তুরস্কের দেবলেত-ই-আলিয়া, পারস্যের শাহ কিংবা ভারতের পাল বংশ- এরকম অনেক রাজবংশের নামের সাথেই আমরা পরিচিত, যারা দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করে গেছে। তবে আজ এমন এক রাজ পরিবারের কথা বলা হবে যারা টিকে আছে প্রায় ২,৭০০ বছর ধরে! হাজার বছর ধরে ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকে থাকা এই রাজবংশ হলো ইম্পেরিয়াল হাউজ অব জাপান।
এটিই বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা পরিবার। ইম্পেরিয়াল হাউজ অব জাপানের ১২৬ জন সদস্য সম্রাট হিসেবে জাপান শাসন করেছেন, যার শুরু হয়েছিলো ৬৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট জিম্মুর ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে ১২৬ তম সম্রাট হিসেবে দায়িত্বে আছেন নারুহিতো।
সাম্রাজ্যের উত্থান
৭১২ সালে লিখিত এক পান্ডুলিপি থেকে জানা যায় জাপানিদের সূর্যের দেবী এমাতেরাসু ওমিকামি তার পৌত্র মিকোতোকে তিনটি পবিত্র জিনিস দান করেন, যার মধ্যে ছিল একটি তলোয়ার, একটি আয়না এবং একটি রত্ন। এই তিনটি জিনিসকে একত্রে সানশু নো জিংগি বলা হয়। মিকোতো তার পরবর্তী বংশধর জিম্মুকে এগুলো হস্তান্তর করে, যিনি পরে বংশের প্রথম সম্রাট হিসেবে আবির্ভূত হন। জিম্মুর কাছে এই তিনিটি পবিত্র জিনিস থাকায় সবাই তাকে সম্রাট হিসেবে মেনে নেয়।
তৎকালীন জাপানীরা বিশ্বাস করতো সম্রাটের সাথে তাদের দেবতার সরাসরি যোগাযোগ আছে। ফলে খুব দ্রুতই রাজকার্যের প্রসার বাড়তে লাগলো। সাথে বাড়তে লাগলো রাজপরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি। তবে এ বিশাল সাম্রাজ্য সম্রাটের একার পক্ষে শাসন করা দুরূহ হয়ে পড়ে। ফলে সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করে দেন সম্রাট। তবে ৮ম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে তখনকার সম্রাট তেনজি পুরো সাম্রাজ্যকে আবার কেন্দ্রীয় শাসনের অধিকারে আনেন। চীনের ট্যাং সাম্রাজ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনিই প্রথম অ্যাবসল্যুট মোনার্কি (স্বেচ্ছাতন্ত্রী রাজশাসন) চালু করেন। জাপানের প্রথম সংবিধান রচিত হয় প্রিন্স সুতুকোর হাত ধরে, ৮ম শতাব্দীতে, যেখানে বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
৭৯৪ সালে সম্রাট কাম্মু সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী স্থাপন করেন হনশু দ্বীপের কিওটো শহরে। ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত কিওটোই ছিলো জাপানের রাজধানী। এখানে চীনের সংস্কৃতির প্রভাব বিদ্যমান ছিল।
এর কিছুকাল পরেই ধীরে ধীরে অ্যাবসল্যুট মোনার্কি থেকে সরে আসতে থাকে জাপান। বিভিন্ন আঞ্চলিক সেনাপতি কার্যত ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ব্যুরোক্র্যাট সমাজব্যবস্থা পরিলক্ষিত হতে থাকে, যেখানে সম্রাটের কার্যত কোনো ক্ষমতাই থাকে না। প্রশাসনিক ক্ষমতায় নতুন পরিবারের উত্থান লক্ষ্য করা যায়। ফুজিয়ানা ও টাইরা হলো এমন দুটি পরিবার। কিন্তু তারা সম্রাটের প্রতি আনুগত্য রেখেই প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছিল।
এই অবস্থার উন্নতি হয়, আবারও ইম্পেরিয়াল হাউজ অব জাপান অ্যাবসল্যুট মোনার্কি অর্জন করে চতুর্দশ শতাব্দীতে, যখন সম্রাট গোদাইগো ক্ষমতায় আসেন। এরপরে প্রায় ৭০০ বছর ধরে সদর্পে জাপানিজ পেনিনসুলা দাপিয়ে শাসন করে ইম্পেরিয়াল হাউজ অব জাপান।
বিখ্যাত কিছু যুদ্ধ
১. মঙ্গোলদের অভিযান (১২৭৪-৮১)
ইওয়ান সাম্রাজ্যের নামে মোঙ্গলরা তখন চীন শাসন করছিল। মঙ্গোল সম্রাট কুবলাই খান দুবার জাপান আক্রমণ করেন। ১২৭৪ সালে তাদের নৌবহর জাপানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
