স্বাধীনতার দু'শো বছর ইতোমধ্যেই পার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আদিবাসী, শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ১৭৮০ এর দশকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পুরোপুরি মুক্তি পায় দেশটি। সেকালে স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছিলেন হাজারো আমেরিকান। আমেরিকান বিপ্লবের সময় সবার পরিচয় আমেরিকান হলেও স্বাধীনতার পর পাল্টে যায় দেশটির পুরো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। যার ফলস্বরূপ শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের নামক বিভেদ তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন ভূখণ্ডে। পরোক্ষভাবে এই বিভেদকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মার্কিন শাসকগোষ্ঠীর পরিকল্পিত সৃষ্টি হিসেবেই দেখেন অনেক ইতিহাসবিদ। কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্যাদাপূর্ণ জায়গা থেকে দূরে রাখতে এযাবতকালে মার্কিন সিনেটে পাশ হয়েছে বহু বিতর্কিত নাগরিক অধ্যাদেশ।
কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের 'আফ্রিকান-আমেরিকান' হিসেবে বৈশ্বিকভাবে যে পরিচয় দেয়া হয় সেটিও পরোক্ষভাবে তাদের প্রতি বৈষম্যের সামিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বিভিন্ন রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার নিয়ে নানা রকম বিতর্কিত আইন প্রণয়ন করতো মার্কিন সরকার। সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের কম অগ্রাধিকার দেয়া হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের সংখ্যা বাড়ায় বিভিন্ন দাঙ্গা, অধিকার আন্দোলনের ঘটনা ঘটেছিল। আর সংবাদপত্রের উন্নতির সুবাদে বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্য এবং এর প্রতিবাদে আন্দোলনের সংবাদগুলো। তবুও সুরাহা হয়নি মার্কিন সরকারের কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক অধ্যাদেশগুলো।
এমনই এক বিতর্কিত আইনের বিরোধিতা করে দীর্ঘ এক বছর ধরে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে সক্রিয় ছিল আলবামার মন্টগোমেরি শহরের কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকেরা। পাবলিক বাসে শ্বেতাঙ্গদের জায়গা ছেড়ে দেয়ার মতো বিতর্কিত আইন জারি করে মন্টগোমেরির স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ একজনকে নিজের বসার জায়গা ছেড়ে না দেয়ার অপরাধে রোজা পার্কস নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে গ্রেফতারপূর্বক জরিমানা করে মন্টগোমেরি পুলিশ। এই ঘটনার চারদিন পর শহরের কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকেরা বাস বয়কট কর্মসূচি শুরু করে। শুরু হয় পাবলিক বাস সার্ভিসের এমন বিতর্কিত আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা মার্টিন লুথার কিং প্রথমবারের মতো মার্কিনীদের মধ্যে পরিচিতি অর্জন করেন। ১৯৬০ এর দশকের এই বাস বয়কট কর্মসূচির সুরাহা হয় মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গরা বৃহৎ পরিসরে না পারলেও সীমিত পরিসরে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আর মার্টিন লুথার কিং কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। আজ আমরা আলোচনা করব মন্টগোমেরি বাস বয়কট কর্মসূচির শুরু থেকে শেষ অবধি সকল ঘটনা নিয়ে।
ঘটনার সূত্রপাত
১৯৫৫ সালে মন্টগোমেরির পৌর বাসে যাতায়াতের ক্ষেত্রে একটি বৈষম্যমূলক আইন প্রচলিত ছিল। প্রতিটি বাসের প্রথম অর্ধেক আসন শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ করা হতো। এতে করে বেশিরভাগ সময় পুরো বাসে শ্বেতাঙ্গ যাত্রীর সংখ্যা বেশি থাকতো। তবুও এই বিতর্কিত পৃথকীকরণ অধ্যাদেশ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো আন্দোলনে নামেনি কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকেরা। নভেম্বর মাস অবধি সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। অতঃপর ১লা ডিসেম্বর মন্টগোমেরির ক্লিভল্যান্ড অ্যাভিনিউ থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন রোজা পার্কস। পেশায় তিনি ছিলেন একজন দর্জি। সারাদিন কাজ করার পর তিনি একটি বাসে ওঠেন এবং শেষাংশে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত আসনগুলোর মধ্য থেকে একটিতে বসেন।
