আপনার কছে যদি কয়েকটি কোমল পানীয়ের নাম জানতে চাওয়া হয়, তখন নিশ্চিতভাবেই কোকাকোলা, পেপসি, সেভেন আপের পাশাপাশি আপনার মনে যে নামটি চলে আসবে, সেটা হচ্ছে ফান্টা। ফান্টা বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় কোমল পানীয়। কোমল পানীয় হলেও এর আবিষ্কারের নেপথ্যের ঘটনাগুলো মোটেই কোমল নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। এমনকি নাৎসি বাহিনীর সাথেও এর সংযোগ রয়েছে!
এটি বিশ্বের এক নম্বর কোমল পানীয় কোকাকোলার অধীনের একটি পণ্য। এ কারণে ফান্টার কথা বলতে হলে এর সাথে কোকাকোলার প্রসঙ্গ স্বাভাবিকভাবেই চলে আসবে। তাই ফান্টা আবিষ্কারের ইতিহাস জানতে হলে এর আগে সংক্ষেপে কোকাকোলার ইতিহাসটাও জানা জরুরি। কারণ ফান্টা ও কোকাকোলা একটি আরেকটির সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত।
১৮৮৬ সালে জন পেম্বারটন নামক আমেরিকার আটলান্টার একজন ফার্মাসিস্ট কোকাকোলা আবিষ্কার করেন। তখন এটি আটলান্টার একটি স্থানীয় ফার্মেসিতে পাঁচ সেন্ট করে গ্লাসের মাধ্যমে বিক্রি করতেন। তিনি ছিলেন আমেরিকার গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সৈনিক। ব্যাথানাশক মরফিনের বিকল্প হিসেবে এটি বানিয়েছিলেন। তিনি মারা গেলে কোকাকোলার পরবর্তী কর্ণধার আশা ক্যান্ডলার একে সমগ্র আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে দেন। এরপর একে বোতলজাত করে আমেরিকার বাইরেও নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯২৯ সালে কোকাকোলা জার্মানিতে ব্যবসা শুরু করে ‘Coca-cola GmbH’ নামে।
জার্মানিতে কোকাকোলার সাফল্য হয়ে যায় আকাশছোঁয়া। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে প্রতি বছর ৪.৫ মিলিয়ন বক্স পর্যন্ত কোকাকোলার বিক্রি হয়। ১০ বছরের মধ্যে জার্মানিতে কোকাকোলার ৪৩টি বোতলের ফ্যাক্টরি আর ৬০০ ডিস্ট্রিবিউটর হয়ে যায়। আমেরিকার পর কোকাকোলার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার হয়ে যায় জার্মানি। আর এসবের পেছনে যার অবদান ছিল, তিনি হলেন জার্মান বংশদ্ভূত ম্যাক্স কাইট। আজকের ফান্টা আবিষ্কারের পেছনে মূল অবদান তারই। পুরো জার্মানির জনগণের কাছে কোকাকোলাকে পরিচিত করেন তিনি তুমুল প্রচারণার মাধ্যমে।
এদিকে ১৯৩৩ সালে জার্মানির ক্ষমতায় আসেন নাৎসি বাহিনীর প্রধান অ্যাডলফ হিটলার। হিটলারের শাসনামলে ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকের স্পন্সর হয় কোকাকোলা। জার্মানি সর্বোচ্চ ৩৩টি সোনা জিতলে কোকাকোলার ব্যানার সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, যা কোম্পানিতে কাইটের সুনাম আরো বাড়িয়ে দেয়। ১৯৩৮ সালে কোকাকোলার জার্মানির প্রধানের দায়িত্বে থাকা আমেরিকান রে পাওয়ার অটোমোবাইল দুর্ঘটনায় মারা গেলে তার ডান হাত ম্যাক্স কাইট সেই দায়িত্ব পান। কোম্পানির প্রচারণা করার সময় তাকে অনেক সতর্ক থাকতে হতো। সবকিছু জার্মান ভাষায় নিজেদের মতো প্রচারণা করতেন। সরকারকে বোঝাতেন- তিনি শুধু আমেরিকানদের কাছ থেকে ফর্মুলা আর টাকা ধার করে ব্যবসা করছেন, আমেরিকানরা এখানে ব্যবসা করছে না।
১৯৩৯ সালে হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেন। যুদ্ধের কারণে আর সরকারের আমদানীর উপর নতুন নিয়ম আরোপ করায় আমেরিকা থেকে কোকাকোলার কাঁচামাল আসা কমে গেল। কিন্তু কোকাকোলার ব্যবসা থেমে থাকলো না। তারা জার্মানির দখলকৃত দেশগুলোতে সেনাদের পানীয় সরবরাহ করার পাশাপাশি সেসব দেশেও কোকাকোলা ছড়িয়ে দিতে থাকলো।
