Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জীবন্ত ছবির ইতিহাস

২০১৩ সালের বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের মানব পতাকা তৈরির সংবাদটি নিশ্চয়ই আমাদের সবারই মনে আছে। সে সময় এই উদ্যোগটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ২৭,০০০ মানুষের অংশগ্রহণে তৈরি মানব পতাকাটি ছিল ঐ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানব পতাকা। এবং সে সময় এটি গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডেও স্থান করে নিয়েছিল।

স্ট্যাচু অফ লিবার্টির লিভিং ফটোগ্রাফ; Source: publicdomainreview.org

মানুষকে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে কোনো প্রতীক বা চিহ্নের আকৃতি ফুটিয়ে তোলার দৃষ্টান্ত অবশ্য নতুন কিছু না। বৃহৎ পরিসরে এর উদ্যোগ প্রথম দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ১ম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, তখন জনগণের তাতে খুব একটা সায় ছিল না। মার্কিন সেনাবাহিনী তখন জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্য কার্যকর প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত মার্কিন ফটোগ্রাফার আর্থার মোল এবং তার সহকারী জন থমাসকে দায়িত্ব দেয় দলবদ্ধ সেনা সদস্যদের কিছু ছবি তোলার জন্য, যা দেখে সেনা সদস্যদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা এবং সমর্থন বৃদ্ধি পাবে।

১৯১৫ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত মোল এবং থমাস যুক্তরাষ্ট্রের ১৮টি মিলিটারি এবং ট্রেনিং বেসে ভ্রমণ করেন। এই সময়ের মধ্যে তারা সেনাবাহিনীর হাজার হাজার কর্মচারীর সহযোগিতায় ৩০টি দেশাত্মবোধক ছবি ধারণ করেন। মোল তার তোলা এই ছবিগুলোর নামকরণ করেন ‘লিভিং ফটোগ্রাফস’ বা জীবন্ত ছবি। জীবিত মানুষের মাধ্যমে ছবির বিষয়বস্তু ফুটিয়ে তোলার কারণেই এই নামকরণ। ছবিগুলো ধারণ করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। প্রতিটি ছবি তোলার জন্য আক্ষরিক অর্থেই তাদেরকে সামরিক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতে হতো। অধিকাংশ ছবি তোলার পূর্বে তাদেরকে এক সপ্তাহ বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি নিতে হতো।

প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের লিভিং ফটোগ্রাফ; Source: publicdomainreview.org

একটি ছবি তোলার জন্য প্রথমে মাঠের উপর টেপ দিয়ে অথবা তার এবং তারকাটা দিয়ে এর অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হতো। মাঠের সুবিধাজনক এক কোনে ৮০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি টাওয়ার তৈরি করা হতো ক্যামেরা স্থাপনের জন্য, যেখান থেকে ছবিটি সবচেয়ে সুন্দরভাবে ফুটে উঠবে। মোল একটি মেগাফোন হাতে নিয়ে ক্যামেরার লেন্সের মধ্য দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন এবং লম্বা একটি লাঠি দিয়ে ইশারা দিয়ে শ্রমিকদেরকে নির্দেশ দিতেন কোনদিকে কীভাবে তারকাটা গেঁথে ছবিটির আকৃতি তৈরি করা হবে। অধিকাংশ ছবির ক্ষেত্রেই কয়েক বর্গ মাইল এলাকাজুড়ে এই বিরক্তিকর এবং পরিশ্রমের কাজটি করতেই সপ্তাহখানেক পেরিয়ে যেতো। তাদের কোনো কোনো প্রকল্পে ৩০,০০০ সৈন্য পর্যন্ত অংশ নিত।

ছবির কাঠামো তৈরি হয়ে যাওয়ার পরের কাজটুকু বেশ সহজ। মোলের সহকারী থমাস হাজার হাজার সেনা সদস্য এবং কর্মচারীকে এনে মোলের নির্দেশ অনুযায়ী কাঠামোর ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিতেন। এক্ষেত্রে পোশাকের রং ছাড়াও আরেকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্ব পেত, সেটি হচ্ছে মানুষের ঘনত্ব। একটি ছবি কতটুকু বাস্তসম্মতভাবে ফুটে উঠবে, সেটি নির্ভর করে ছবিটির কোন জায়গায়া মানুষের ঘনত্ব কত কম-বেশি, তার সুনিপুণ ব্যবহারের উপর। সবকিছু সম্পন্ন হওয়ার পরেও অবশ্য মাটি থেকে আনুভূমিকভাবে, অথবা একেবারে খাড়াভাবে তার গুরুত্ব বোঝা যেত না। মনে হতো হাজার হাজার মানুষ অর্থহীনভাবে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কেবল মাত্র নির্দিষ্ট একটি দৃষ্টিকোণ থেকেই ছবিটি অর্থবহ হয়ে উঠত। সেটি হচ্ছে মোলের ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ।

আংকেল স্যামের লিভিং ফটোগ্রাফ; Source: publicdomainreview.org

১৯১৭ সালের ন্যাশনাল মেমোরিয়াল ডে উপলক্ষে মোল এবং থমাস তাদের সর্বপ্রথম লিভিং ফটোগ্রাফ তোলার আয়োজন করেন। তারা ইলিনয়ের গ্রেট লেকে অবস্থিত ন্যাভাল ট্রেনিং স্টেশনে যান এবং সেখানকার ১০,০০০ নাবিককে জড়ো করেন। এরপর তাদেরকে জায়গা মতো দাঁড় করিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঢেউ খেলানো একটি পতাকার অবয়ব নির্মাণ করেন। মোলের তোলা ১১ ইঞ্চি প্রস্থ এবং ১৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এই মার্কিন পতাকাটিই ছিল বিশ্বের প্রথম বড় মাপের জীবন্ত ছবি, যা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়। পরবর্তীতে এই ছবিটি দ্য রিক্রুটার নামে একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।

