Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন

১৩৯৫ সাল থেকে ১৪৪০ সালের মধ্যবর্তী সময়ের কথা। হিন্দুস্তানে তখন বেশ অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। দিল্লী সালতানাতের তুঘলক রাজবংশ পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌছে গেছে প্রায়। সিংহাসনে একের পর এক সুলতান আসছেন, আবার চলেও যাচ্ছেন। আমিররা সাম্রাজ্যের চেয়ে নিজেদের স্বার্থের দিকেই নজর দিচ্ছেন বেশি। নিজেদের সুবিধামতো দলবদল করছে তারা। ফলশ্রুতিতে সাম্রাজ্যের শাসনকেন্দ্র দুর্বল হয়ে পড়লো। কেন্দ্র দুর্বল হলে যা হয়, দিল্লী সালতানাতের ভাগ্যেও তাই হতে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বিদ্রোহের খবর আসছে। সবাই নিজ নিজ প্রদেশ নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্বাধীন সুলতান হতে চাচ্ছে। আসলে একসময়কার প্রবল শক্তিশালী দিল্লী সালতানাদের ভগ্নদশার তো মাত্র শুরু এটা!

দিল্লীর এই অরাজক অবস্থার কথা কিন্তু সমরকন্দের একজনের কানে ঠিকই পৌছে গেলো। তিনি হিন্দুস্তান আক্রমণে দ্বিতীয়বার ভাবলেন না। এতদিন হিন্দুস্তান আক্রমণ করবেন ভাবলেও মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকায় হিন্দুস্তান আক্রমণ করেন নি। কিন্তু এখন তো সেই শাসন নিজেই টলায়মান। এখন আর আক্রমণ করতে বাঁধা কোথায়?

নিজের পৌত্র পীর মুহাম্মদের নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী হিন্দুস্তান অভিমুখে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি এখন। যুদ্ধের মতো ধকল আপাতত নিতে চাচ্ছেন না। কিন্তু কী মনে করে যেনো তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না! হিন্দুস্তানে আক্রমণ হবে, আর তিনি নিজে সেনাবাহিনীর সাথে থাকবেন না! পীর মুহাম্মদের অগ্রযাত্রার কিছুদিন পরেই ৯০,০০০ সেনার এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তিনি নিজেও হিন্দুস্তান অভিমুখে রওয়ানা দিলেন!

বীরযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত পীর মুহাম্মদ সিন্ধু নদ অতিক্রম করে ১৩৯৭ সালের ৫ মার্চ মুলতানে আক্রমণ চালালেন। তখন মুলতানের তুঘলক গভর্নর ছিলেন সারাং খান। তিনি পীর মুহাম্মদকে বাধা দিতে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু বীরের মতো যুদ্ধ করেও মুলতানকে রক্ষা করতে পারলেন সারাং খান। শীঘ্রই মুলতানের পতন ঘটলো।

ওদিকে সমরকন্দ থেকে রওয়ানা দেওয়া ৯০,০০০ সৈন্যের বাহিনীটি ১৩৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সিন্ধু নদ অতিক্রম করলো। তাদের নেতৃত্বে আছেন তৈমুর! হ্যাঁ তৈমুর, সেই বিশ্ববিজয়ী আমীর তৈমুর! হিন্দুস্তান কি এবার তাহলে তৈমুরের লক্ষ্য হতে যাচ্ছে?

তৈমুরের নেতৃত্বাধীন বাহিনীটি সিন্ধু পাড়ি দিয়ে পীর মুহাম্মদের বাহিনীর সাথে যোগ দিলো। ইতোমধ্যেই মুলতান বিজয় সম্পন্ন হয়ে গেছে। তৈমুর আর পীর মুহাম্মদের বাহিনী সোজা দিল্লী অভিমুখে রওয়ানা দিলেন। পথে ভাটনীর, সামানাহ আর দিপালপুর পড়লো। সবগুলো শহরকেই জয় করে নেয়া হলো। তৈমুর তুঘলক সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পৌছে গিয়েছেন।

তৈমুরকে বাঁধা দিতে সুলতান নাসরুদ্দীন মাহমুদ এগিয়ে গেলেন। তাঁর সাথে ৪০,০০০ পদাতিক সৈন্য আর ১০,০০০ এর কিছু বেশি অশ্বারোহী সৈন্য। এছাড়া বেশ কিছু যুদ্ধহাতি আছে সাথে। যুদ্ধের সময় হাতিগুলো বেশ কাজে লাগে। হাতির ভয়ে বিপক্ষ দলের ঘোড়াগুলো সামনে এগোতে চায় না। হাতিগুলো নিয়ে অবশ্য আমীর তৈমুরও বেশ চিন্তিত। তবে তার কাছে বেশ ভালো পরিকল্পনা আছে!

