শত বছর আগে শেষ হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নানা কারণে গূরুত্বপূর্ণ। আধুনিক অস্ত্রের নির্মমতায় যুদ্ধ বিষয়ক অতীতের রোমান্টিক বীরত্বগাঁথার গল্পগুলোর মিথ এ যুদ্ধে ভেঙে পড়ে। ইউরোপের যে ছবির মতো সাজানো অভিজাততন্ত্র ও জীবনের গল্প ইতিহাসের পাতায় আঁকা আছে, তা এ যুদ্ধের পর পর হারিয়ে যায়। পতন হয় বহু প্রাচীন রাজতন্ত্রের। বেঁচে থাকার জন্য ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় ইউরোপীয় নারীরা। পুরুষরা যখন যুদ্ধে মারা পড়ছে, তখন বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশে অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার কঠিন দায়িত্ব সে সময় নারীদেরই পালন করতে হয়েছে। এ সময় নারীদের রণাঙ্গনে উপস্থিতিও ছিল লক্ষ্যণীয়, যাদের অনেক বীরত্বগাঁথা আজও আমাদের অজানাই রয়ে গেছে।
এডিথ কাভেল
এডিথ কাভেল ছিলেন পেশায় নার্স, জাতীয়তা ব্রিটিশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি বেলজিয়ামের এক হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সে সময় তিনি উভয় পক্ষের প্রচুর সেনার জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন। এ সময় তিনি গোপনে দু'শতাধিক ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও বেলজিয়ান সেনাকে জার্মানদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে সরাসরি সহায়তা করেন। তিনি জার্মান সেনাদের চোখ এড়িয়ে প্রচুর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকেও এ সময় নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে তার এ সহায়তার ব্যাপারটি জার্মান সেনারা উদঘাটন করতে পারলে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং গ্রেফতার পরবর্তী বিচারে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর না করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জার্মান সরকারকে অনুরোধ করা হলেও জার্মানি সে অনুরোধ না রেখে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করলে পৃথিবীব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সে সময় প্রচুর মানুষ স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে শুরু করে।
লিনা হিগভি
লিনা হিগভি ছিলেন মার্কিন নেভির সর্বোচ্চ সম্মান নেভাল ক্রসে ভূষিত হওয়া প্রথম নারী। নিউ ইর্য়কের এ নারী আরও ১৯ জন নার্স সহ মার্কিন নেভির প্রথম নার্স দল গঠন করেন ১৯০৮ সালে। এ বিশজনকে ডাকা হতো 'পবিত্র বিশ' নামে, যদিও শুরুতে মার্কিন নেভি কর্তৃপক্ষ নারী নার্স দলের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান ছিলো। তারা ভেবেছিল, এ দলটি পুরুষ সৈন্যদের মনযোগ নষ্ট করতে পারে।
হিগভি দলের প্রধান হিসেবে তার অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন রণক্ষেত্র চষে বেড়ান। এ সময় তারা আহতদের সেবার পাশাপাশি স্থানীয় নার্সদেরও বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তার দলের সব নার্সই ছিলেন ভীষণ বেপরোয়া ও ভয়ডরহীন। যেমন: এ দলেরই সদস্য এস্টার হাসোনের একটি হাত ১৯১৭ সালে গোলার আঘাতে উড়ে যায়। বাকি জীবন তিনি এক হাতেই অপারেশনসহ অন্যান্য জটিল সব রোগী সামলেছেন।
মার্কিন নৌবাহিনী ১৯৪৫ সালে হিগভির সম্মানে তাদের একটি যুদ্ধজাহাজের নামকরণ করে ইউএসএস হিগভি।
জুলিয়া সি স্মিটসন
স্মিটসনও ছিলেন নার্স, তবে তিনি যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। ১৯১৭ সালে তিনি স্বেচ্ছায় যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করেন এবং অতি দ্রুত তার কর্মদক্ষতার কারণে পুরো ইউরোপে আমেরিকান নার্সদের সুপার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রথম নারী মেজর। স্বীয় অবদানের কারণে তিনি বীরত্বের প্রায় সকল পদক লাভ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে নার্সিং পেশায় মনোনিবেশ করলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি পুনরায় সেনবাহিনীতে যোগ দেন এবং নার্স নিয়োগের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে মৃত্যুর আগে তাকে কর্নেল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
ফ্লোরা সানডেস
ফ্লোরা সানডেস ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একমাত্র নারী সদস্য, যার রেকর্ডে ট্রেঞ্চে নেমে যুদ্ধ করার দাপ্তরিক প্রমাণ পাওয়া যায়। অস্ত্র হাতে তার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াটাও কম চমকপ্রদ নয়। তিনি মূলত নার্স হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেন। সার্বিয়াতে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি সহকর্মীদের থেকে পৃথক হয়ে পড়লে সার্বিয়ান সেনাদের পাশাপাশি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে শুরু করেন। ৪০ বছর বয়সে তার এভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াটা বেশ চমকপ্রদ হলেও তিনি কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে অসাধারণ সাহসিকতা প্রদর্শন করেন। যুদ্ধে তার কৃতিত্বের জন্য তাকে সার্জেন্ট মেজর হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। যুদ্ধকালে তিনি গ্রেনেডের আঘাতে আহত হন। সার্বিয়ান সেনাবাহিনী তার কৃতিত্বের জন্য তাকে সর্বোচ্চ সামরিক খেতাবে ভূষিত করে।
