জার্মানির কোয়ান্ডট পরিবারের নাম হয়তো সবার জানা নেই। কিন্তু বিএমডব্লিউ এর নাম শোনেননি এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। জার্মানির এই বহুজাতিক গাড়ি কোম্পানির সিংহভাগ মালিকানা কোয়ান্ডট পরিবারের অধিকারে। জার্মানির সবচেয়ে ধনী পরিবারও এই কোয়ান্ডট পরিবার। বিএমডব্লিউ এর আজ এই বিশ্বব্যাপী খ্যাতির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এই কোয়ান্ডট পরিবারের। তবে কোয়ান্ডট পরিবারের এই অবস্থানে আসার পেছনে জড়িয়ে আছে অনেক অজানা ইতিহাস।
কোয়ান্ডট পরিবার জার্মানির সবচেয়ে ধনী পরিবার হলেও তাদের কখনো গণমাধ্যমের সামনে দেখা যেত না। কোনো সাক্ষাৎকার বা ছবি তোলার ক্ষেত্রে তাদের ঘোর আপত্তি ছিল। ২০০৭ সালে জার্মান ভাষায় ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য কোয়ান্ডট ফ্যামিলি’ নামে একটি ডকুমেন্টারি প্রচারিত হয়। এতে তাদের অতীতের অনেক ইতিহাস প্রমাণসহ উঠে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের সাথে তাদের সরাসরি সংযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। জার্মান নির্মাতা এরিখ ফ্রিডলার এবং বারবারা সিবার্ট ২০০২-০৭ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছর কোয়ান্ডট পরিবার নিয়ে গবেষণা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের সাথে যোগসূত্রই কোয়ান্ডট পরিবারের আজকের এই অবস্থানে আসতে সাহায্য করেছে।
কোয়ান্ডট পরিবারের ব্যবসার হাতেখড়ি এমিল কোয়ান্ডটকে দিয়ে। উনবিংশ শতকে যখন শিল্পবিপ্লব শুরু হয়, তখন তিনি এক ডাচ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তারা সম্রাট প্রথম উইলিয়ামের শাসনামলে জন্মভূমি ছেড়ে পালিয়ে আসেন। তখন কোয়ান্ডট পরিবার খুব একটা সচ্ছল ছিল না। ১৮৮৩ সালে এমিল কোয়ান্ডট এক শিল্প কারখানার মালিকের মেয়েকে বিয়ে করেন। এরপর তিনি ঐ কারখানার মালিক হন। সেই কারখানায় সেনাবাহিনীর পোশাক তৈরি করা হতো। ১৯০০ সালে তিনি আরেকটি কোম্পানি কিনে নেন। এভাবে কোয়ান্ডট পরিবারের ব্যবসায়িক ভিত মজবুত হয়।
এমিল কোয়ান্ডটের পর তার ব্যবসার হাল ধরেন ছেলে গুন্থার কোয়ান্ডট। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাবাহিনীর জন্য পোশাক তৈরি করে প্রথম সারির ধনীদের কাতারে চলে আসেন। যুদ্ধের পর দেউলিয়া হওয়া বিভিন্ন কোম্পানিকে তিনি কিনে নেন। এর মাঝে আছে ইলেকট্রনিক্স, তেল, অস্ত্র ও ব্যাটারি কোম্পানী। ব্যাটারি কোম্পানির মধ্যে ‘আফা’ উল্লেখযোগ্য। এটি বর্তমানে ‘ভারটা’ নামে পরিচিত। তিনি আফা কোম্পানিতে গুজব ছড়ান যে, এর শেয়ারের দাম কমে যাচ্ছে। এতে তিনি সস্তায় কোম্পানিটি কিনে নেন। তার এই চতুরতাই ১৯২৯ সালে বিশ্বজুড়ে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মহামন্দার সময়ে টিকে থাকতে সাহায্য করে।
১৯১৮ সালে তার প্রথম স্ত্রী স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন তাদের সন্তান ছিল ছেলে হারবার্ট কোয়ান্ডট। ১৯২০ সালে গুন্থার মাগদা রিটশেল নামে এক তরুণীকে বিয়ে করেন। মাগদা ছিলেন তার চেয়ে ২০ বছরের ছোট। তাদের ঘরে জন্ম নেয় আরেক ছেলে হেরাল্ড কোয়ান্ডট। কিন্তু বয়সের পার্থক্য তাদের সংসার টেকাতে পারলো না। ১৯২৯ সালে মাগদা তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেন অন্য এক ব্যক্তিকে বিয়ে করার জন্য। কোয়ান্ডট পরিবারের ইতিহাসের এ অংশটুকু একটু চমকপ্রদ। কারণ গুন্থার বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্যেই তার অনেক সুযোগ খুঁজে পেয়েছিলেন।
