Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্লিনটন-মনিকা কেলেঙ্কারির আদ্যোপান্ত

১৯৯৫ সালের কথা, মনিকা লিউনস্কি তখন বাইশ বছর বয়সী চনমনে এক তরুণী। সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ইন্টার্ন হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন হোয়াইট হাউজে। কাজের খাতিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের কাছাকাছি আসার সুযোগ হয় তার। কিছুদিন যেতেই তাদের সম্পর্ক আর স্রেফ কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সী ক্লিনটনের সাথে এক অসম প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

মনিকা লিউনস্কি; source: twitter.com

হোয়াইট হাউজেই জমে ওঠে তাদের অভিসার। ক্লিনটনের অফিসেই বেশ কয়েকবার শারীরিক সম্পর্কে জড়ান তারা। এমনকি এর মধ্যে কয়েকবার ফার্স্ট লেডি হিলারি হোয়াইট হাউজেই ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে হোয়াইট হাউজে মনিকার চাকরিও পাকা হয়ে যায়। তবে কাজের প্রতি তার উদাসীনতা ও প্রেসিডেন্টের পেছনে বেশি সময় দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করে বছরখানেকের মধ্যেই তাকে হোয়াইট হাউজ থেকে পেন্টাগনে বদলি করে দেওয়া হয়।

এখানে মনিকা পরিচিত হন তার সহকর্মী লিন্ডা ট্রিপের সাথে, যে পরবর্তীকালে তার জীবনে সবচেয়ে বড় বিপদ ডেকে এনেছিল। অবশ্য শুধু মনিকার জীবনেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে ঘটনার সূচনা করেছিলেন লিন্ডা ট্রিপ। লিন্ডার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকলে একসময় মনিকা প্রেসিডেন্টের সাথে তার সম্পর্কের কথা বলে বসেন তাকে!

লিন্ডা ট্রিপ চতুরতার সাথে মনিকাকে প্রেসিডেন্টের সাথে তার সম্পর্কের বিস্তারিত কাহিনী বলতে প্ররোচিত করেন। এসব কথা গোপন রাখার শপথ করেও তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলা কথোপকথনগুলোকে গোপনে রেকর্ড করতে শুরু করেন ট্রিপ। পরবর্তীতে প্রকাশ হওয়া এসব কথোপকথনে, প্রেসিডেন্টের প্রতি মনিকার গভীর ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়। পাশাপাশি তার উদ্বেগও ফুটে ওঠে যে, বিল ক্লিনটন যদি জানতে পারেন, মনিকা এসব কাহিনী অন্য কারো কাছে বলেছেন তবে এটি তাদের সম্পর্কের ইতিও ঘটাতে পারে। কিন্তু ট্রিপ পুরোপুরি আশ্বস্ত করেন তাকে।

লিন্ডা ট্রিপ; source: dailyheadlines.net

এসময় ট্রিপ সবচেয়ে মোক্ষম যে চালটি চালেন তা হলো, তিনি মনিকাকে তাদের সম্পর্কের প্রমাণ সংরক্ষণ করতে প্ররোচিত করেন। তিনি মনিকাকে বোঝান যে, তিনি তার আর ক্লিনটনের সম্পর্কের বিষয়ে বাইরেও গুজব শুনেছেন। এসব নিয়ে আরো জল ঘোলা হতে পারে। তাই মনিকার উচিত তাদের সম্পর্কের প্রমাণ সংরক্ষণ করা। এসব প্রমাণের মধ্যে তাদের সাক্ষাতের সময়সূচী, পরস্পরকে পাঠানো চিঠি, ই-মেইল, উপহার ছাড়াও ছিলো মনিকার একটি বিখ্যাত নীল পোশাক!

পোশাকটি পরে তিনি প্রেসিডেন্টের সাথে যৌন সম্পর্ক করেছিলেন। আর এটিতে বিল ক্লিনটনের শুক্ররস রয়ে গিয়েছিলো। লিন্ডার কথা অনুযায়ী, মনিকা এটিকে না ধুয়ে যত্ন করে রেখে দেন। এদিকে কোর্টে তখন ক্লিনটনের নামে আরেকটি মামলা চলছে। পলা জোনস নামে আরাকানসান অঙ্গরাজ্য সরকারের এক নারী কর্মী ক্লিনটনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছিলেন ১৯৯৪ সালে।

