Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নববর্ষের ওয়াদা এবং আধুনিক বর্ষপঞ্জিকার রীতি এলো যেভাবে

নতুন বছরে আমাদের সবারই অনেক ধরনের পরিকল্পনা থাকে। কেউ চিন্তা করে নতুন ব্যবসা শুরু করার কথা, কেউ চায় পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে, কেউবা আবার নতুনভাবে জীবন সাজানোর চেষ্টা করে। যার যেমন পরিকল্পনা থাকুক না কেন, কম-বেশি আমরা সবাই নতুন বছরকে সামনে রেখে কিছু না কিছু ওয়াদা করি, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কখনোই পূরণ করা হয় না! কিন্তু তবুও প্রতি বছর আমরা নতুন কিছুর আশায় এই ওয়াদা করে থাকি!

কখনও কি ভেবেছেন, এই নববর্ষের ওয়াদা পালন বা নিউ ইয়ার রেজ্যুলোশনের রীতি কোথা থেকে এলো? কেনই বা বিভিন্ন গোষ্ঠী এত ঘটা করে নববর্ষ পালন করে? আজকে আমরা এমনই কিছু প্রশ্নের সমাধান বের করবো। এই সব প্রশ্নের উত্তরের ইতিহাস বের করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বর্ষপঞ্জিকায় যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, সে ব্যাপারেও জানতে হবে।

এখন থেকে ৪০০০ বছর আগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে একটু ফেরত যাওয়া যাক। সে সময়ের মিশরীয় বর্ষপঞ্জিকায় মার্চ মাসকে নতুন বছরের শুরু হিসেবে ধরা হয়। তারা মার্চের ১ তারিখে নববর্ষ পালন করতো এবং মার্চের মাঝামাঝি সময়ে নতুন বছর উপলক্ষে একটি বিশেষ উৎসব পালন করতো। এর নাম ছিলো ‘আকিতু’, অর্থাৎ ‘বছরের সূচনা’। এ সময় তারা ফসলের নতুন বীজ রোপন করতো। ১২ দিনের এই উৎসবে তারা নতুন বছরের জন্য তাদের নতুন নেতা নির্বাচন করতো অথবা আগের নেতার প্রতিই আনুগত্য প্রদর্শন করতো। একইসাথে ঈশ্বরের কাছে অনুগ্রহ বা ক্ষমা প্রার্থনা করতো। এই অনুগ্রহ প্রার্থনাকে আমাদের সময়ের নববর্ষের ওয়াদার সাথে তুলনা করা যায়।

মাটির ফলকে আকিতু উৎসবের কথা; image source: www.history.com

তবে সেসময়ের মিশরীয়দের কাছে এই অনুগ্রহ প্রার্থনার উদ্দেশ্য ছিলো ভিন্ন। মিশরীয়রা তাদের ঈশ্বরের কাছে এই বলে প্রার্থনা করতো যে, আগের বছর তারা অন্যদের কাছ থেকে যা কিছু বাকি এনেছিলো বা ধার এনেছিলো, তার সবকিছু সময়ের মধ্যে ফেরত দিয়ে দেবে। তাদের এই বিশ্বাস ছিলো যে, যদি তারা ওয়াদা পালন করে, তবেই ঈশ্বর তাদের প্রতি অনুগ্রহ দেখাবেন। আর যদি তারা ওয়াদা ভঙ্গ করে, তবে ঈশ্বর তাদের প্রতি বিরক্ত হবেন। আর এর ফলে তাদের উপর দুর্ভোগ নেমে আসবে। এজন্য তারা সবসময় চেষ্টা করতো তাদের ওয়াদা পালন করার। আর আমরা তো এখন নববর্ষের ওয়াদা করার দুদিন পরেই সব ভুলে যাই। ধার করা টাকা শোধ করা তো পরের কথা!