মাগদা গুন্থারকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন জোসেফ গোবেলসকে বিয়ে করার জন্য। গোবেলস ছিলেন নাৎসি বাহিনীর প্রধান অ্যাডলফ হিটলারের কাছের লোক। তিনি পরে নাৎসি সরকারের প্রচারণা মন্ত্রণালয়ের প্রধানের দায়িত্ব পান। গুন্থার দেখতে পেলেন, গোবেলসের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখলে তারই অনেক ফায়দা হবে। তাই তিনি সাবেক স্ত্রীর সাথে গোবেলসের সম্পর্ক মেনে নিলেন। শুধু তা-ই নয়, ১৯৩১ সালে যখন গোবেলস আর মাগদার বিয়ে হয়, তখন তার বাংলো বাড়িতে অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব দেন! এই বিয়েতে বেস্ট ম্যান ছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। গোবেলস হেরাল্ড কোয়ান্ডটকে নিজের সংসারে রাখে।
গুন্থার নাৎসিদের সাথে নিজের সংযোগ আরো বাড়ানোর জন্য হিটলারের ক্যাম্পেইনে বড় অংকের অর্থ খরচ করেন। ১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় আসেন। গুন্থার তখন নাৎসি বাহিনীতে আরো সক্রিয় হন। তখন হিটলারর অগ্রাধিকার ছিল সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা। তাই গুন্থার তখন অস্ত্র ব্যবসায় মন দেন। তার কোম্পানি সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম ও অস্ত্রের পাশাপাশি সাবমেরিন ও ভি-২ রকেটের ব্যাটারিও সরবরাহ করতে থাকে। তখন তার আফা ব্যাটারি কোম্পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৩৭ সালে হিটলার তাকে যুদ্ধ বিষয়ক অর্থনীতির প্রধানের দায়িত্ব দেন।
এমন সময় শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলার ইউরোপের দেশগুলো দখল করতে থাকেন। গুন্থার কোয়ান্ডট তখন সেখানকার কারখানাগুলোও নিজের করে নেন। গুন্থার তখন যুদ্ধবন্দীদের নিজের কারখানায় জোর করে কাজ করাতেন। গুন্থারের কারখানাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ছিল আফার। গুন্থারের প্রথম স্ত্রীর সন্তান হারবার্ট কোয়ান্ডট তরুণ বয়স থেকেই বাবার সাথে ব্যবসায় যোগ দেন। বাবার মতো তিনিও নাৎসি বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ১৯৪৩ সালে নাৎসি সরকারের সমর্থনে হ্যানোভারে আফা ব্যাটারি কারখানার পাশে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করা হয়। একইসাথে এখানে সামরিক আদালতের ব্যবস্থাও রাখা হয়।
যুদ্ধবন্দীদের জন্য এই জায়গা ছিল একটি নরক। তাদেরকে যখন আনা হত সবাইকে বলা হতো ছয় মাসের বেশি কেউ বাঁচবে না এখানে। তাদেরকে ব্যাটারি তৈরির কাজ করতে হতো। তাদের কোনো প্রতিরক্ষামূলক পোশাক দেয়া হতো না। লেড এবং ক্যাডমিয়াম থেকে তৈরি বিষাক্ত গ্যাসের মধ্যে থেকে তাদের কাজ করতে হতো। স্বাভাবিকভাবেই এখানে সবাই বাঁচতে পারতো না। গড়ে প্রতি মাসে আশিজন মারা যেত। এর পাশাপাশি শারীরিক অত্যাচার আর মৃত্যুদন্ড তো ছিলই। বার্লিনে আরেকটি ব্যাটারি কারখানা ছিল, যেখানে মহিলা বন্দীদের ব্যবহার করা হতো।
নাৎসিদের পরাজয় হলে কোয়ান্ডটদেরও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। গুন্থার কোয়ান্ডট আমেরিকানদের কাছে ধরা পড়েন। তাদের কাছ দুই বছর আটক থাকেন। অন্যদিকে হারবার্ট কোয়ান্ডট ধরা পড়েন ব্রিটিশদের কাছে। তিনি তখন ব্রিটিশদের জন্য অস্ত্র তৈরি করা শুরু করেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের জন্য নুরেমবার্গ আদালতে বিচার শুরু হয়। কোয়ান্ডটদের অপরাধের কিছু প্রমাণ থাকে ব্রিটিশদের কাছে, যা কখনো আমেরিকানদের কাছে দেয়া হয়নি। এতে কোয়ান্ডটদের বিরুদ্ধে প্রমাণের অভাব দেখা যায়। এ কারণে গুন্থার তখন মুক্তি পেয়ে যান। অন্যদিকে জার্মানিও চাচ্ছিল তাদের অর্থনীতি নতুন করে চাঙা করতে। তাই গুন্থারসহ তার মতো অন্যান্য বড় বড় ব্যবসায়ীরা যুদ্ধকালীন সময়ে অপরাধে জড়িত থাকলেও তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