মনিকার সেই নীল পোশাক; source: bethesdamagazine.com

সেই মামলায় ক্লিনটনের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য মনিকার ডাক পড়ে। আর মনিকা যেহেতু ক্লিনটনকে ভালোবাসতেন, তাই স্বভাবতই তার বিপদ বাড়াতে চাইতেন না। তিনি কোর্টে স্বীকারোক্তি দেওয়ার আগে প্রেসিডেন্টের সাথে দেখাও করেছিলেন। এটি ছিলো হোয়াইট হাউজে তার শেষ যাত্রা। ধারণা করা হয়, এসময় বিল ক্লিনটন তাকে কোর্টে তাদের সম্পর্কের কথা এড়িয়ে যেতে বলেন। যদিও এ ধারণার কোনো প্রমাণ নেই।

এরপর ১৯৯৮ সালের ৭ই জানুয়ারি মনিকা কোর্টে একটি এফিডেভিট দাখিল করেন যেখানে তিনি ক্লিনটনের সাথে তার যৌন সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন। এ পর্যায়ে দৃশ্যপটে ফের আবির্ভাব ঘটে লিন্ডা ট্রিপের। মনিকা কোর্টে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করলে তিনি তার কাছে থাকা রেকর্ডিংগুলো নিয়ে হাজির হন ইন্ডিপেনডেন্ট কাউন্সেল কেন স্টারের কাছে।

কেন স্টার; source: trbimg.com

ট্রিপ স্টারকে বলেন, এ রেকর্ডিং টেপগুলোতে মনিকার সাথে প্রেসিডেন্টের সম্পর্কের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যাবে। বোঝা যাবে যে, পলা জোনসের মামলায় মিথ্যা বয়ান দেওয়ার জন্য বিল ক্লিনটন মনিকাকে প্রভাবিত করেছেন। এরপর স্টার কোর্টের অনুমতি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পলা জোনস মামলায় মিথা সাক্ষ্য প্রদান ও বিচারকার্যে বাধা দেওয়ার অভিযোগের তদন্ত করতে শুরু করেন।

এ তদন্তের কাজে ১৬ই জানুয়ারি, ১৯৯৮ এফবিআই মনিকা লিউনস্কিকে একটি হোটেল কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং টেপের কথাগুলো মনিকার কিনা এ সত্যতা যাচাই করে। এছাড়াও স্বীকারোক্তি প্রদান করলে স্টার মনিকাকে এ মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার প্রস্তাব দেন। মনিকা তার পরিবারিক বন্ধু অ্যাটর্নি উইলিয়াম গিনসবার্গের সাথে যোগাযোগ করেন, তিনি তাকে তৎক্ষণাৎ এ প্রস্তাব গ্রহণ করতে নিষেধ করেন।

এসময় মনিকা-ক্লিনটনের সম্পর্কের গুজব ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ড্রাজ রিপোর্ট নামের একটি অনলাইন পোর্টাল সর্বপ্রথম এ খবর ছড়ায়। এরপর বেশ কয়েকটি পত্রিকা এ সংবাদ ছাপতে শুরু করে। এমতাবস্থায় জনগণকে আশ্বস্ত করার জন্য এ বিষয়ে বিল ক্লিনটনের বিবৃতি জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। যদিও বিল ক্লিনটন এর আগে কয়েকবার বিভিন্ন সাংবাদিকদের জবাবে সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তবে জনসম্মুখে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি।

আই ডিড নট হ্যাভ সেক্সুয়াল রিলেশনস উইথ দ্যাট উইমেন; ছবিসূত্র: abcnews.com

অবশেষে ২৬ জানুয়ারি, ১৯৯৮; হোয়াইট হাউজ প্রেস কনফারেন্সে ফার্স্ট লেডি হিলারিকে পাশে নিয়ে বিল ক্লিনটন জোর গলায় বলেন, “আই ডিড নট হ্যাভ সেক্সুয়াল রিলেশনস উইথ দ্যাট উইমেন, মিস লিউনস্কি।” এই কেলেঙ্কারি নিয়ে তোলপাড়ের গোটা সময় ধরেই হিলারি বিল ক্লিনটনের পাশে ছিলেন। তিনি এটিকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে চলা ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