২০০০ খ্রিস্টপূর্বে মিশরীয় সভ্যতার নিদর্শন; image source: Channel 4

এখানে বলে রাখা ভালো, সে সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ শতাব্দীতে বর্তমানের মতো ১২ মাসে ১ বছর হিসাব করা হতো না। মিশরীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী, তারা হিসাব করতো ১০ মাসে ১ বছর! এর প্রমাণ পাওয়া যায় বর্তমান মাসগুলোর নাম একটু ভালোমতো খেয়াল করলেই। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর এই মাসগুলোর নাম এসেছে ল্যাটিন শব্দ থেকে। ল্যাটিন বর্ণমালা অনুযায়ী, সেপ্টে = সাত, অক্টো = আট, নভেম = নয় ও ডিসেম = দশ। কিন্তু বর্তমানের গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী এগুলো যথাক্রমে ৯ম, ১০ম, ১১তম এবং ১২তম মাস। শুরুতেই বলেছি, মিশরীয়রা বছরের হিসাব শুরু করতো মার্চ মাস থেকে। তাহলে জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি কোথা থেকে এলো? প্রকৃতপক্ষে, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসের কোনো অস্তিত্বই ছিলোই না তখন! এই জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাস বর্তমান পঞ্জিকায় কীভাবে আসলো, তারই গল্প বলবো এখন।

খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সালে রোমান সভ্যতা আবিষ্কারের সময় থেকেই তারা চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী দিনের হিসাব রাখতো। ১০ মাসের ১ বছর অর্থাৎ ৩০৪ দিনে বছর হিসাব করতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। বিশেষ করে কোন ঋতুতে কোন মাস আসবে, তার কোনো ঠিক ছিলো না। এজন্য প্রতি বছর তাদের পঞ্জিকা সংস্কার করতে হতো। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে প্রথম এগিয়ে এলেন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার। তিনিই প্রথম ১২ মাসে ১ বছর হিসাব করে পৃথিবীকে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। 

সম্রাট জুলিয়াস সিজারের প্রতিকৃতি; image source: History on the Net

খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালে সম্রাট সিজার আলেকজান্দ্রিয়ার জ্যোতির্বিজ্ঞানী সোসিগনেসকে দায়িত্ব দেন এই সমস্যা সমাধানের। সোসিগনেস তখন মিশরীয়দের ক্যালেন্ডারের ধরনে ফিরে গেলেন। মিশরীয়রা শুরু থেকেই ১০ মাসে বছর হিসাব করলেও, তারা সৌর বছর অনুযায়ী দিনের হিসাব করতো। সোসিগনেস সেই চিন্তাধারা থেকেই সর্বপ্রথম ৩৬৫.২৪২১৯৯ দিনে এক বছর হিসাব করলেন। অর্থাৎ ৩৬৫ দিন পার হয়ে আরও ১ দিনের ৪ ভাগের ১ ভাগ। সেই সময় অতিরিক্ত ৬৭ দিন যোগ করে সম্রাট সিজার তার সময়কালকে এক বছর পিছিয়ে ৪৬ খ্রিস্টপূর্বে নিয়ে যান এবং জানুয়ারির ১ তারিখকে বছরের প্রথম দিন ঘোষণা করেন। তখন থেকেই রোমে জানুয়ারির ১ তারিখ নববর্ষ পালনের রীতি চালু হয়। তিনি এই পঞ্জিকার নাম দেন জুলিয়ান পঞ্জিকা।

সম্রাট অগাস্টাস সিজার, যার নামে আগস্ট মাসের নামকরণ হয়; image source: My Hero

৪৪ খ্রিস্টপূর্বে সিজার আততায়ীর হাতে খুন হবার আগেই তিনি জুলিয়ান পঞ্জিকায় কিছু পরিবর্তন এনে যান। বর্তমানে আমরা জুলাই বলে যে মাসটিকে চিনি, তার পূর্ব নাম ছিলো কুইনটিলিস। সিজার নিজের নামে এই মাসের নামকরণ করেন জুলিয়াস। আর বর্তমান আগস্ট মাসের পূর্বনাম ছিলো সেক্সটিলিস। নিজের উত্তরসূরী পুত্রের নামে এর নামকরণ করেন অগাস্টাস। আর জানুয়ারি মাসের নাম আসে রোমান ঈশ্বর জ্যানাস থেকে। রোমানদের কাছে জ্যানাস হলেন সবকিছুর শুরু এবং শেষের দেবতা। ফেব্রুয়ারির নাম এসেছে একটি উৎসব ফেব্রুয়ারিলা থেকে। ফেব্রুয়ারিলা হলো আত্মশুদ্ধির একটি উৎসব।

