প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর একশো বছরেরও বেশি সময় পার করে এসেছি আমরা। গত শতাব্দীর ঐতিহাসিক এ ঘটনা এখনও মানুষকে ভাবায়, ইতিহাসবিদদের চিন্তার খোরাক জোগান দেয়। ইতিহাসের তাৎপর্যময় ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নেয়ার পরিধি কোনো নির্দিষ্ট জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; সব জাতিকেই নিতে হয়।
দিনভর যত বিধ্বংসী লড়াই-ই চলুক না কেন, দিনশেষে বিজয়ী একপক্ষই হয়। চার বছর লড়াইয়ের পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ের মালা গলায় পরেছিল মিত্রপক্ষ। পরাজিত অক্ষশক্তির প্রধান দেশ জার্মানিকে বলতে গেলে একা হাতেই মোকাবিলা করতে হয়েছে মিত্রপক্ষকে। চার বছরে মিত্রপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি কিংবা ভোগান্তিও কিন্তু কম হয়নি!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে পরাশক্তিগুলোর কোনোটিরই বিমানবাহিনী শক্তিশালী ছিল না। বিমানবাহিনীগুলো তখন কেবল গঠিত হয়েছে, উন্নয়ন কিংবা আধুনিকায়ন শুরু হয়নি। যেমন- ব্রিটেনের 'রয়্যাল ফ্লায়িং কর্পস্' গঠিত হয় ১৯১২ সালে। তাদের বিমানগুলো খুব শক্তিশালী ছিল না; একেবারেই অদক্ষ ও পরিমাণে অল্প। এখনকার সময়ে প্রতিটি দেশেরই দ্রুতগতির যুদ্ধবিমান আছে, যেগুলো দিয়ে ভয়াবহ বোমা হামলা করা যায়। কিন্তু আজ থেকে একশো বছর আগের চিত্রটা ভিন্ন ছিল। আর সামরিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের শুরু হয়েছে মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই, তার আগে নয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ট্রেঞ্চের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দু'পক্ষের কাছেই একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতিপক্ষের ট্রেঞ্চগুলোর সঠিক অবস্থান জানা। স্থলবাহিনীর আক্রমণ কার্যকর করতে প্রতিপক্ষের অবস্থান জানার কোনো বিকল্প ছিল না দু'পক্ষের কাছেই। এজন্য যুদ্ধের প্রথমদিকে দু'পক্ষই তাদের বিমানগুলোকে নজরদারির জন্য ব্যবহার করেছিল, আর সাথে টুকটাক হামলা। এরিয়াল ফটোগ্রাফির মাধ্যমে শত্রুপক্ষের ট্রেঞ্চলাইনগুলোর ছবি তুলে যুদ্ধের নীতিনির্ধারকদের কাছে পাঠানো হতো। এরপর 'অবস্থান বুঝে ব্যবস্থা'। মাঝে মাঝে ট্রেঞ্চ বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে মেশিনগান, পিস্তল দিয়ে হামলা কিংবা বোমা নিক্ষেপ করা হতো সেই বিমানগুলো দিয়ে, তবে সেটার হার অত্যন্ত কম। ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে একসময় ডুয়েলিং এয়ারক্রাফট সাধারণ দৃশ্য হয়ে দাঁড়ায়।
দু'পক্ষেরই আকাশ-দ্বৈরথে যে ভারসাম্য ছিল, তা নষ্ট হয়ে যায় নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কারের ফলে। ১৯১৫ সালে জার্মান কোম্পানি 'ফক্কার' প্রপেলারের মধ্যে দিয়ে মেশিনগান স্থাপন করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে, যেটি জার্মানিকে যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে বিরাট প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এনে দেয়। জার্মানদের হাতে নতুন প্রযুক্তি আসলেও ব্রিটেনের হাতে উন্নত বিমান আসার সম্ভাবনা ১৯১৭ সালের গ্রীষ্মের আগে ছিল না। তাই জার্মানদের এই প্রযুক্তিগত অগ্রগামিতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ব্রিটিশরা তাদের বিমানসংখ্যা বৃদ্ধি করে। ১৯১৬ সালের 'ব্যাটল অব সোম' এর সময়ে রয়্যাল ফ্লায়িং কর্পসের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংখ্যা ৪২,০০০ ছাড়িয়ে যায়।
সোমের যুদ্ধে (ব্যাটল অব সোম) ব্রিটিশরা আকাশের লড়াইয়ে তাদের প্রায় ৪০০ পাইলট হারায়। এটা তাদের জন্য বিরাট ক্ষতি ছিল, কারণ মৃত পাইলটদের অধিকাংশই ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে অভিজ্ঞ। পাইলটদের ঘাটতি পূরণ করতে নতুন যাদের নিয়োগ দেয়া হয়, তাদের না ছিল অভিজ্ঞতা, না ছিল ডগফাইটের দক্ষতা।
১৯১৭ সালের এপ্রিলে ফ্রান্সের অ্যারাসে আরেকটি বড় যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে জার্মানি রীতিমতো ত্রাস সৃষ্টি করে ইউরোপের আকাশে। জার্মানরা একটি দুধর্ষ এয়ারস্কোয়াড গঠন করে, যার কাজ ছিল ডগফাইটে মিত্রপক্ষের বিমানগুলোকে ভূপাতিত করা। 'জাস্টা' (Jasta) নামের সেই স্কোয়াড জার্মানির প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে।
জার্মানরা ৫টি এয়ারস্কোয়াডে মাত্র ৫০টি বিমান দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। অপরদিকে ব্রিটিশদের ২৫টি স্কোয়াডে বিমানের সংখ্যা ছিল ৪০০-এর কাছাকাছি। ব্রিটিশরা এই যুদ্ধে আক্রমণের পথে হেঁটেছিল, আর জার্মানরা ছিল পুরোপুরি রক্ষণাত্মক। ব্রিটেনের স্থলবাহিনী বরাবরের মতোই জার্মানদের কোণঠাসা করেছিল।
পুরো এপ্রিল মাসজুড়ে ব্রিটিশদের কাছে একের পর এক দুঃসংবাদ আসতে থাকে। এপ্রিলের শেষে দেখা যায়, আড়াইশোর মতো যুদ্ধবিমান হারাতে হয়েছে ব্রিটিশদের। এর মধ্যে অনেকে পাইলটই আবার যুদ্ধবন্দী হয়েছেন জার্মানদের হাতে।
এপ্রিলে ব্রিটিশদের দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়ান জার্মান পাইলট ম্যানফ্রেড ভন রিখথোফেন। পুরো এপ্রিলজুড়ে ইউরোপের আকাশে ডগফাইটে প্রায় বিশটি বিমান ভূপাতিত করেন। ইউরোপের সেরা পাইলট হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে মাত্র আঠারো মাসের ক্যারিয়ারে ৮০টিরও বেশি মিত্রপক্ষীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছেন। তার লাল-রঙা ডুয়েলিং এয়ারক্রাফটের কারণে পরিচিত হয়েছিলেন 'রেড ব্যারন' নামে। তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তাকে 'ফ্লায়িং সার্কাস' নামের এয়ারস্কোয়াডের দায়িত্ব দেয়া হয়। তার নেতৃত্বে ফ্লায়িং সার্কাস এয়ার স্কোয়াড দুর্দান্ত সাফল্য দেখায় ইউরোপের আকাশে।
আকাশযুদ্ধের পরিসংখ্যান দেখে হয়তো মনে হতে পারে জার্মানরা যুদ্ধে খুব ভালো করেছিল। আদতে তা নয়। স্থলযুদ্ধে ব্রিটিশরা ঠিকই অদম্য ছিল। বিমানবাহিনীর এত বড় ক্ষতি সত্ত্বেও অবশিষ্ট বিমানগুলো দিয়ে ট্রেঞ্চলাইন পর্যবেক্ষণের কাজ ঠিকই চালিয়ে নিয়েছিল ব্রিটিশরা। আকাশে সফলতা পেলেও স্থলের যুদ্ধে জার্মানরা ব্রিটিশদের রুখে দিতে পারেনি। শেষমেশ পরাজয়ই একমাত্র পরিণতি হয়ে দাঁড়ায় জার্মানদের।
This is a bengali article detailing the history of Bloody April during WWI.
References:
১) BLOODY APRIL
২) Why a Terrible Month For the Royal Flying Corps Became Known as Bloody April
৩) ‘Bloody April’, 1917 - The month where success also proved to be failure
৪) Bloody April
৫) Red Baron