Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যেভাবে এলো আজকের রুবিক’স কিউব

রুবিক’স কিউবের নাম শোনেনি এমন ছেলেমেয়ের সংখ্যা যে খুবই কম। আমরা যখন আমাদের আশেপাশে দেখি যে, কোনো একটি ছেলে বা মেয়ে চট করেই রুবিক’স কিউব মিলিয়ে ফেলছে তখন তা দেখে অনেকেরই হিংসা হয়। কেন আমি পারি না? ও কীভাবে এত দ্রুত পারলো? এসব প্রশ্ন মনে করে অনেকেই নিজেদেরকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন? কিন্তু রুবিক’স কিউবের ইতিহাস, এর জনপ্রিয়তা অর্জনের কারণ আর এর আবিষ্কারক সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। তাহলে চলুন, দেরি না করে শুরু করা যাক!

rubiks cube
রুবিক’স কিউব; Image Source: bbc.co.uk

রুবিক’স কিউব সাধারণত ঘনকাকৃতির একটি বস্তু। এতে ৬টি তল থাকে। আর প্রতিটি তল আবার ৯টি করে বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা থাকে। এই বর্গগুলো ৬টি ভিন্ন ভিন্ন রঙে সাজানো থাকে। আর এই ক্ষুদ্র জিনিসটির কর্মকৌশলই এমন যে, এর বর্গক্ষেত্রগুলোকে তাদের আপেক্ষিক অবস্থান পরিবর্তন না করেই একত্রে ঘোরানো যায়। অসাধারণ এই জিনিসটি তৈরি করেছিলেন এর্নো রুবিক। তিনি হাঙ্গেরিয় বংশোদ্ভুত ভাস্কর ও স্থাপত্য বিদ্যার অধ্যাপক।

তার এই রুবিক’স কিউব বানানোর ইতিহাসটাও বেশ মজার। তিনি মূলত একজন অধ্যাপক ছিলেন। ত্রিমাত্রিক ডিজাইনের প্রতি ছিল তার অদম্য আগ্রহ। একাডেমি অব অ্যাপ্লায়েড আর্ট এন্ড ক্রাফটে তিনি একজন ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শিক্ষকতা পেশাটাই তার অনেক পছন্দের। ক্লাসে শিক্ষার্থীদেরকেও তিনি তার আগ্রহের বিষয় স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে পড়াতেন। সহজ করে কীভাবে তার শিক্ষার্থীদেরকে এ বিষয়টা ভালো করে বোঝানো যায় এ নিয়ে সারাদিনই ভাবতেন তিনি।

rubik
এর্নো রুবিক; Image Source: famousinventor.org

সময়টা ছিল ১৯৭৪ সাল। এর্নো রুবিকের বয়স তখন মাত্র ২৯। তিনি যে রুমে থাকতেন সেই রুমটা ছিল এলোমেলো। রুবিক বিভিন্ন আকারের জিনিস নিয়ে খেলতে পছন্দ করতেন। যেখানে থাকতেন সেখানে প্রায়ই কাঠের টুকরো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। একদিন খেলার বশেই কাঠের টুকরোগুলোকে আঠা দিয়ে জোড়া লাগালেন।

তারপর বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিক আর ইলাস্টিক স্প্রিং দিয়ে বানিয়ে নিলেন অদ্ভুত এক জিনিস। অনেকটা কৌতূহলবশতই ছোট কাঠের ব্লকগুলোকে এলোমেলোভাবে ঘোরাতে লাগলেন তিনি। কিছুক্ষণ ঘোরানোর পর যখন রঙগুলো এলোমেলো হয়ে যায় তখন তার দেখতে খুব ভালই লাগছিলো। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত রুবিক বোঝতেই পারেননি যে, তিনি কী বানিয়ে ফেলেছেন যতক্ষণ না তিনি এটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে অনেকটা এলোমেলো করে ফেলেছিলেন। অবাক হয়েই তিনি লক্ষ্য করলেন, এখন আর তিনি রঙগুলোকে মিলাতে পারছেন না। রুবিক তার একটি অপ্রকাশিত স্মৃতিচারণামূলক প্রবন্ধ Quoted in Discover  magazine এ বলেন,

