Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গ্যাগ রুল: দাসপ্রথার বিলোপের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের এক অন্যায্য আইন

গ্যাগ রুল শব্দটির সাথে আমাদের দেশের রাজনীতি বা নীতিনির্ধারণের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌজন্যে এই শব্দ যুগলের সাথে অনেকেই পরিচিত। গ্যাগ শব্দটির আভিধানিক অর্থ কণ্ঠরোধ করা। গ্যাগ রুল বলতে এমন একটি আইনকে বোঝায় যার মাধ্যমে আইন প্রণেতা বা সিদ্ধান্তগ্রহণকারী দলের সদস্যদের কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কথা বলা, বিবেচনা করা বা সুপারিশ করার ক্ষমতা খর্ব করা হয়। সম্প্রতি ট্রাম্প আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোতে গর্ভপাতের উপর গ্যাগ রুল জারি করায় এই টার্মটি আবার আলোচনায় এসেছে।

গ্যাগ রুলের শুরু হয় ১৮৩০ এর দশকে, সে সময় এমন একটি আইন আরোপিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে। কংগ্রেসের দক্ষিণাঞ্চলের সদস্যদের আইনী কৌশলে সংসদে দাসপ্রথা বিষয়ক যেকোনো ধরনের আলাপ-আলোচনার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। দাসপ্রথা বিরোধী সংসদ সদস্যদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য প্রথম আইন পাস করা হয় ১৮৩৬ সালে। পরবর্তী ৮ বছর ধরে এই আইন চলতেই থাকে। বাকস্বাধীনতায় এমন হস্তক্ষেপ কংগ্রেসের উত্তরাঞ্চলের সদস্যবৃন্দ তো বটেই, তাদের সংগঠকদের জন্যও অপমানজনক বলে মনে করা হয়।

Image Source: egrupos.net

গ্যাগ রুলের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে বিশ্বব্যাপী বিরোধিতা চলছে। এই বিরোধিতায় নেতৃত্ব দেন তখনকার প্রেসিডেন্ট জন কুইন্সি অ্যাডামস। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট। ১৮২৫ সালের হতাশাজনক ও নিরানন্দ এক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে কংগ্রেসের হয়ে ক্ষমতায় আসেন অ্যাডামস। ক্যাপিটল হিলের দাসপ্রথা বিরোধী মনোভাব সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। তার জিদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় গ্যাগ রুল জারি করা সদস্যরা। গ্যাগ রুলকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দাসপ্রথা বিলোপ আন্দোলনের সক্রিয় সদস্যরা এক জোট হয়ে দাপটের সাথে অধিকার আদায়ের দাবীতে সোচ্চার হয় আমেরিকায়।

শেষপর্যন্ত ১৮৪৪ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্যাগ রুল রদ করা হয়। তাৎক্ষনিকভাবে কাজ আদায়ের জন্য এই ট্যাক্টিক বা কৌশলটি বেশ কাজে লাগে। কংগ্রেসে দাসপ্রথা বিষয়ক বিতর্ক থামিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে সফলতা অর্জন করে গ্যাগ রুল। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটি ছিল সুস্পষ্টভাবে অগণতান্ত্রিক, অন্যায্য এবং পক্ষপাতদুষ্ট একটি কৌশল। শুরুর দিকে অ্যাডামসকে অবশ্য কংগ্রেসে প্রচুর ভর্ৎসনার শিকার হতে হয়, তার জীবনের উপর হুমকি নেমে আসে। কিন্তু ধীরে ধীরে তার একাগ্রতা তাকে দাসবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। ১৮২০ সালে ব্যক্তিগত জার্নালে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘পৃথিবী থেকে একদিন যুদ্ধ এবং দাসপ্রথা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে’। অন্তত দাসপ্রথার ক্ষেত্রে তার সেই ভবিষ্যদ্বাণী অনেকটাই ফলে গেছে বলা যায়।  