কিন্তু ১৯৪১ সালে আমেরিকা নিজেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো। তখন আমেরিকা হয়ে গেল জার্মানির শত্রুপক্ষ। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া মানে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসাও নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে গেল। কাইট তখন ভীত হয়ে পড়লেন, তাকে হয়তো জেলে যাওয়া লাগবে আমেরিকান কোম্পানির পরিচালক হওয়ায়। আর তার কোম্পানিকে হয়তো সরকার নিজের অধীনে নিয়ে নেবে, যেটা দুই বিখ্যাত আমেরিকান কোম্পানি জেনারেল মোটরস ও আইবিএম এর কপালে জুটেছিল। অন্যদিকে কোকাকোলার সদর দফতর আটলান্টার সাথে কাইটের যোগাযোগও তখন বন্ধ হয়ে যায়। আমেরিকা থেকে কাঁচামাল আসাও বন্ধ হয়ে গেল।
কাইটের তখন একটাই পথ খোলা ছিল- নাৎসি বাহিনীতে যোগ দেয়া। সৌভাগ্যবশত, বিচার বিভাগের মন্ত্রী ফ্র্যাঞ্জ গারটনার ছিলেন তার বন্ধু। তার মাধ্যমে তিনি শত্রুপক্ষের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। এভাবে তিনি নিজ দেশের পাশাপাশি জার্মানির অধিকৃত ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও নরওয়ের কোকাকোলার ফ্যাক্টরিগুলোও বুঝে নেন।
কিন্তু এতগুলো ফ্যাক্টরি আর কর্মচারী সবই মূল্যহীন হয়ে পড়বে যদি পণ্য উৎপাদনের কিছু না থাকে। কারণ কোকাকোলার মূল উৎস আমেরিকা থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন। তার উপর ভয় আছে যখন তখন সরকার কর্তৃক তার কোম্পানি কেড়ে নেয়ার। তিনি তখন কেমিস্টদের সাথে আলোচনা করে বিকল্প কোনো পানীয় বের করার বুদ্ধি করেন। তারা তখন অন্যান্য খাবারের কারখানায় যেসব উচ্ছিষ্ট অংশ থাকতো, যেমন- আপেলের আঁশ, পনির বানানোর পর দুধের বাকি অংশ, কখনো বা আঙ্গুর- সেগুলো দিয়ে নতুন একটি পানীয় বানানোর চেষ্টা করেন। কাইটের ভাষায় যা ছিল “উচ্ছিষ্টেরও উচ্ছিষ্ট অংশ”।
নতুন এই পানীয়ের নাম দেয়ার জন্য কর্মীদের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করতে বলেন, যেটাকে জার্মান ভাষায় ‘ফ্যান্টাসি’ বলা হয়। তখন কাইটের একজন অভিজ্ঞ সেলসম্যান জো নিপ একে সংক্ষেপে ‘ফান্টা’ বলে ডাকেন। সেই থেকে এই পানীয়ের নাম হয়ে যায় ফান্টা। তখন আর কোনো বিকল্প পানীয় না থাকায় এর বিক্রি বাড়তে থাকে। ১৯৪৩ সালে ৩ মিলিয়ন ফান্টা বিক্রি হয়। এটি শুধু পানীয় হিসেবেই ব্যবহৃত হতো না।চিনির পরিমাণ বেশি থাকায় একে স্যুপের মিষ্টতা বাড়াতেও ব্যবহার করা হতো। এদিকে আটলান্টার সাথে কোনো যোগাযোগ না থাকায় আমেরিকা এসবের কিছুই জানতো না।
এদিকে, যুদ্ধে জার্মান বাহিনীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। প্রতিদিন জার্মান শহরগুলো বোমা হামলার শিকার হতে থাকে। এতে সমগ্র জার্মানি জুড়ে কাইটের যত ফ্যাক্টরি আছে সবই বোমা হামলার শিকার হয়। তার প্রধান কার্যালয় পুরোটাই মাটির সাথে মিশে যায়। ১৯৪৫ এর জানুয়ারিতে নাৎসি সরকার যখন পতনের মুখে, তখন এটি দেশজুড়ে গুপ্তচর নিধন শুরু করে। বিচার বিভাগ তখন আর কাইটের পাশে ছিল না। তখন কাইটের বন্ধু মারা যাওয়ায় তার জায়গায় নতুন মন্ত্রী রোল্যান্ড ফ্রেইজার আসেন। তিনি কাইটকে তলব করেন এবং কোকাকোলার নাম পরিবর্তন করে অন্য নাম দেয়ার জন্য চাপ দেন। একই সাথে কোকাকোলাকে জাতীয়করণের কার্যক্রম শুরু করা হয়।