তৈমুর বেগ যখন সিন্ধু নদের তীর থেকে দিল্লী সালতানাতের রাজধানীর দিকে অগ্রসর হয়েছেন, পথে যা কিছুই পড়েছে সব ধ্বংস করতে করতে এসেছেন। দিল্লী এসে পৌছানো পর্যন্ত তাঁর বাহিনীর হাতে প্রায় ১ লাখ যুদ্ধবন্দী ছিলো। বেশিরভাগই ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তৈমুরের বাহিনী যখন দিল্লীর বাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে বসে আছে, তখন এই যুদ্ধবন্দীরা একটি ভুল করে ফেললো। তারা দিল্লীর সেনাবাহিনীর সমর্থনে উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলো। তৈমুরের কপালে ভাঁজ পড়লো। সামনে শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনী আর পেছনে ১ লাখ যুদ্ধবন্দী। সুযোগ পেলে এই যুদ্ধবন্দীরা পেছন থেকে সমস্যার সৃষ্টি করবে, এটা নিশ্চিত। সমস্যা সমাধানে তৈমুর এই যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে এমন একটি সিদ্ধান্ত দিলেন, যা শুনে সবাই হতবাক হয়ে গেলো। তৈমুর এই ১ লাখ যুদ্ধবন্দীকে একসাথে হত্যার নির্দেশ দিয়ে দিলেন! যুদ্ধের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম এমন নারকীয় হত্যাকান্ড চললো! তৈমুরের নির্দেশ পালন করা হলো। এক নির্দেশে প্রাণ গেল এক লাখ মানুষের!

তৈমুরের প্রতিকৃতি; সূত্র: Wikimedia Commons

এদিকে অনেকটা যুদ্ধ শুরুর আগেই যুদ্ধে পরাজিত হলেন তুঘলক সুলতান নাসরুদ্দীন মাহমুদ। পরাজিত হয়ে তিনি দিল্লী ত্যাগ করে পালিয়ে গেলেন। দিল্লী তৈমুরের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়লো। তৈমুরের সৈন্যরা দিল্লিতে অবাধে লুটপাট চালালো। দিল্লীর নাগরিকরা বাঁধা দিতে গেলে তৈমুরের বেশ কিছু সৈন্য নিহত হলো। ফলাফল যা দাঁড়ালো তা হলো, প্রায় ২৬ দিনব্যপী দিল্লীতে গণহত্যা চললো। দিল্লী অধিকার করার পর তৈমুর একে একে মীরাট, বাদায়ুন, হরিদ্বার, নগরকোট অধিকার করে কাশ্মীর পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। তৈমুরের হিন্দুস্তান অধিকারের সময় এত রক্তপাত হয়েছে যে, কথিত আছে তৈমুরের হিন্দুস্তান ত্যাগের পর প্রায় ৬ মাস আকাশে কোনো পাখি উড়তে পারে নি!

সে যা-ই হোক, তৈমুর নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন তিনি হিন্দুস্তানে অনেক বেশিই রক্তপাত করে ফেলেছেন। আর তাই হিন্দুস্তানকে সরাসরি নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত না করে খিজির খানের কাছে পাঞ্জাব তথা হিন্দুস্তানে নিজের অধিকৃত ভূখন্ডের দায়িত্ব দিয়ে হিন্দুস্তান ত্যাগ করেন।

খিজির খানের পিতা মালিক সোলায়মান ছিলেন মুলতানের গভর্নর। মালিক সোলায়মানের মৃত্যুর পর তুঘলক সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক খিজির খানকে মুলতানের গভর্নর হিসেবেই বহাল রাখেন। কিন্তু মাল্লু ইকবালের ভাই সারাং খান খিজির খানকে পছন্দ করতেন না। দিল্লী সালতানাতের বিশৃঙ্খলার দিনগুলোতে তিনি খিজির খানকে মুলতানের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন। মুলতানে অবাঞ্চিত ঘোষিত হওয়ার পর তিনি মালবে চলে যান। তৈমুরের বাহিনী তখন মালবে অবস্থান করছিলো। খিজির খান তৈমুরের আনুগত্য স্বীকার করলেন।

দিল্লী সালতানাত ধ্বংসের পর তৈমুর খিজির খানকে দিল্লী সালতানাতের সিংহাসনে বসিয়ে হিন্দুস্তান ত্যাগ করেন। কিন্তু সেই অশান্ত দিনগুলোতে খিজির খান হিন্দুস্তানের উপর পুরোপুরি আধিপত্য কায়েম করতে পারেন নি। দিপালপুর, মুলতান আর সিন্ধুর অংশবিশেষ ছাড়া হিন্দুস্তানের আর কোথাও তার তেমন নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। আর তাই শীঘ্রই হিন্দুস্তানের উপর আধিপত্য বিস্তারের অভিযানে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন। প্রথমেই তিনি মাল্লু খানকে আক্রমন করলেন। মাল্লু খান খিজির খানের হাতে পরাজিত হলেন। ১৪১৪ সালের ৬ জুন দৌলত খান লোদীকে পরাজিত করে তিনি দিল্লীতে প্রবেশ করলেন। ১৪১৪ সালে তিনি কাটিহারের রাজা হরি সিংহের বিদ্রোহ দমনে মালিক তুফাকে প্রেরণ করেন। মালিক তুফা ছিলেন খিজির খানের উজির। যুদ্ধে রাজা হরি সিংহ পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। পরে অবশ্য আত্মসমর্পণ করে বার্ষিক কর আদায়ে সম্মত হন। ১৪১৮ সালে হরি সিংহ আবারো বিদ্রোহ করলে এবার তাকে একেবারেই মূলোৎপাটন করা হয়। এছাড়া খিজির খান মালিক তুফার নেতৃত্বে ১৪১৬ সালে বায়ানা আর গোলালিয়রের দিকেও একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন।