জানুয়ারিতে ক্লিনটনের এ অস্বীকারের পর কয়েক মাস ধরে এই মামলার কাজ চলতে থাকে। আর এদিকে পত্র-পত্রিকায় চলতে থাকে নানা জল্পনা কল্পনা। সেসময়টা ছিলো ইন্টারনেটের প্রথম দিকের যুগ। যদিও এখনকার মতো সোশ্যাল মিডিয়ার এত রমরমা সেসময় ছিল না। তবে ই-মেইল ভিত্তিক কমিউনিটিগুলোর ভালোই জনপ্রিয়তা ছিল। ইন্টারনেটের কল্যাণে গোটা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে ক্লিনটনের এ স্ক্যান্ডাল ।

জুলাই মাসের শেষের দিকে মামলাটি এক নাটকীয় মোড় নেয়। কেন স্টারের সাথে  সমঝোতায় আসেন মনিকা লিউনস্কি। গ্র্যান্ড জুরির সামনে তার স্বীকারোক্তির বদলে তাকে এ মামলা থেকে সম্পূর্ণ রেহাই দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। স্বীকারোক্তি দেওয়ার পাশাপাশি মনিকা তার সেই নীল পোশাকটি প্রসিকিউটরের কাছে হস্তান্তর করেন, সেটি থেকে বিল ক্লিনটনের ডিএনএ পাওয়া যায়। স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বিল ক্লিনটন কোর্টে গ্র্যান্ড জুরির সামনে মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন।

মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন ক্লিনটন; source: whaleoil.co.nz

এরপর ১৭ই আগস্ট বিল ক্লিনটন গ্র্যান্ড জুরির সামনে এ সম্পর্কের কথা স্বীকার করে বক্তব্য দেন। এরপর জাতীয় টেলিভিশনে এক বিবৃতিতে তিনি স্বীকার করেন, মনিকা লিউনস্কির সাথে তার ‘ইমপ্রোপার রিলেশনশিপ’ ছিল। তবে তিনি বলেন যে, সম্পূর্ণ যৌনমিলন বলতে যা বোঝায়, লিউনস্কির সাথে তা তিনি কখনো করেননি। উভয়ের সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কোনো অপরাধ নয়। তবে তার বিরুদ্ধে কোর্টকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। শাস্তিস্বরূপ নব্বই হাজার ডলার জরিমানা করা হয় তাকে। পাঁচ বছরের জন্য তার কোর্ট প্র্যাক্টিস নিষিদ্ধ করা হয়।

তবে এ শাস্তির চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, ক্লিনটনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এই কেলেঙ্কারির প্রভাব। এ মামলার জের ধরে যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে অভিশংসনের উদ্যোগ নেয়। অভিশংসন বা ইমপিচমেন্ট হলো একজন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে অপসারণের অনেকগুলো ধাপের একটি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি ছিল অভিশংসনের মাত্র তৃতীয় ঘটনা। হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভে অভিশংসনের পক্ষে অধিক সংখ্যক ভোট দিলেও, সিনেট সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল অভিশংসনের বিপক্ষে। ফলে এ যাত্রায় নিজের মেয়াদ সম্পন্ন করার সুযোগ পান বিল ক্লিনটন।

প্রেসিডেন্ট নির্বা‌চনে হিলারি; source: usmagazine.com

তবে এ কেলেঙ্কারি তার পিছু ছাড়েনি। পরবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের হারে এই কেলেঙ্কারির প্রভাব ছিলো সুস্পষ্ট। এই স্ক্যান্ডাল ফিরে এসেছে, সাম্প্রতিক সময়ে হিলারির নির্বাচনের সময়েও। শুধু ক্লিনটনেরই নয়, এই কেলেঙ্কারি দুর্বিষহ করে তুলেছে মনিকার জীবনকেও। বাইশ বছরের একটি তরুণীর একান্ত গোপন একটি সম্পর্ক রাতারাতি বিশ্ববাজারে উন্মুক্ত হয়ে যায়। একটি সাধারণ মেয়ে পরিণত হয় বিশ্বব্যাপী মানুষের নোংরা রসিকতার খোরাকে। কীভাবে কেটেছে মনিকার সেই দুঃসহ দিনগুলো? তা নিয়ে আলোচনা করা যাবে সামনের কোনো লেখায়। ক্লিনটন-লিউনস্কি স্ক্যান্ডালের উপাখ্যান এ পর্যন্তই থাক।

ফিচার ইমেজ- Dailycaller

Related Articles