Image Source: quest.eb.com

কয়েক দশক ধরে গ্যাগ রুলের মতো নানা ধরনের ফন্দি এঁটে শক্ত হাতে দাসপ্রথা বিরোধী মতামত দাবিয়ে রাখার প্রচেষ্টা দেশের মধ্যেই বিভাজন সৃষ্টি করে, যার ফলাফল ১৮৬১ সালের গৃহযুদ্ধ। গ্যাগ রুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দাসপ্রথা নির্মূল করতে চাওয়ার মনোভাব আরও সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে এটি রীতিবিরুদ্ধ আন্দোলন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও সবার আন্তরিক চেষ্টায় কিছুদিনের মধ্যেই তা আমেরিকার সাধারণ জনগণের মতাদর্শে পরিণত হয়।

গ্যাগ রুলের প্রেক্ষাপট

দাসপ্রথার সাথে সমঝোতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে এমন অমানবিক একটি রীতিকে অনুমোদন দেয়া সম্ভব হয়। দেশটির প্রারম্ভিক বছরগুলোতে দাসপ্রথার মতো গতানুগতিক একটি বিষয় নিয়ে কংগ্রেসে কোনো বিতর্কের অবকাশই ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে এই ইস্যুটি ছিল এককথায় অনুহ্য। প্রথমবার যখন এই বিষয়টি সংসদে উপস্থাপিত হয় তখন সময়ের হিসেবে সালটি ছিল ১৮২০, মিসৌরি কম্প্রোমাইজ নামক একটি নজিরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন নতুন প্রদেশের সংযুক্তি ঘটছিল তখন।

১৮০০ সালের শুরুর দিকে উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু রাজ্যে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দক্ষিণাংশের চিত্র ছিল একেবারেই উল্টো। এক্ষেত্রে তুলা শিল্পকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই, এর বদৌলতেই দক্ষিণাঞ্চলে দাসদের চাহিদা ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলছিল। আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে, তার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছিলো না। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস, উত্তরাঞ্চলের সদস্য সংখ্যা বেশি থাকা সত্ত্বেও, মেনে নিয়েছিল সংবিধান অনুযায়ী দাসপ্রথা বৈধ এবং স্বতন্ত্র রাজ্যের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলেও দেশের সার্বিক সাংবিধানিক নীতিতে তা ভূমিকা রাখবে না।

Image Source: thumbs-prod.com

সে যা-ই হোক, দাসপ্রথা জারি রাখতে কংগ্রেসের যে নীরব সমর্থন ছিল, তা একটি উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। ঘটনাটি কলম্বিয়া রাজ্যের। এই রাজ্যের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল কংগ্রেসের, আর এখানে দাসপ্রথা ছিল বৈধ। দৈবাৎ এই বিষয়ে উত্তরাঞ্চলের প্রতিনিধিরা কোনো কথা তুললে তা নিয়ে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে যেত। তাদের বারংবার জোর দাবীর পরেও কলোম্বিয়া থেকে দাসপ্রথা নির্মূল করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। একই দলের সদস্য হয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরাঞ্চলীয়দের মতামতের চেয়ে সংবিধানের অমানবিক দিকটিকেই প্রাধান্য দিচ্ছিল কংগ্রেস।

১৮৩০ সাল পর্যন্ত দাসপ্রথাকে অনেক আমেরিকান ঘৃণ্য ও অপরাধমূলক কাজ বলে মনে করলেও সরকারের তাতে বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। সে বছর দাসপ্রথা বিলোপকারীরা প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে নিজেদের মতামত ও দাবী জানাতে শুরু করে। দাসবিরোধী সেসব প্যামফ্লেট বা ছোট পুস্তিকা পাঠানো হয় দক্ষিণে। আন্দোলনকারীদের মনে আশা ছিল, এবার যদি কোনো পরিবর্তন আসে। সাধারণ জনগণের পাঠানো সেই পুস্তিকা শুধুমাত্র তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, অচিরেই দাসপ্রথা বিরোধী সেই সাহিত্য পরিণত হয় চরম বিতর্কিত ফেডারেল ইস্যুতে।