পরবর্তী চার বছর ধরে মোলের তোলা ৩০টি লিভিং ফটোগ্রাফের মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবি হল স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। এটি তৈরি করতে তারা ১৮,০০০ সৈন্যকে ব্যবহার করেছিলেন। আইওয়া অঙ্গরাজ্যের ক্যাম্প ডজে এই ছবিটি তৈরির সময় এই ১৮,০০০ সৈন্যকে ৩৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল।

নৌবাহিনীর প্রতীকের লিভিং ফটোগ্রাফ; Source: publicdomainreview.org

ক্যামেরার তীর্যক দৃষ্টিকোণের কারণে স্ট্যাচুটিকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য এর নিচের অংশের তুলনায় উপরের অংশে বেশি মানুষকে স্থান দিতে হয়েছিল। ১৮,০০০ সৈন্যের মধ্যে ১৬,০০০ সৈন্যকেই স্থান দেওয়া হয়েছিল মশাল এবং হাতের স্থানে, অন্যদিকে বাকি পুরো শরীরের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল বাকি ২,০০০ সৈন্যকে। এর মধ্যে স্ট্যাচুটির পাদদেশের ভূমির অবয়ব ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহার করা হয়েছিল মাত্র ১৮ জন সৈন্যকে, অথচ কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত মশালটিকে ফুটিয়ে তুলতে প্রয়োজন হয়েছিল ১২,০০০ সৈন্যের। ঘনত্বের এই অসম ব্যবহারের ফলেই মশালটিকে দেখতে গাঢ় এবং জীবন্ত মনে হয়।

এই ছবিটি থেকেই মোলের অসাধারণ শিল্পীসত্ত্বার প্রমাণ মিলে। যদি সোজা উপর থেকে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির কোনো ছবি তোলা হতো, তাহলে দেখা যেত, সেটি স্ট্যাচুটির একটি বিকৃত সংস্করণ হয়েছে, যার একদিক সরু, একদিক মোটা, আনুপাতিকভাবে অতিরিক্ত লম্বা। কিন্তু মোলের ক্যামেরায় এই স্ট্যাচুটিই ধরা পড়েছে সম্পূর্ণ বাস্তবসম্মতভাবে।

মার্কিন পতাকার লিভিং ফটোগ্রাফ; Source: blogs.loc.gov

মোলের তোলা আরেকটি উল্লেখযোগ্য জীবন্ত ছবি হলো প্রেসিডেন্ট ঊড্রো উইলসনের ছবি। ১৯১৮ সালে ওহাইওর ক্যাম্প শেরম্যানে ২১,০০০ সৈন্যের সহায়তার তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখাবয়ব প্রায় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলেন মোল এবং থমাস।

এছাড়াও, মোলের মেশিনগান ইনসিগনিয়াও উল্লেখযোগ্য একটি ছবি। জর্জিয়ার ক্যাম্প হ্যানককে এই ছবিটি ধারণ করা হয়েছিল। ১৯১৮ সালে তোলা এই ছবিটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল ২২,৫০০ সৈন্য এবং ৬০০ মেশিনগান। এই ছবিতে মার্কিন জাতীয় প্রতীক ঈগলের সাথে সাথে মেশিনগান ট্রেনিং সেন্টারের প্রতীকের জীবন্ত রূপ ফুটে ওঠে।

মার্কিন ঈগলের লিভিং ফটোগ্রাফ; Source: mashable.com

মোলের তৈরি করা ছবিগুলো সংগৃহীত হয়েছে ‘লিভিং ফটোগ্রাফস’ নামক একটি বইয়ে, যার ভূমিকা লিখেছেন ইতিহাসবিদ লুই কাপলান। তিনি বলেন, বহুল প্রচারিত এই ছবিগুলো আমেরিকান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেছিল এমন একটা সময়ে, যখন দেশপ্রেমের প্রতি মানুষের উৎসাহ এবং জাতীয় আত্ম-সচেতনতার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। তার মতে, এই ছবিগুলো যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রপাগান্ডা হিসেবে কাজ করেছে।

যদিও মোল তার এই অভিনব সৃষ্টিকে জীবন্ত ছবি হিসেবে আখ্যায়িত করেন এই যুক্তিতে যে, সেগুলো জীবন্ত মানুষের সাহায্যে তৈরি, ইতিহাসবিদ কাপলান তার সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, শিল্পীর দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, জীবন্ত মানুষদেরকে ব্যবহার করে প্রতীকগুলোর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করা হয়েছে, কিন্তু বিষয়টিকে বিপরীত দিক থেকেও দেখা সম্ভব। এই ছবিগুলোকে তুলতে গিয়ে প্রকারান্তরে জীবন্ত মানুষগুলোকে প্রতীকের মতো প্রাণহীন বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে।

মেশিনগান ট্রেনিং সেন্টারের প্রতীকের লিভিং ফটোগ্রাফ; Source: mashable.com

তার মতে, শুধুমাত্র একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই দৃষ্টিভ্রমের কারণে প্রতীকগুলোকে জীবন্ত মনে হয়। কিন্তু এছাড়া পুরো সময়টিতে তা প্রাণহীন থাকে। তার মতে, জীবন্ত মানুষকের পরিচয় এবং সত্ত্বাকে গুরুত্বহীনভাবে প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশের মাধ্যমে সমাজের অন্তর্নিহিত ফ্যাসিজমের প্রবণতারই পরিচয় মেলে।

ফিচার ইমেজ- stationbd.blogspot.com

Related Articles