের সময়ে হারকিউলিসের পক্ষ নিয়ে আমেরিকাবাসীর আর সন্দেহ রইলো না। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ওয়াশিংটন তার কাপড়চোপড় সব আইরিশ দর্জি হারকিউলিসের কাছ থেকেই বানাতেন। এই অভুতপূর্ব সম্মানের সুযোগে দোকানের নাম বদলাতে ভোলেননি হারকিউলিস, দোকানের বাইরে বড় করে লেখা টাঙিয়ে দিলেন, ‘জেনারেল ওয়াশিংটনের দর্জি’।

আলেকজান্ডার হ্যামিলটনের ডুয়েল; image source: pinterest.com

জীবনের বাকি বছরগুলোতে হারকিউলিস তার কাপড়ের ব্যবসা চালিয়ে যান। নিউ ইয়র্কে প্রথম ক্রীতদাস প্রথা বিলোপের যে সংগঠন সৃষ্টি হয়, তার ১৯ জন প্রতিষ্ঠাতার দুজন ছিলেন তিনি আর তার বন্ধু হ্যামিল্টন। হ্যামিল্টন ডুয়েলের আহবানে সাড়া দিয়ে গুরুতর জখম হন, তারপর মারা যান। তাকে সমাহিত করা হয় ট্রিনিটি চার্চে। ৮০ বছর বয়সে হারকিউলিস অবসর গ্রহণ করেন, আরো পাঁচ বছর পর মারা যান। তাঁকে বন্ধুর পাশেই সমাহিত করা হয়।

ফিচার ইমেজ: odyssey

Related Articles