কিন্তু খুব শীঘ্রই প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইন অকৃতকার্য হয়ে পড়ে। কারণ দক্ষিণের অধিবাসীরা সেসব প্যামফ্লেট বাজেয়াপ্ত করে প্রকাশ্যেই রাস্তার উপর পুড়িয়ে ফেলে। তাদের এই বাস্তব বোধশূন্যতা দেখে হতাশ হয়ে পড়ে আন্দোলনকারীরা। এভাবে কাজ হবে না বুঝতে পেরে কৌশলে পরিবর্তন আনে তারা। এবার তারা সোজা কংগ্রেসে পিটিশন বা আবেদন পাঠিয়ে দেয়। সাধারণ জনগণের পিটিশন পাঠানোর আইনটি সন্নিবেশ করা হয় সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে। বর্তমান সময়ে এটি খুব সাধারণ ঘটনা বলে মনে হলেও ১৮০০ সালের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করলে বোঝা যাবে এটি সে সময় কত বড় একটি অর্জন ছিল।

Image Source: cloudfront.net

যখন নাগরিকরা কংগ্রেসে দাসপ্রথা বিরোধী পিটিশন পাঠানো শুরু করলো, হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের সদস্যরা তখন বাধ্য হয় ক্রমবর্ধমান এই সমস্যা নিয়ে মুখোমুখি বিতর্কে অবতীর্ণ হতে। আর ক্যাপিটল হিলে দাসপ্রথার পক্ষপাতী আইন প্রণেতারা একপ্রকার গা ঢাকা দিয়ে চলতে শুরু করলো, যাতে এই সংক্রান্ত কোনো পিটিশনের সামনে তাদের না পড়তে হয়।

কংগ্রেসে জন কুইন্সি অ্যাডামসের ভূমিকা

দাসপ্রথার বিরুদ্ধে জনগণের পিটিশন কিংবা দাসপ্রথার পক্ষপাতী দক্ষিণাঞ্চলীয় সদস্যদের দ্বারা আন্দোলনকারীদের পরাস্ত করার চেষ্টা- কোনোটিই জন কুইন্সি অ্যাডামসের হাত ধরে শুরু হয়নি। কিন্তু তার আগে যিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি একইসাথে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে সর্বসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করার পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্নভাবে তা নিয়ে বিতর্কের অবতারণা করে গেছেন। আমেরিকার জন্মলগ্নে অ্যাডামস একটি অনন্য জায়গা দখল করে ছিলেন। তার বাবা, জন অ্যাডামস, ছিলেন দেশটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট, তারপর তিনি দেশের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার মা, এবিগেইল অ্যাডামসও স্বামীর মতো দাসপ্রথার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।

১৮০০ সালের নভেম্বর মাসে জন এবং এবিগেইল অ্যাডামস হোয়াইট হাউজের প্রকৃত বাসিন্দা হিসেবে সেখানে বসবাস শুরু করেন, বাড়িটির কাজ তখনও চলছিল। এর আগে তারা যেখানে থাকতেন, সংখ্যাগত দিক থেকে আগের চেয়ে কম হলেও সেখানে দাসপ্রথা বৈধ ছিল। প্রেসিডেন্টের ম্যানসনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দলবদ্ধ দাসরা নতুন ফেডারেল শহর গড়ে তুলছে- এই দৃশ্য দেখা প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের জন্য অপমানজনকই ছিল।  

জন কুইন্সি অ্যাডামস; Image Source: history.com

তাদের পুত্র, জন কুইন্সি অ্যাডামস, উত্তরাধিকার সূত্রেই যেন দাসবিরোধী চেতনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তার সর্বজনীন কর্মজীবনে, সিনেটর, সচিব এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে- এই ব্যাপারে কিছু করার মতো তেমন কোনো শক্ত অবস্থান ছিল না। ফেডারেল সরকারের স্পষ্ট মতামত ছিল- সংবিধান অনুযায়ী দাসপ্রথা বৈধ, এর বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। ব্যক্তিজীবনে দাসপ্রথার ঘোর বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও ১৮০০ সালের শুরুর দিকে এসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাডামসকেও এ কথাই মেনে নিতে হয়। ১৮২৮ সালে দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের কাছে হেরে গিয়ে নিজের অবস্থান হারান অ্যাডামস। ১৮২৯ সালে ম্যাসাচুসেটসে ফিরে গিয়ে প্রথমবারের মতো জনগণের প্রতি কোনো দায়ভার না রেখে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার যুদ্ধে নামেন তিনি।