এটা এমন যে আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা লিখার দিকে তাকিয়ে আছি যেটাতে একটা গোপন কোড লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু আমার এ ভেবেই ভালো লাগছিল যে, আমি নিজেই এই কোডের স্রষ্টা। যদিও আমি এটা পড়তে পারছিলাম না। এটা সত্যিই অসাধারণ একটি মুহুর্ত যেটা আমি সহজে মেনে নিতে পারছিলাম না

আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর্নো রুবিকের কোনো ধারণাই ছিল না যে কিভাবে তিনি এটা সমাধান করবেন। তিনি মনে মনে সন্দেহ করতেন যে, আসলেই কি কেউ এটা সমাধান করতে পারবে? কারণ গণিতের সম্ভাব্যতার সূত্র কাজে লাগিয়ে বলা যায় যে, একটি ৩x৩x৩ আকারের রুবিক’স কিউবের প্রায় ৪৩,২৫২,০০৩,২৭৪,৪৮৯,৮৫৬,০০০ ধরনের সম্ভাব্য কনফিগারেশন রয়েছে। এর মধ্যে শুধু একটি কনফিগারেশনেই রুবিক’স কিউবের সবগুলো তলে রঙগুলো মিলবে। এর্নো রুবিক তো ধরেই নিয়েছিলেন যে, কেউ হয়তো এটি আর মেলাতেই পারবে না! তার নিজের এই রুবিকটি সমাধান করতে প্রায় এক মাসের মতো লেগেছিল।

r
ওয়ার্ল্ড রুবিক’স কিউব প্রতিযোগীতা; Image Source: huffingtonpost.co.uk

যা-ই হোক, এই রুবিক’স কিউবের নাম কিন্তু প্রথমে রুবিক’স কিউব ছিল না। প্রথমে রুবিক এর নাম দিয়েছিলেন ‘ম্যাজিক কিউব’। এমনকি আইডিয়াল টয়েস নামক কোম্পানি এর আরো কিছু নাম প্রস্তাব করেছিলো যেমন, দ্য গরডিয়ান নট, ইনকা গোল্ড। পরে অবশ্য রুবিক’স কিউব নামটিই নির্ধারণ করা হয়।

এখন আমরা যে রুবিক’স কিউব দেখি সেই রুবিক’স কিউব কিন্তু এত সহজে বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি। এর্নোর সেই রুবিক’স কিউবকেও অনেক বাধা পেরিয়ে সফলভাবে এতদূর আসতে হয়েছে। ১৯৭৪ সালে রুবিক’স কিউব এর আইডিয়া এর্নোর মাথায় এলেও একে বাণিজ্যিকভাবে ১৯৭৭ এর দিকে তৈরি করা হয়। প্রথমে এটিকে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে খেলনার দোকানগুলোতে বিক্রি করা হয়। এরপর পশ্চিমা বিশ্বে একে বাজারজাত করার জন্য আমেরিকার আইডিয়াল টয় কোম্পানির সাথে চুক্তি করা হয়। কিন্তু এটাকে জনপ্রিয় করা যায় কীভাবে?

এই চিন্তা থেকেই এর্নো রুবিক তার বন্ধু, ব্যবসায়ী টিবর লাজি (Tibor Laczi) কে অনুমতি দিলেন এটিকে জার্মানীর নুরেমবার্গে খেলনা প্রদর্শনীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।সেখানে রুবিক’স কিউব ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলে। ১৯৮০ সালের দিকে রুবিক’স কিউব জার্মানীর গেম অব দ্য ইয়ার পদক লাভ করে। এ পুরস্কারটি দেয়া হয় সাধারণত সেসব খেলাকে যেসব খেলায় রয়েছে সুন্দর কনসেপ্ট, নিয়ম আর ব্যতিক্রমী ডিজাইন। ধীরে ধীরে রুবিক’স কিউব ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। কারণ এটি অনেকটাই ধাঁধার মতো। আর বেশিরভাগ মানুষই সহজে এটি মেলাতে পারে না।

