ইউরোপের অনেকে দেশেই আঠারো শতকে এক বিশাল ঘটনা ঘটে। ইউরোপীয় রেনেসাঁর পর সমাজে চার্চের প্রভাব অনেক কমে আসে। এতদিন যারা বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতেন, তাদেরকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়েছিল। চার্চের বেঁধে দেয়া নিয়মের বাইরে গেলেই যে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে– এটি ছিল একেবারে নিশ্চিত ঘটনা। কিন্তু রেনেসাঁর পর সমাজে চার্চের প্রভাব কমে আসে, কয়েক শতক ধরে স্থির হয়ে থাকা বিজ্ঞান নতুন উদ্যমে পা ফেলতে শুরু করে। বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় গতানুগতিক বহু ক্ষেত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। বিজ্ঞানের নতুন পথচলাতেই একসময় ইউরোপের বেশ কিছু দেশে শিল্পবিপ্লব হয়। আগে কৃষিকে কেন্দ্র করে দেশগুলোর অর্থনীতি আবর্তিত হতো। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পর কৃষির ভূমিকা শুধু শিল্পপণ্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল সরবরাহের মধ্যেই সীমিত হয়ে যায়। আগে যেখানে জমিদাররা সমাজের অভিজাত শ্রেণী হিসেবে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতেন, শিল্পবিপ্লবের পর বুর্জোয়া শিল্পপতিরা সমাজের নতুন অভিজাত শ্রেণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
শিল্পবিপ্লবের প্রধান ছোঁয়া লেগেছিল দেশগুলোর অর্থনীতিতে। শিল্পবিপ্লবের আগে দেশগুলোতে শিল্পখাত তেমন বিস্তার লাভ করতে পারেনি। আসলে একটা শিল্পের বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় হলো আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন, যেটা শিল্পবিপ্লবের আগে হয়নি। আগেই বলা হয়েছে, চার্চের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার পর বিজ্ঞান নতুন উদ্যমে হাঁটা শুরু করে। বিজ্ঞানের প্রচেষ্টায় শিল্পকারখানার উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধির মতো প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে শিল্পকারখানাগুলো এত বেশি পরিমাণ শিল্পপণ্য উৎপাদন করতে পেরেছিল যে, দেশের চাহিদা তো মিটেছিলই, রপ্তানি করার মতো উৎপাদনও সম্ভব হয়েছিল। শিল্পবিপ্লবের পর বুর্জোয়ারা নিজেদের কাছে জমানোর পুঁজির মাধ্যমে শিল্পকারখানা স্থাপন করেন। শিল্পবিপ্লবের আগে গ্রামে যারা কৃষিশ্রমিক ছিল, তারা পেশাবদলের মাধ্যমে শহরে এসে শিল্পশ্রমিকে রূপান্তরিত হয়। শহরগুলো হয়ে ওঠে অর্থনীতির নতুন প্রাণকেন্দ্র।
বাড়তি শিল্পপণ্য রপ্তানির জন্য শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়া ইউরোপের দেশগুলোর কাছে প্রয়োজন ছিল বাইরের দেশের বাজার। এজন্য দেশগুলোর ব্যবসায়ীরা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দেশে পৌঁছান। তাদের তৈরি শিল্পপণ্যগুলো দেখে স্থানীয় মানুষেরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। তারা সেগুলো কেনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। যেমন- কাপড়ের কথাই বলা যাক। ইংল্যান্ডের কারখানায় উৎপাদিত স্বল্পমূল্যের কাপড় যখন ভারতবর্ষে নিয়ে আসা হয়, তখন সেগুলোর বিশাল চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় মানুষেরা জানত না, এই বিদেশি কাপড়ের উপর নির্ভরশীলতা একসময় তাদের স্থানীয় শিল্পগুলোকে ধ্বংস করে দেবে। একসময় ব্যবসা করতে আসা বিদেশি বণিকেরা স্থানীয় কুচক্রীমহলের সাথে হাত মিলিয়ে দেশগুলোর ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে। উপনিবেশগুলোতে বৈদেশিক বাণিজ্যের নামে আরও বেশি করে অর্থনৈতিক শোষণ চলতে থাকে। ঔপনিবেশিক শাসকেরা উপনিবেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে নিজ দেশের আইন-কানুন চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
আমরা দেখতেই পাচ্ছি, শিল্পবিপ্লবের ফলে বাইরের বাজারে ব্যবসা সম্প্রসারণের যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সেখান থেকেই একসময় অভিশপ্ত ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। উপনিবেশগুলোতে দারিদ্র্যের কারণে অপরাধ সংঘটনের হার বেশি ছিল। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করা দেশগুলোতে এই ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল যে, উপনিবেশগুলোর মানুষেরা খুব বেশি সভ্যতার আলো পায়নি। উপনিবেশগুলোতে ইউরোপীয় প্রশাসনিক ব্যক্তিদের দায়িত্ব ছিল আধুনিক শাসনব্যবস্থা প্রচলন করা, অপরাধ দমনের জন্য আধুনিক বিচারব্যবস্থা প্রণয়ন করা, কৃষিখাতের গুরুত্ব কমিয়ে অর্থনীতিতে শিল্পখাতের প্রভাব বাড়ানো সর্বোপরি সবদিক থেকে উপনিবেশের আধুনিকায়ন করতে হবে। কিন্তু উপনিবেশিক শাসকেরা এটা ভাবার প্রয়োজন করেনি যে, ইউরোপের সমাজব্যবস্থায় যেধরনের নীতি বাস্তবায়ন করা গিয়েছে, সেটি উপনিবেশের ক্ষেত্রেও সেটি বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে কিনা।
সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো আফ্রিকাও ইউরোপের উপনিবেশে পরিণত হয়। আফ্রিকার মানুষেরা চামড়ার রংয়ের জন্য নিজ দেশেই বর্ণবৈষম্যের শিকার হতেন। উন্নত পড়াশোনা, উন্নত চিকিৎসা কিংবা উন্নত জীবিকার জন্য যখন তারা আমেরিকা কিংবা ইউরোপে গমন করতেন, তখন দেখা যেত তাদেরকে সেখানে আরও তীব্র বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলোতে কাজের সংকট থাকায় অনেকে আমেরিকায় যেতেন। নিজ দেশে ছিলেন তারা স্বাধীন, অথচ আমেরিকায় এলে দেখা যেত তাদের কোনো নাগরিক অধিকারের বালাই নেই, উল্টো দাস বানিয়ে রাখা হয়েছে। ইউরোপে দেখা যেত- গন্তব্যে যাওয়ার জন্য কোনো কৃষ্ণাঙ্গ বাসে উঠেছে, তাকে কোনো কারণ ছাড়াই বাস থেকে নেমে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। কোথাও খেতে গেলে দেখা যেত হোটেলের বাকি মানুষরা কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে নিয়ে ব্যঙ্গ করছে।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আগত যেসব মানুষ ইউরোপ ও আমেরিকায় এসে কৃষ্ণাঙ্গদের উপর এ ধরনের বর্ণবাদী আচরণ লক্ষ্য করেছিলেন এবং নিজেও এর শিকার হয়েছিলেন, তারা কৃষাঙ্গদের মুক্তি ও নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য একত্রিত হয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন, যে জীববিজ্ঞানের সূত্রানুযায়ী আফ্রিকানদেরকে ইউরোপিয়ানদের তুলনায় পিছিয়ে রাখা হয়েছে, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। যেহেতু আফ্রিকা থেকে আগত মানুষদের সবার মাঝে কিছু সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে, তাই সবাইকে যৌথভাবে নিজেদের অধিকার ও মুক্তির জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। মূলত 'প্যান আফ্রিকানিজম' ছিল এমন এক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন, যে আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপ ও আমেরিকায় যেসব আফ্রিকান বংশোদ্ভূত নাগরিক ছিলেন, তাদের মুক্তির জন্য একত্রিতভাবে সংগ্রাম করা।
প্রথদিকে প্যান আফ্রিকানিজম আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিরা ছিলেন মার্টিন ডিলানি এবং আলেক্সান্ডার ক্রামেল। মার্টিন ডিলানি মনে করতেন, শ্বেতাঙ্গদের পাশাপাশি থেকে কখনোই কৃষ্ণাঙ্গদের উন্নতি সম্ভব নয়। এজন্য তিনি তার লেখালেখিতে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য আলাদা ভূখন্ডের প্রস্তাব করেন। তখন অনেক ব্যক্তিই ডিলানির লেখালেখিতে প্রভাবিত হন, এবং তারা সিদ্ধান্ত নেন, আলাদা ভূখন্ডের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো স্থান আফ্রিকা মহাদেশ। তারা প্রচার করতে শুরু করেন যে, যেসব আফ্রিকান-আমেরিকান রয়েছে, তাদের উচিত শিক্ষাগ্রহণের পর আফ্রিকায় ফিরে যাওয়া ও স্থানীয় আফ্রিকান নাগরিকদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। প্যান আফ্রিকানিজম আন্দোলনের আরেকজন বিখ্যাত তাত্ত্বিক ডব্লিউ. ই. বি দ্যু বোয়া। তিনি ইউরোপের সমস্যাগুলো চমৎকারভাবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, আফ্রো-আমেরিকানদের সামাজিক অস্তিত্বকে ইউরোপ ও আমেরিকা একটি 'সমস্যা' হিসেবে গণ্য করে এবং তারা এই সমস্যার নাম দিয়েছে 'নিগ্রো প্রবলেম'। ইউরোপ ও আমেরিকায় আফ্রিকানদের বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠতে শুরু করে। যেমন: মার্কাস গের্ভির 'ইউনিভার্সাল নিগ্রো ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন', ব্যারিস্টার হেনরি সিলভেস্টার-উইলিয়ামসের 'আফ্রিকান অ্যাসোসিয়েশন অব লন্ডন', প্যান আফ্রিকান কংগ্রেস ইত্যাদি।
অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, আমেরিকায় ও ইউরোপে কৃষ্ণাঙ্গদের 'সিভিল রাইটস মুভমেন্ট' এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আফ্রিকার দেশগুলোতে যে উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার পেছনে প্রধান কারণ ছিল প্যান আফ্রিকানিজম। দুটো আন্দোলনই শেষপর্যন্ত সফলতার মুখ দেখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আফ্রিকার উপনিবেশগুলো রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে। অপরদিকে, গত শতকের ষাটের দশকে ইউরোপ ও আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গরা দীর্ঘ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ণ নাগরিক অধিকার লাভ করে। কিন্তু প্যান আফ্রিকানিজম আন্দোলনের শুরুর দিকে যেভাবে বলা হচ্ছিল যে আফ্রো-আমেরিকান কিংবা আফ্রো-ইউরোপিয়ানদের আলাদা ভূখন্ড দরকার এবং প্রয়োজনে তারা আফ্রিকার দেশগুলোতে ফিরে যাবে– এ ধরনের কিছু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তাই বলা যায়, প্যান আফ্রিকানিজমের সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও ছিল।
Language: Bangla
Topic: History of Pan-Africanism
Reference:
১) The Pan-African Movement - AHA