স্থানীয় কয়েকজন নাগরিক তাকে উৎসাহিত করে কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচন করতে লেগে থাকতে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিনি বুঝতে পারেন, এ কাজটির প্রতি তার আগ্রহ কমে এসেছে। তবে যদি জনগণ তাকে বেছে নেয়, তাহলে তিনি আবারও দেশের হয়ে কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে নিজ রাজ্যের হয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি। এই প্রথম এবং শেষবারের মতো আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করে কংগ্রেসের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৩১ সালে ওয়াশিংটনে ফিরে এসে কংগ্রেসের নিয়মনীতির সাথে পরিচিত হতে বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত করেন অ্যাডামস। যখন কংগ্রেসের সেশন শুরু হলো, অ্যাডামস ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে দক্ষিণাঞ্চলের দাসপ্রথার পক্ষপাতী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে একপ্রকার দীর্ঘ যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।

‘দ্য নিউ মার্কারি’ নামক একটি সংবাদপত্রের ১৮৩১ সালের ২১ ডিসেম্বর সংখ্যায় সে বছরের ১২ ডিসেম্বর কংগ্রেসের একটি বিশেষ ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়-

‘অগণিত পিটিশন আর স্মারক আসছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে। এর মধ্যে ১৫টি ছিল পেনিসিলভেনিয়ার ‘সোসাইটি অফ ফ্রেন্ডস’ নামক সংঘের সদস্যদের, দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার বিষয়টি সরকারকে তারা বিবেচনা করার অনুরোধ জানান। কলম্বিয়া রাজ্য জুড়ে দাস পাচারের কথাটিও তারা উল্লেখ করেন। এই পিটিশনটি উপস্থাপন করেন জন কুইন্সি অ্যাডামস।’

কংগ্রেসে অ্যাডামস; Image Source: livejournal.com

পেনসিলভানিয়ার কোয়াকারদের (প্রাথমিকভাবে খ্রিস্টধর্মের পক্ষে আন্দোলনকারী একটি সংগঠন, যারা পরবর্তীতে মানবাধিকার সংরক্ষণেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে) পক্ষ থেকে দাসবিরোধী পিটিশন পাঠিয়ে অ্যাডামস আসলে তার দুঃসাহসের পরিচয় দেন। যা-ই হোক, কলম্বিয়া রাজ্যের প্রতিনিধি কর্তৃক পরিচালিত হাউজ কমিটির হাতে চিঠিটি পড়লে তারা টেবিলের উপরেই তা ফেলে রাখেন এবং ধীরে ধীরে এর কথা ভুলেও যান। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে, অ্যাডামস নিয়মিত বিরতি দিয়ে একের পর এক পিটিশন পাঠাতেই থাকেন এবং প্রতিটি চিঠিই পদ্ধতিগত বিস্মরণের মাধ্যমে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যায়।

১৮৩৫ সালের শেষদিকে, কংগ্রেসের দক্ষিণাঞ্চলের সদস্যরা দাসবিরোধী পিটিশনের ব্যাপারে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কীভাবে তাদের দমন করা যায়, তা নিয়ে কংগ্রেসে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। অ্যাডামসও পূর্ণ উদ্যমে বাকস্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। কথা ছিল ১৮৩৬ সালের ৪ জানুয়ারি হাউজে পিটিশন পাঠাবেন আন্দোলনরত সদস্যরা, সেদিন হঠাৎ করে বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক এক নির্দোষ পিটিশন নিয়ে হাজির হন অ্যাডামস। এরপরই তিনি উপস্থাপন করেন ম্যাসাচুসেটসের নাগরিকদের লেখা দাসপ্রথা নির্মূলের দাবীতে সোচ্চার এক পিটিশন।

হাউজ চেম্বারের প্রতিটি সদস্য এবার নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হন। হাউজের স্পিকার, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট এবং টেনেসি কংগ্রেসম্যান জেমস কে পলক, কঠোর সংসদীয় আইন জারির মাধ্যমে অ্যাডামসের এ ধরনের পিটিশন উপস্থাপনা বন্ধ করার আহ্বান জানান। ১৮৩৬ সালের জানুয়ারি মাস জুড়ে অ্যাডামস চেষ্টা চালিয়ে যান দাসবিরোধী পিটিশনগুলো কার্যকর করতে, আর এদিকে হাউজ কমিটি জোর প্রচেষ্টা চালায় যাতে নতুন নতুন নিয়ম চালু করে হলেও অ্যাডামসের কথা বিবেচনা না করা হয়। হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসের সদস্যরা যেন হাবুডুবু খেতে লাগলো। শুধুমাত্র এই পিটিশন পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন একটি কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিল তারা।