গুন্থারকে শুধুমাত্র একজন নাৎসি সমর্থক হিসেবে দেখানো হয়। আশ্চর্যজনকভাবে সরাসরি নাৎসিদের সাথে তার জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং গুন্থার নিজেকে নাৎসিদের বলি হিসেবে উপস্থাপন করেন। ১৯৫৪ সালে গুন্থার মারা যান। তখন তার ব্যবসায়ের হাল ধরেন দুই ছেলে হারবার্ট এবং হেরাল্ড কোয়ান্ডট। হেরাল্ড দেখতেন ধাতব যন্ত্রপাতির কারখানাগুলো। আর হারবার্ট দেখতেন বস্ত্র, ইলেকট্রিক এবং অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো। হেরাল্ড ১৯৬৭ সালে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। তখন থেকে হেরাল্ডের অংশ তার পাঁচ মেয়ে দেখাশোনা করেন।
পঞ্চাশের দশকে বিএমডব্লিউ কোম্পানি খুব ধুঁকছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। তখন এগিয়ে আসেন হারবার্ট কোয়ান্ডট। তিনি কিনে নেন বিএমডব্লিউ। ষাটের দশকে তার অধীনে আসে নতুন গাড়ি বিএমডব্লিউ ১৫০০। এরপর বিএমডব্লিউকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে এটি বিশ্বের অন্যতম সেরা গাড়ির কোম্পানি।
হারবার্ট কোয়ান্ডট তিনটি বিয়ে করেন এবং তার সন্তানের সংখ্যা ছয়জন। হারবার্ট ১৯৮২ সালে মারা যান। তারপর কোম্পানির দায়িত্ব নেন তৃতীয় স্ত্রী জোহান্না কোয়ান্ডট। হারবার্ট জোহান্নাকে বিয়ে করেন ১৯৬০ সালে। তাদের সন্তান দুজন- সুসানে এবং স্টিফেন। শেষের দিকে হারবার্টের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে হতে অন্ধ হয়ে যান। তখন জোহান্না তাকে ব্যবসায়িক কাগজপত্র পড়ে শোনাতেন। এভাবে ধীরে ধীরে তার ব্যবসায়িক দক্ষতা চলে আসে। হারবার্ট মারা যাওয়ার পর তিনি কোম্পানির ১৬.৭ অংশ শেয়ারের মালিক হন। পরে তিনি কোম্পানির বোর্ডের সদস্য হন এবং একসময় ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে যান। তিনি ২০১৫ সালে মারা যান।
বর্তমানে হারবার্টের ছেলে স্টিফেন ২৯% শেয়ার নিয়ে বিএমডব্লিউ এর সর্বোচ্চ অংশীদার। তার বোন সুসানে ক্লেটনের অংশ ২১%। অর্থাৎ বিএমডব্লিউয়ের অর্ধেক অংশই কোয়ান্ডট পরিবারের। সুসানে ২৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে জার্মানির সবচেয়ে ধনী নারীর তালিকায় এক নম্বরে আছেন। এছাড়া কোয়ান্ডট পরিবার থেকে জার্মানির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নকে বড় অংকের চাঁদা দেয়া হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সময় শুধু কোয়ান্ডট পরিবার নয়, জার্মানির প্রায় সব বড় ব্যবসায়ীই নাৎসিদের সাথে জড়িত ছিল। তারা ১৯৯০ সালের মধ্যেই জনসম্মুখে ক্ষমা চেয়ে আসছিল। কিন্তু বিএমডব্লিউ বা কোয়ান্ডট পরিবার এটা নিয়ে দীর্ঘদিন নিশ্চুপ ছিল। এমনকি ২০০৭ এ তাদের নিয়ে সেই ডকুমেন্টারি প্রচারিত হলেও তারা তেমন কিছু জানায়নি। অবশেষে ২০১১ সালে হেরাল্ড কোয়ান্ডটের মেয়ে গ্যাব্রিয়েল কোয়ান্ডট স্বীকার করেন, তাদের পরিবার অনেক ভুল করেছিল। দুঃখ প্রকাশ করা হয় বিএমডব্লিউ এর পক্ষ থেকেও।
This is a Bangla article about the Quandt family of Germany.Necessary references are hyperlinked in the article.
Featured Image: fortune.com