হেলেন ইসাবেলা ভন
হেলেন ইসাবেলা উদ্ভিদ বিজ্ঞানে তার অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৯০৯ সালে তিনি ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। অভিজাত এ ব্রিটিশ নারীকে ১৯১৭ সালে উইমেন আর্মি অক্সিলারি কর্পসের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার দলে প্রায় ১০,০০০ এর অধিক সদস্য ছিলেন, যারা নার্স থেকে শুরু করে বিমানের টেকনিশিয়ান হিসেবেও কাজ করছে। ১৯১৮ সালে তিনি উইমেন এয়ার ফোর্সের প্রধান হন। ১৯৩৯ সালের যুদ্ধে তার ভূমিকা আবারও গূরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। তবে ইসাবেলা মেধার তুলনায় অভিজাততন্ত্রকে প্রাধান্য দিতেন। ফলে তার উপর আস্থা হারিয়ে তাকে নীরবে পদচ্যুত করা হলে তিনি পুনরায় উদ্ভিদ বিজ্ঞানের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন।
ডাক্তার এলসি ইনগ্লিইস
এলসি ইনগ্লিইস যখন রয়েল আর্মিকে সম্পূর্ণ নারীদের দ্বারা পরিচালিত একটি ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের প্রস্তাব দেন, তখন তাকে উপহাস করে ঘরে ফিরে যেতে বলা হয়। রাজকীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যাখ্যানে বিচলিত না হয়ে তিনি ফরাসি সেনাবাহিনীকে একই প্রস্তাব দিলে তারা এতে রাজি হয়। পরবর্তীতে তিনি সার্বিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে হাসপাতাল স্থাপন করেন। মানের কারণে তার ফিল্ড হাসপাতাল যুদ্ধক্ষেত্রে পরিচিত হয়ে ওঠে। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তিনি যুদ্ধবন্দীও ছিলেন। মার্কিন কূটনীতিকরা তার মুক্তির ব্যবস্থা করেন। তিনি রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে উইমেন মেডিকেল কর্পস প্রতিষ্ঠাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ১৯১৭ সালে ক্যান্সারে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে সার্বিয়া তাকে দ্য অর্ডার অব দ্য হোয়াইট ঈগল উপাধিতে ভূষিত করে।
লুইজা থুলিজ
লুইজা ছিলেন এডিথ কাভেলের ফরাসি সহকর্মী। এডিথের সাথে তাকেও গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং তিনিও মৃত্যুদন্ডের মুখোমুখি হন। শেষ মুহূর্তে পোপ এবং স্পেনের রাজার হস্তক্ষেপের কারণে তার মৃত্যুদন্ড রদ করা হয়। তার বেঁচে যাওয়াটা ছিল বিস্ময়কর, কারণ যুদ্ধের সময় যারা ফ্রান্সের অভ্যন্তরে সক্রিয়ভাবে জার্মানদের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে লুইজা ছিলেন প্রথম সারিতে। লুইজা অবরুদ্ধ ফ্রান্স থেকে প্রচুর মানুষকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন। তার সরাসরি সহযোগিতায় ফ্রান্স থেকে হল্যান্ড হয়ে ব্রিটেনে প্রায় দুশো সশস্ত্র যোদ্ধা ও বিদ্রোহী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
মার্থা নোকার্ট
মার্থা নোকার্ট ইতিহাস বিখ্যাত এক গুপ্তচর। বেলজিয়ামে জন্ম নেওয়া এ নারী যুদ্ধের সময় জার্মানদের কাছ থেকে তার সেবামূলক কাজের জন্য আয়রন ক্রস উপাধি লাভ করেছিলেন। তবে তিনি গোপনে ব্রিটিশদের হয়ে কাজ শুরু করতেন এবং যুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য পাচার করতেন। গোপনে বোমা পুঁতে রাখার সময় তিনি অসাবধানবশত নিজের হাতঘড়িটি ঘটনাস্থলে ফেলে যান। এ সূত্র ধরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। পরবর্তীতে মৃত্যুদন্ড রদ করে তাকে সাত বছরের সাজা দেওয়া হয়। যুদ্ধ শেষে তিনি মুক্তি পান। নিজের সমসাময়িক মানুষদের চেয়ে অনেক অগ্রগামী একজন মানুষ ছিলেন তিনি। যুদ্ধ শেষে তার আত্মজীবনী 'আই ওয়াজ এ স্পাই' তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
মারিয়া বোকারিভা
মারিয়া বোকারিভা ছিলেন রাশিয়ান সেনাবাহিনীর শুধুমাত্র নারীদের নিয়ে গঠিত ৩০০ সদস্যের রাশিয়ান ব্যাটালিয়ান অব ডেথের অধিনায়ক। তার বাহিনীটি প্রথম মহাযুদ্ধের ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করে। তিনি সরাসরি জার নিকোলাসের অনুমতিক্রমে যুদ্ধে যোগদান করেন এবং বীরত্বের জন্য তিনটি খেতাব পান। পরবর্তীতে যুদ্ধে আহত হলে তার সামরিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। তবে পলাতক জীবন ভালো না লাগায় তিনি রাশিয়া ফেরত গেলে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯২০ সালে বলশেভিকরা তাকে হত্যা করে।
এভিলিনা হেভারফিল্ড
এভিলিনা ছিলেন নারী অধিকার কর্মী। তিনি নারীদের ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রামরত অবস্থায় যুদ্ধে নার্স হিসেবে যোগ দেন এবং সার্বিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করেন। এক অভিজাত স্কটিশ ব্যারন পরিবারে তার জন্ম। যুদ্ধের পরও তিনি সার্বিয়ার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯২০ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়।
This article is in Bangla language. It describes the heroic women who helped & faught during WWI. Necessary references have been hyperlinked.
Feature Image: BBC