চালু হলো গ্যাগ রুল

পিটিশন দমন করার একটি কার্যকর পন্থা খুঁজতে বেশ কয়েক মাস ধরে লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল হাউজ কমিটি। ১৮৩৬ সালের মে মাসে কমিটিটি সমাধান হিসেবে নিম্নলিখিত একটি আইন জারি করে, যার মাধ্যমে দাসপ্রথা নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনার উপর একেবারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

প্রতীকী ছবিতে গ্যাগ রুলের বিরোধিতা; Image Source: humanosphere.org

‘সব রকমের পিটিশন, স্মারক, সমাধান, পরামর্শ, নথিপত্র বা সম্ভাব্য যেকোনো পন্থায়, তা লিখিতই হোক বা মৌখিক, যাতে দাসপ্রথা বিলোপ বা এ সংক্রান্ত কোনো কথা উল্লেখ থাকবে, তার স্থান হবে টেবিলের উপর এবং তা নিয়ে পরবর্তীতে কোনো ধরনের আলোচনা করা বা ব্যবস্থা নেয়া যাবে না।’

১৮৩৬ সালের ২৫ মে উত্তপ্ত এক কংগ্রেসীয় বিতর্কে কংগ্রেসম্যান জন কুইন্সি অ্যাডামস দাসপ্রথা নিয়ে কেন চুপ থাকতে হবে, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ চান। স্পিকার জেমস কে পলক তাকে উপেক্ষা করে অন্যান্য সদস্যদের কথা বলার সুযোগ করে দেন। ঘটনাক্রমে অ্যাডামস কথা বলার সুযোগ পেলেও দাস প্রসঙ্গ ওঠা মাত্রই স্পিকার জানিয়ে দেন এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই এবং এই সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে কথা বলা একদম নিষেধ। অ্যাডামস যতবারই কথা বলতে যান, প্রতিবারই তাকে বাধা দেন স্পিকার জেমস।

ম্যাসাচুসেটসের আমহার্স্টের একটি সংবাদপত্র, ‘দ্য ফার্মারস ক্যাবিনেট’, ১৮৩৬ সালের ৩ জুন সংখ্যায় অ্যাডামসের ক্ষোভ প্রকাশ করে, যা তিনি ২৫ মে সংবাদপত্রটিকে জানিয়েছিলেন-

‘বিতর্কের একপর্যায়ে তিনি স্পিকারের কাছ থেকে একটি সিদ্ধান্ত প্রার্থনা করে ব্যর্থ হয়ে চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘চেয়ারে বসে থাকা স্পিকার নিজেও একজন দাস পাকড়াও কর্মী’। তার কথায় দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে হাউজের সবাই।

‘’পরিস্থিতি অ্যাডামসের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে’, জানায় তারা। ‘মাননীয় স্পিকার, আমি তো গ্যাগ রুল ভেঙেছি, তাই না?’’ অ্যাডামসের এই প্রশ্নটি পরবর্তীতে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। আর যখন হাউজে দাসপ্রথা বিরোধী কোনো কথা বলার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়, প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান অ্যাডামস। সত্যিই তিনি গ্যাগ রুল ভেঙেছিলেন, আর হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে আর কেউ কখনো এই কাজ করার সুযোগ পাবে না।

লাগাতার যুদ্ধ

হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসের নিয়ম মোতাবেক, কংগ্রেসের প্রতিটি অধিবেশনের আগে নতুন করে একবার গ্যাগ রুল জারি করা হতো। কাজেই আট বছর ধরে কংগ্রেসের চারটি কমিটি, যার মধ্যে দক্ষিণীয়রা তো বটেই, নিশ্চুপ উত্তরীয় সদস্যরাও এই অন্যায় নীরবে মেনে নিতে থাকে। গ্যাগ রুল বিরোধীরা, যার মধ্যে জন কুইন্সি অ্যাডামসের নামই সবার আগে আসে, যখন যেভাবে পারলেন এর বিরোধিতা করতে লাগলেন। কংগ্রেসে অ্যাডামসের নামই হয়ে গেল ‘বৃদ্ধ তর্কবাগীশ’। যখনই তিনি দাসপ্রথার বিরুদ্ধে মুখ খোলার চেষ্টা করতেন, দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিনিধিরা একটা না একটা বাহানা বের করে তার মুখ বন্ধ করে দিত।