রুবিক’স কিউব কী পরিমাণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তা সহজেই বোঝা যায়। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সাল, এই তিন বছরে প্রায় ২০০ মিলিয়ন রুবিক’স কিউব পুরো বিশ্বে বিক্রয় হয়। বিভিন্ন বিখ্যাত পত্রিকা যেমন সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ওয়াশিংটন পোস্টে রুবিক’স কিউব নিয়ে লেখালিখি হতে থাকে। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ১০টি বেস্ট সেলার বইয়ের ভেতরে তিনটি বই রুবিক’স কিউব নিয়ে লিখা। শুরু হয় রুবিক’স কিউব সমাধান করার প্রতিযোগিতা। এমনকি গিনেস বুক অব রেকর্ডে নাম আসতে থাকে সেসব ছেলেমেয়েদের যারা দ্রুত এটি সমাধান করতে সক্ষম হয়।

Snowden মুভির একটি তথ্যচিত্র; Image Source: hungarytoday.com

বিভিন্ন সংস্কৃতিতেও দেখা যায় এর অনুপ্রবেশ। ১৯৮০ এর পর থেকে বিভিন্ন ফিল্মে দেখানো হয় রুবিক্স কিউবকে। অধিকাংশ ফিল্মেই যারা সেসব চরিত্র রুবিক’স কিউব সমাধান করতে পারে তাদেরকে বুদ্ধিমান হিসেবে দেখানো হয়। এতে সবার মনেই একটি ধারণা জন্মে যায়। রুবিকস কিউব হাতে যেকোনো ছেলেমেয়েই সুপার জিনিয়াস। 

আরেকটি মুভিতে রুবিক্স কিউব; Image Source: rubikscubeinmovies.com

১৯ মে, ২০১৪ সালে রুবিক’স কিউবের ৪০তম বার্ষিকীতে গুগল একটি ইন্টার‍্যাক্টিভ ডুডল তৈরি করে রুবিক’স কিউবের, যেখানে ব্যবহারকারীরা এর বিভিন্ন অংশ নাড়িয়ে মোবাইল দিয়েই রুবিক’স কিউব সমাধান করতে পারবেন। এভাবেই রুবিক’স কিউব প্রায় অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের উপর প্রভাব ফেলে চলেছে। এখনো অনেক গবেষকেই বাচ্চাদেরকে খেলনা হিসেবে রুবিক’স কিউব দিতে বাবা মা-কে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

কারণ রুবিক’স কিউব সমাধান করা শিশুদের স্মৃতিশক্তি, ধৈর্যশক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এমনকি, এটি বাচ্চাদের প্রবলেম সলভিং এর দক্ষতাও বাড়িয়ে দেয় যা খুবই প্রয়োজনীয় বাচ্চাদের মেধার বিকাশের জন্য। তবে যেকোনো কিছুরই যেমন ভালো দিক থাকে তেমনি খারাপ দিকও থাকতে পারে। কোনো কিছুরই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে আসতে পারে কিছু ক্ষতিকর সম্ভাবনার। রুবিক’স কিউবও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে হতে পারে রুবিক্স রিস্ট (Rubik’s wrist), কিউবিস্ট থাম্ব (Cubist’s Thumb) সহ কিছু ক্ষতিকর শারীরিক সমস্যা, যেখানে রোগীর হাতের কব্জি এবং বৃদ্ধাঙ্গুলিতে দেখা দেয় প্রচন্ড রকমের ব্যথা। তাই বাবা মায়েদেরও উচিত সন্তানদের এ বিষয়টি খেয়াল রাখা।

এর্নো রুবিকের সৃজনশীল মানসিকতা আর ডিজাইনের প্রতি তার অধীর ভাল লাগাই হয়তো আমাদেরকে এনে দিয়েছে আজকের এই রুবিক’স কিউব যা এখনো আমাদের অনেক তরুণ তরুণীর হাতে জায়গা করে নিয়েছে। কে জানে এ লেখাটি পড়ার সময় হয়তো আপনার বয়সী এক ভদ্রলোক রাতের ঘুম হারাম করে দিচ্ছেন রুবিক’স কিউব সমাধান করার জন্য! 

Related Articles