মধ্যযুগে, অর্থাৎ ৫০০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দে এই নববর্ষ পালনের রীতি বেশ জমে ওঠে। কিন্তু এই জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নিয়েও সবাই সন্তুষ্ট ছিলেন না। কারণ, সম্রাট জুলিয়াস সিজার এবং জ্যোতিবিজ্ঞানী সোসিগনেসের হিসাবে কিছু ভুল ছিলো। ৩৬৫ দিনের পর একদিনের পুরো ৪ ভাগের ১ ভাগ অর্থাৎ ৩৬৫.২৫ দিনে এক বছরের হিসাব বলা হলেও, প্রকৃতপক্ষে হিসাবটা ছিলো ৩৬৫.২৪২১৯৯ দিনের। তাই প্রতি বছরই ১১ মিনিটের একটি ব্যবধান তৈরি হচ্ছিলো। এই ব্যবধানটা প্রতি ১০০০ বছরে ১১ দিনের একটি পার্থক্য তৈরি করে দিচ্ছিলো।

প্রাচীন রোমান সভ্যতা; image source: thinglink.com 

রোমান চার্চ এই সমস্যার ব্যাপারে অবহিত ছিলেন। ১৫৭০ সালে পোপ ১৩তম গ্রেগরী জেসুইট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার ক্ল্যাভিয়াসকে এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেন। ১৫৮২ সালে ক্রিস্টোফার বর্তমানের গ্রেগরীয়ান পঞ্জিকার রূপ প্রদান করেন। প্রতি এক হাজার বছরে ১১ দিনের হিসাব মেলানোর জন্য তিনি লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষের প্রবর্তন করেন। এই নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি ৪ বছর পর পর ফেব্রুয়ারি মাসে একদিন অতিরিক্ত হিসাব করা হবে। এই বর্ষপঞ্জিকা ধরেই বর্তমানের সবদিন হিসাব করা হয়।

আধুনিক বর্ষপঞ্জিকার প্রবর্তন আর নববর্ষের সূচনার গল্প তো জানা গেলো। কিন্তু নববর্ষের ওয়াদার কী হলো? এবার বলছি সে গল্প। ১৭৪০ সালে ইংরেজ পাদ্রী জন ওয়েসলি এক নতুন রীতি চালু করেন। এর নাম ছিলো চুক্তি নবায়ন সেবা। নববর্ষের আগের রাতে কিংবা নববর্ষের প্রথমদিন সন্ধ্যায় সবাই একসাথে হয়ে ধর্মীয়গ্রন্থ পাঠ করতো, একসাথে ধর্মীয় গান গাইতো আবার প্রেতাত্মাদের সাথে কথাও বলতো! এর আরেক নাম ছিলো রাত্রিযাপন সেবা। মূলত নববর্ষকে স্বাগত জানানোর জন্য এই আয়োজন। এসময় তারা বিভিন্ন ধরনের ওয়াদা করতো নতুন বছরকে সামনে রেখে। এখান থেকেই আজকের আধুনিক নিউ ইয়ার রেজ্যুলোশনের শুরু।

বর্তমান সময়ে নববর্ষের রাত যেমন হয়; image source: Wien.info

এখানে ধর্মীয় রীতির কথা বলা হলেও, বর্তমানে প্রায় সবাই নতুন বছরের জন্য নিজ নিজ লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। সবাই চায় সামনের বছরটা ভালো কাটুক। বিভিন্ন দেশে তো নতুন বছর উপলক্ষে বর্ণিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তবে আজকের নববর্ষের প্রায় সকল রীতি যে ৪০০০ বছর পূর্বে মিশরীয়দের থেকে শুরু হয়েছে, তা তো বলাই যায়।

This article is in Bangla language. It's about new year resolution. Necessary sources have been hyperlinked.

Feature Image: youtube

Related Articles