খিজির খান ১৪১৪-২১ সাল পর্যন্ত মোট ৮ বছর দিল্লীর সিংহাসনে ছিলেন। এ সময় তিনি তৈমুরের রাজপ্রতিভূ হিসেবেই শাসনকার্য পরিচালনা করেন। নিজেকে তিনি সুলতান ঘোষণা করেন নি। এমনকি তখন হিন্দুস্তানের মুদ্রাও তৈমুরের নামেই ইস্যু করা হতো।

শাসক হিসেবে খিজির খান বেশ দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। খুব অল্প সময়ের মাঝেই তিনি চরম বিশৃঙ্খল হিন্দুস্তানকে গুছিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু নিজের কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পারেন নি তিনি। ১৪২১ সালের ২০ মে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

খিজির খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র মোবারক শাহ দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। তিনি তৈমুরের নামের পরিবর্তে নিজের নামে মুদ্রার প্রচলন করেন। ১৪২১-৩৪ সাল পর্যন্ত হিন্দুস্তান শাসন করেন তিনি।

সুলতান মোবারক শাহ-এর সমাধি; সূত্র: Wikimedia Commons

১৪৩৪ সালে মোবারক শাহের মৃত্যুর পর তার ভাতিজা মোহাম্মদ খান সুলতান হিসেবে দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। ১৪৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি হিন্দুস্তান শাসন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আলাউদ্দীন আলম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি দিল্লীর জটিল রাজনীতিতে অধৈর্য হয়ে পড়েন। ১৪৫১ সালের ১৯ এপ্রিল সুলতান আলাউদ্দীন আলম শাহ বাহালুল খান লোদীর কাছে দিল্লী সালতানাতের দায়িত্ব দিয়ে বাদাউন চলে যান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাদাউনেই অবস্থান করেছিলেন।

সুলতান মুহাম্মদ শাহ-এর সমাধি, লোদি গার্ডেন, নয়া দিল্লি; সূত্র: Wikimedia Commons

ইয়াহিয়া বিন আহমদ সিরিহিন্দি রচিত ‘তারিক-ই-মোবারক-শাহী’ গ্রন্থে খিজির খানকে হযরত মুহাম্মদ (স) এর প্রত্যক্ষ বংশধর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর তাই খিজির খান ও তাঁর উত্তরসূরিদের শাসনকালকে দিল্লী সালতানাতের সৈয়দ রাজবংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

দিল্লী সালতানাতের ইতিহাসে সৈয়দ রাজবংশের শাসনকাল খুবই সংক্ষিপ্ত ছিলো। ১৪১৪-৫১ সাল পর্যন্ত মাত্র ৩৯ বছরে মোট ৪ জন সুলতান শাসন করেন এ সময়। আর সৈয়দ সুলতানদের মূল কাজই ছিলো তৈমুরের আক্রমণে ছিন্নভিন্ন দিল্লী সালতানাতের ভূমিগুলো পুনরুদ্ধার করে আবারো এক শাসনের নিচে নিয়ে আসা। কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা সফল ছিলেন আবার কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু সর্বোপরি মূল কথা হচ্ছে, তৈমুরের দিল্লী আক্রমণ আর দিল্লী ত্যাগের পূর্বে খিজির খানকে দিল্লী সালতানাতের সিংহাসনে বসিয়ে যাওয়ার ভেতরে অন্য একটি তাৎপর্য আছে। আর অল্প কিছুদিনের ভেতরেই দিল্লী সহ সমগ্র হিন্দুস্তানের বেশিরভাগ ভূখন্ডই শাসন করবে তৈমুরেরই বংশধররা! তারা গঠন করবেন পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী একটি সাম্রাজ্য, যার তুলনা শুধু তাঁরাই হবেন! তৈমুর নিজে কি কখনো এ ব্যাপারটা কল্পনা করতে পেরেছিলেন? কিংবা হিন্দুস্তান নিজেই কি সেই মহান শাসকদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত?

তথ্যসূত্র

১। বাবরনামা (জহির উদ দিন মুহাম্মদ বাবর, অনুবাদঃ মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস)

২। ইতিহাসের ইতিহাস- গোলাম আহমেদ মোর্তজা

৩। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান

এই সিরিজের আগের পর্ব

১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা

২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ

৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল

৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক

৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল

৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল

Related Articles