সৌভাগ্যবশত, পরের সপ্তাহেই বিচার বিভাগের অফিসে বোমা হামলা হয় এবং ফ্রেইজার মারা যান। কাইট তখন বিধ্বস্ত ফ্যাক্টরিগুলোতেই ফান্টার উৎপাদন চালিয়ে যান। এর মাস তিনেক পর ১৯৪৫ সালের মে মাসে আমেরিকানরা জার্মানি দখল করলে কাইটকে একটি বিধ্বস্ত ফ্যাক্টরিতে খুঁজে পায়। কাইট তখন টেলিগ্রামের মাধ্যমে আমেরিকায় জানিয়ে দেন- কোকাকোলা এখনো জার্মানিতে সচল আছে।
তখন একটা সন্দেহ দেখা দেয় কাইট নাৎসি বাহিনীর লোক কি না সেটা নিয়ে। কিন্তু তদন্ত করে দেখা যায়- কাইটের সাথে নাৎসিদের ভালো সম্পর্ক থাকলেও তিনি সরাসরি নাৎসি বাহিনীর সাথে জড়িত ছিলেন না। তাকে চাপ দেয়া হয়েছিল নাৎসি বাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এছাড়া তিনি ফান্টা নিজের অধীনে বিক্রি করেও বড় ব্যবসায়ী হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে জার্মানিতে কোকাকোলার ফ্যাক্টরিগুলো সচল রেখেছেন এবং এই কারণে কোকাকোলাতে কাজ করা অনেক শ্রমিক যুদ্ধের ভয়াবহ সময়েও জীবিত থাকতে পেরেছিল। যুদ্ধ শেষ হলে তিনি কোকাকোলা কোম্পানিকে স্বাগত জানান এবং ফান্টা থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ বুঝিয়ে দেন।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই জার্মানিতে আবার কোকাকোলার উৎপাদন শুরু করেন। এসব কারণে ম্যাক্স কাইট আমেরিকানদের কাছে নায়ক হয়ে গেলেন। আমেরিকানরা তার অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করতে থাকলো। তার এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে কোকাকোলা ইউরোপের প্রেসিডেন্ট পদের দায়িত্ব দেয়া হয়। এদিকে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ফান্টার বিক্রিও বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে সেটা ছিল সাময়িক বিরতি।
সঠিক গবেষণা ও উপযুক্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে ১৯৫৫ সালে আবার ফান্টা বিক্রি শুরু হয় কমলার ফ্লেভার দিয়ে। শুরুটা শুধু ইতালিতে হলেও ধীরে ধীরে একে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো হয়। ১৯৫৮ সালে আমেরিকাতেও চালু হয়। বর্তমানে এর ৭০টি বিভিন্ন ধরনের ফ্লেভার বিশ্বব্যাপী ১৯০টিরও বেশি দেশে বিক্রি হয়। দেশভেদে এর ভিন্ন ধরনের নামও আছে। যেমন- পানামাতে একে ‘কিস্ট’ নামে ডাকা হয়।
ফান্টার আবিষ্কার নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক বিতর্ক ও মিথ। অনেকে মনে করেন, ফান্টা নাৎসিদের আবিষ্কার। কেউ কেউ বলেন, ম্যাক্স কাইট একজন নাৎসি ছিলেন। কারণ নিজে নাৎসি না হলে ঐ সময়ে এভাবে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারতেন না। তবে তাকে একজন কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখতেই সবাই পছন্দ করেন, যিনি একইসাথে শত্রু এবং নাৎসি সরকার দু'পক্ষের সাথেই সম্পর্ক ভালো রেখেছিলেন।অনেকে মনে করেন, জার্মানি যুদ্ধে জিতলে তিনি হবেন সমগ্র কোকাকোলা কোম্পানির প্রধান এই আশাতেই কোকাকোলা সচল রাখেন। তিনি যদি সেটা করেও থাকেন, তার সেই আশা আংশিক হলেও পূর্ণ হয়েছে।
এসব বিতর্কের কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা সেটি ইতিহাসের কাছেই তোলা থাক। কোমল পানীয় ফান্টার আবিষ্কার যে একটি চমকপ্রদ ঘটনা এতে অবশ্যই কোনো সন্দেহ নেই।
This is a Bangla article about the history of soft drink called Fanta.The references are hyperlinked inside the article.
Featured image: fanta.com