ইতোমধ্যেই শ্বেতাঙ্গদের জন্য বরাদ্দকৃত সবক'টা আসনই পূর্ণ হয়ে যায়। এমন অবস্থায় ৪ জন শ্বেতাঙ্গকে বসার জায়গা করে দিতে গিয়ে পেছনের এক সারির ৪টি আসনের কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রীদের আসন ছেড়ে দিতে বলেন বাসচালক জে. ফ্রেড ব্লেক। অন্য তিনজন যাত্রী বাসচালকের কথামতো আসন ছেড়ে দিলেও প্রত্যাখ্যান করেন রোজা পার্কস। এতে বাস থামিয়ে তার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন ব্লেক। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বাসে হট্টগোল দেখে এগিয়ে আসেন দুজন দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য। রোজা পার্কসের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনার পর তাকে সরাসরি গ্রেফতার করে পুলিশ।
রোজা পার্কস তার জীবনীতে উল্লেখ করেন, বাসচালক ব্লেকের সঙ্গে এটি ছিল তার জীবনের দ্বিতীয় বাকবিতণ্ডার ঘটনা। এর আগে ১৯৪৩ সালে একটি পৌর বাসে ওঠার সময় চালক ব্লেক তাকে ফেলে রেখে চলে যায়। সেদিন প্রচণ্ড ভিড় থাকায় সামনের দরজায় ভাড়া পরিশোধ করে পেছনের দরজা দিয়ে বাসে প্রবেশ করতে চান তিনি। সামনের দরজা থেকে পেছনের দরজা অবধি আসার এই সময়টুকু অপেক্ষা না করেই বাসের গতি বাড়িয়ে চলে যান ব্লেক।
যা-ই হোক, ১ ডিসেম্বরের এই ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া রোজা পার্কসকে সরাসরি হাজতে প্রেরণ করে মন্টগোমেরি পুলিশ। গ্রেফতারের পর তিনি একমাত্র কলটি করেন স্বামী রেমন্ডকে। পরবর্তীতে তার স্বামী কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ই. ডি নিক্সনকে ঘটনাটি জানান।
মূলত নিক্সনই রোজা পার্কসকে মুক্ত করতে সাহায্য করেন। সেই সাথে মন্টগোমেরি পৌর বাস সার্ভিসের বিতর্কিত এই পৃথকীকরণ অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থার পরিকল্পনা করেন। তিনি রোজা পার্কসকে সবরকম আইনি লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি দেন। তাকে গ্রেফতারের সময় মন্টগোমেরি পুলিশ উল্লেখ করেছিল, অতীতে তিনি কখনোই অধিকার আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন না। যদিও বাস্তবিক প্রেক্ষাপট ছিল একেবারেই ভিন্ন।
প্রায় এক দশট ধরে কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠন ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশান ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কালার্ড পিপল (NAACP) এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এই দম্পতি। রোজা পার্কস ঐ বছর সংগঠনটির সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছিলেন। ৫ ডিসেম্বর তারিখে পৌর কোর্টে পৃথকীকরণ অধ্যাদেশ অমান্য করার দায়ে ১০ ডলার জরিমানা এবং কোর্ট ফি বাবদ ৪ ডলার প্রদান করে কারাগারের ঝামেলা মেটান পার্কস।
বয়কট কর্মসূচির পরিকল্পনা
পহেলা ডিসেম্বরের এই ঘটনার প্রায় ৯ মাস পূর্বে পৌর বাসে একই পরিস্থিতির শিকার হন ১৫ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরী ক্লাউডেট কোলভিন। রোজা পার্কসের মতো একই অপরাধে গ্রেফতার হন কোলভিন। সে সময় এই ঘটনাকে পুঁজি করে পৃথকীকরণ অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেন নিক্সনসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। যদিও তাদের পরিকল্পনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয় যখন গুঞ্জন রটে কোলভিন সন্তানসম্ভবা ছিলেন। নিক্সনের এমন একজন ভুক্তভোগী প্রয়োজন ছিল যার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগের সুযোগ পাবে না পৌর কর্তৃপক্ষ কিংবা রাজ্য সরকার। কোলভিনের ঘটনাটি তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও রোজা পার্কস কাজটি সহজ করে দেন।
তিনি রোজা পার্কসকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে সরাসরি নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। আর সেখানেই তার স্বামীর উপস্থিতিতে আন্দোলনের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনানুযায়ী কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের মাধ্যমে প্রতিটি কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে আসন্ন কর্মসূচির খবর পৌঁছে দেন নিক্সনসহ অন্যান্যরা। কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের স্থানীয় সংগঠন উমেন্স পলিটিক্যাল কাউন্সিল (WPC) এই কাজে সাহায্য করে। আন্দোলনের সুবিধার্থে বাস বয়কট কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন ডব্লিউপিসি-এর সভাপতি জো এন রবিনসন। মাত্র ২ দিনের মধ্যেই পুরো মন্টগোমেরি শহরের কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের মাঝে বয়কটের খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। চারদিক থেকে সবার সমর্থন আসতে থাকে।
এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন আলাবামা এবং মন্টগোমেরির কৃষ্ণাঙ্গ মন্ত্রীরা। তারা ৪ নভেম্বর স্থানীয় গির্জায় উপস্থিত থেকে বয়কট কর্মসূচিতে নিজেদের সমর্থন প্রকাশ করেন। সেই সাথে শহরের স্বনামধন্য পত্রিকা দ্য মন্টগোমেরি অ্যাডভার্টাইজারের প্রথম পাতায় আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনা ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। পরদিন সকাল থেকে প্রায় ৪০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক বাস বয়কট শুরু করেন। বিকেলে মন্টগোমেরি উন্নয়ন সমিতির কৃষ্ণাঙ্গ সদস্য এবং নেতারা ডেক্সটার অ্যাভিনিউ ব্যাপ্টিস্ট চার্চে একত্রিত হন। দীর্ঘ বৈঠকের পর এই আন্দোলনকে পুরোদমে সক্রিয় রাখার উদ্দেশ্যে ২৬ বছর বয়সী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে সমিতির সভাপতি নির্বাচিত করেন নেতারা। সেই সাথে পৌর কর্তৃপক্ষ তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া অবধি বয়কট কর্মসূচি এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন।
প্রাথমিকভাবে ভুল করে বসেন নেতারা। আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথকীকরণ অধ্যাদেশের বাতিল চাননি তারা। বরঞ্চ তাদের দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শন, কৃষ্ণাঙ্গ চালকদের নিয়োগ দেয়া, যে আগে আসবে আগে বসবে এমন নিয়ম করা। পরবর্তীতে অবশ্য ৫ জন নারী ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। অ্যাটর্নি ফ্রেড ডি. গ্রের নেতৃত্বে মার্কিন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মামলা করেন তারা।
মূলত মন্টগোমেরি শহরের সকল পৃথকীকরণ এবং অবৈধ অধ্যাদেশগুলো তুলে নিতে পৌর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এই মামলা করেন তারা। বয়কট কর্মসূচি যাতে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের পেশাদারিত্বে প্রভাব ফেলতে না পারে সেজন্য একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন নেতারা। সেসময় মাত্র ১০ সেন্ট ভাড়ায় ট্যাক্সি চালকরা কৃষ্ণাঙ্গদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতেন। মূলত এটি ছিল পৌর বাস ভাড়ার সমপরিমাণ অর্থ। কেউ কেউ পায়ে হেঁটে কাজে যোগ দিতেন। আর মানুষের মাঝে আন্দোলনের মনোভাবে অক্ষুণ্ণ রাখতে নিয়মিত সভা-সমাবেশের আয়োজন করতেন নেতারা।
বয়কটের সমাপ্তি এবং মার্টিন লুথার কিংয়ের উত্থান
বয়কট কর্মসূচি ডিসেম্বর পেরিয়ে পরের বছরের অর্ধেক সময় যাবত চলতে থাকে। তবুও কোনো সমাধান হয়নি। ১৯৫৬ সালের ৫ জুন মন্টগোমেরি ফেডারেল কোর্ট ঘোষণা দেয়, সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে কোনো বাসে পৃথক পৃথক আসন ব্যবস্থা কিংবা পৃথকীকরণের যেকোনো অধ্যাদেশ সংবিধান বিরোধী। গৃহযুদ্ধের পর ১৮৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে এই সংশোধনী গৃহীত হয়। চতুর্দশ সংশোধনী অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় এবং ফেডারেল আইনসমূহ রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
Black Past.com
ফেডারেল কোর্টের এই ঘোষণার পর সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে মন্টগোমেরি পৌর কর্তৃপক্ষ। ফেডারেল কোর্টের গণ্ডি পেরিয়ে প্রায় ৫ মাস যাবত সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলে। ততদিনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পৌঁছে যায় বাস বয়কটের সংবাদটি। প্রায় ১০০ জন দেশি-বিদেশি সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহের জন্য বয়কট চলাকালে মন্টগোমেরি ভ্রমণ করেন। অতঃপর ১৯৫৬ সালের ১৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, পৌর বাসে পৃথকীকরণ অধ্যাদেশ সম্পূর্ণভাবে সংবিধান পরিপন্থী। অতঃপর ২০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট মন্টগোমেরির পৌর বাসে পৃথকীকরণ অধ্যাদেশ বাতিল ঘোষণা দেয়। পরদিন শহরের সবগুলো বাস একত্রিত করে ৩৮১ দিনের এই বয়কট কর্মসূচীর সমাপ্তি ঘোষণা করেন মার্টিন লুথার কিং, ই. ডি নিক্সনসহ অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ নেতারা। সেই সাথে রোজা পার্কসকে 'নাগরিক অধিকার আন্দোলনের জননী' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ইতিহাসবিদদের মতে, মন্টগোমেরি বাস বয়কট আন্দোলনটি দুভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের প্রভাবিত করেছে। প্রথমত, এটি ছিল বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারের প্রথম আন্দোলন। ফেডারেল কোর্টের বাইরেও বৃহদাকারে ন্যায় অধিকার বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এটি। দ্বিতীয়ত, একজন অসাধারণ নেতা হিসেবে মার্টিন লুথার কিংয়ের উত্থান ঘটে। মন্টগোমেরি উন্নয়ন সমিতির প্রধান হিসেবে তিনি অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের যে প্রতিশ্রুতি দেন সেটি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আরও বেশি আলোচনায় আসেন।
এই আন্দোলনের পর মার্টিন লুথার কিং সাউদার্ন ক্রিস্টিয়ান লিডারশিপ কনফারেন্স প্রতিষ্ঠা করেন। তার নেতৃত্বে কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলে এই সংগঠনটি বিভিন্ন রকম পৃথকীকরণ অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য নানা কর্মসূচী পালন করে। ১৯৬৩ সালের মধ্যে এই সংগঠনের মাধ্যমে বার্মিংহাম, ওয়াশিংটনসহ বিভিন্ন রাজ্যে কয়েকটি নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় মার্টিন লুথার কিংয়ের সংগঠনটি। ১৯৬০ এর দশকে মার্টিন লুথার কিং ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের নিকট অধিকার আন্দোলনের একজন প্রতীক। ১৯৬৩ সালের আগস্টে ওয়াশিংটনে তিনি ঐতিহাসিক "আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম" শিরোনামের ভাষণ দেন।
বয়কটের পর কেমন ছিলেন রোজা পার্কস এবং অন্য নেতারা?
শ্বেতাঙ্গ নেতারা পৌর কর্তৃপক্ষের সহায়তায় কৃষ্ণাঙ্গদের উপর হামলার সুযোগ খুঁজছিল। বাস বয়কট চলাকালীন মার্টিন লুথার কিংয়ের অহিংস আন্দোলনের কারণে হামলার সুযোগ পায়নি তারা। বয়কট কর্মসূচি শেষ হওয়ার কিছুদিন পর এক বন্দুকধারী একটি পৌর বাসে হামলা চালায়। তার হামলায় দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ হন একজন সন্তানসম্ভবা কৃষ্ণাঙ্গ নারী। অতঃপর ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে চারটি গির্জায় বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। একই মাসে নিক্সন এবং মার্টিন লুথার কিংয়ের বাড়িতেও বোমা হামলা চালায় একদল লোক। জানুয়ারির ৩০ তারিখ মন্টগোমেরি পুলিশ কর্তৃপক্ষ ৭ জন হামলাকারীকে গ্রেফতার করে। বোমা হামলার সঙ্গে কড়িত সবাই ছিল উগ্র শ্বেতাঙ্গদের সংগঠন কু ক্লাক্স ক্ল্যানের সদস্য। তাদেরকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সহিংসতার সমাপ্তি ঘটে।
বয়কট কর্মসূচি শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই চাকুরিচ্যুত হন রোজা পার্কস। ততদিনে শ্বেতাঙ্গরাও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। তবে বয়কট চলাকালে প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞায় হুমকি ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষতি তারা করতে পারেনি। ব্যাপক হুমকির মুখে পড়ে পার্কস এবং তার স্বামী ডেট্রয়েটে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে তার ভাই থাকতেন। পরবর্তী জীবনে অবশ্য ডেট্রয়েটের স্থানীয় সরকার তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছিল।
১৯৬৫ সালে কংগ্রেসম্যান জন কনেয়ার্স জুনিয়র রোজা পার্কসকে ডেট্রয়েটের প্রশাসনিক সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৯৮৮ সালে অবসরের আগপর্যন্ত এই পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে তাকে কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। ২০০৫ সালের ২৪ অক্টোবর ৯২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন রোজা পার্কস। সম্মান প্রদর্শনের জন্য তার মৃতদেহ ইউএস ক্যাপিটল ভবনে রাখা হয়। রোজা পার্কসই ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী, যার মৃতদেহ এই জাদুঘরে স্থান পায়।
This article written about Montgomery Bus Boycott December 1955 to December 1956. It's regarded as the first large-scale U.S. demonstration against segregation.
Feature Image Source: Photo taken by Dan Weiner; copyright John Broderick