Image Source: newrepublic.com

অ্যাডামস যেহেতু গ্যাগ রুল তথা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, তার কাছে একের পর এক মৃত্যু পরোয়ানা আসতে থাকে। এদিকেও কংগ্রেসেও তাকে নিয়ে অনুযোগ উঠতে থাকে। ১৮৪২ সালের প্রথমাংশে অ্যাডামসের বিরুদ্ধে অভিযোগ-অনুযোগ নিয়ে হাউজ কমিটির সদস্যরা আদালতে যাওয়ার পাঁয়তারা শুরু করে। কিন্তু অ্যাডামস প্রতিটি অভিযোগের এমন যৌক্তিক পাল্টা উত্তর দিতে থাকেন যে প্রতিটি সংবাদপত্রে তাকে বীরোচিত সম্মানে ভূষিত করা হয়। বিশেষত উত্তরাঞ্চলে তার এই বীরত্বকে সাধুবাদ জানানো হয়, তার কল্যাণেই বাকস্বাধীনতা এবং উন্মুক্ত বিতর্কের রাস্তা খুলে যায়।

অ্যাডামসের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সাহস কখনোই কারো হয়নি। তিনি নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যাতে তার ঘোর বিরোধীরাও একাট্টা হয়ে তাকে দমাতে পারেনি। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি বীরদর্পে অগ্নিঝরা কণ্ঠে বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। দাসদের মালিকানা নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় কংগ্রেসম্যানদের কটাক্ষ করতেও বিন্দুমাত্র কার্পণ্যবোধ করেননি তিনি।  

গ্যাগ রুলের যবনিকা পতন

গ্যাগ রুল টিকে ছিল প্রায় ৮ বছর। কিন্তু দিনকে দিন তা অগণতান্ত্রিকতার খেতাব পেয়ে বাজে দিকে মোড় নিচ্ছিল। ১৮৩০ সালে দক্ষিণের কংগ্রেস সদস্যরা সমঝোতা করার মনোভাব নিয়ে দাসপ্রথার কাছে একপ্রকার আত্মসমর্পণ করে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এসে গোটা জাতি দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন মুখর হয়ে ওঠে। ১৮৪৪ সালের ৩ ডিসেম্বর জন কুইন্সি অ্যাডামস গ্যাগ রুল রদ করার দাবী উত্থাপন করেন। হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসের ১০৮ জন সদস্যের মধ্যে ৮০ জন তার সাথে সহমত জ্ঞাপন করেন। কাজেই হাউজে দাসপ্রথা নিয়ে কথা বলতে আর কোনো বাধা থাকে না।  

Image Source: womensenews.org

গৃহযুদ্ধের আগপর্যন্ত আমেরিকায় দাসপ্রথা চালু ছিল। কাজেই কংগ্রেসে কথা বলে এর কোনো সমাধান আসেনি তা বলাই বাহুল্য। তবুও এমন একটি সংবেদনশীল বিষয়ে কথা বলে, জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে পরিবর্তনের রাস্তা অনেকটাই উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন অ্যাডামস ও তার সমর্থকেরা। গ্যাগ রুল বন্ধ হওয়ার পর আরও চার বছর কংগ্রেসের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন অ্যাডামস। তার পথ ধরে তরুণ রাজনীতিবিদরাও দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে।

১৮৪৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হাউজ চেম্বারে নিজের ডেস্কেই অসুস্থ হয়ে পড়েন অ্যাডামস। তাকে স্পিকারের অফিসে নিয়ে যাওয়া হলে পরদিন তিনি মারা যান। সে সময় অ্যাডামসের পাশে ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন, যিনি গৃহযুদ্ধের সময় দাসপ্রথা নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

This article is based on the gag rule in Congress against anti-slavery movement. References are hyperlinked.

Feature Image: thoughtco.com

Related Articles