মঙ্গোলদের ৬০০ জাহাজ আর ৪০,০০০ সৈন্যের বিপরীতে জাপানের সামুরাইদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০,০০০। দু'পক্ষই একে অপরের রণকৌশল সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। সংখ্যায় বেশি হবার কারণে মঙ্গোলরা জয় পাচ্ছিল সব যুদ্ধে। তবে হঠাৎ করে একদিন হাকাতা উপসাগরে ভয়ংকর ঝড় সৃষ্টি হলো। মোঙ্গলদের এ বিষয়ে কোনো প্রস্তুতি ছিল না। নাবিকেরা হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝড়ের মাঝেই জাহাজ ভাসিয়ে দিল চীনের উদ্দেশ্য। জাহাজডুবিতে মারা পড়লো অনেক সেনা। এভাবে প্রথমবার রক্ষা পায় জাপানিরা। পরবর্তীতে ১২৮০ সালে লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করেও কুবলাই খান পরাজিত হন।
২. প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধ (১৮৯৪-৯৫)
চীন ও জাপানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ হয় কোরিয়ায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে। যুদ্ধে জাপান জয়ী হয় এবং পূর্ব এশিয়ার একক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
৩. রুশো-জাপানিজ যুদ্ধ (১৯০৪-০৫)
রাশিয়া সাম্রাজ্য গঠনের পর থেকেই রাজ্যের সীমানা বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করে আসছিল, যার ফলে পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে চীন, জাপানের প্রভাব কমতে শুরু করে। কয়েক বছর আগে চীনকে হারিয়ে জাপান তখন পূর্ব এশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। সম্রাট মেইজি দ্য গ্রেটের বদৌলতে জাপান অর্থনীতি, সামরিক শক্তিতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। রাশিয়ার অদূরদর্শীতার কারণে সীমান্তে উত্তেজনা অবশেষে যু্দ্ধের রূপ নেয়।
জাপানের শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণাই ছিল না রাশিয়ার। ফলে যুদ্ধে রাশিয়ার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফলাফল হিসেবে পূর্ব এশিয়ায় রাশিয়া প্রভাব হারায়, এবং প্রথম কোনো এশীয় দেশ হিসেবে জাপান ইউরোপের কোনো দেশকে যুদ্ধে পরাজিত করে।
৪. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া, আমেরিকা, ব্রিটেনের সাথে একত্র হয়ে যুদ্ধ করে জাপান, জয়ীও হয়।
৫. দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ (১৯৩৭-৪৫)
চীন রিপাবলিক ও জাপান সাম্রাজ্যের মধ্যে এ যুদ্ধ হয়। জাপানি আগ্রাসনের কারণেই এর সূচনা বলে মনে করেন অনেক ঐতিহাসিক। এর সমাপ্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে।
৬. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৪১-৪৫)
চীনের সাথে যুদ্ধ চলাকালেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে জাপান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও এবার তাদের সাথেই যোগ দেয় অক্ষশক্তিতে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল জাপান অধিকার করে। অবশ্য সম্মিলিত আক্রমণের ফলে জাপান পরাজিত হতে থাকে। আর কফিনের শেষ পেরেক হিসেবে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা চালায়। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি হয়।
ইম্পেরিয়াল হাউজের বর্তমান অবস্থা ও সম্পত্তি
একসময়ে অ্যাবসল্যুট মোনার্কির ক্ষমতাধারী পরিবার বর্তমানে পরিণত হয়েছে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে।যদিও এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় জাপানের রাজপরিবার দেশের মানুষের কাছ থেকে বেশি সম্মান ও মর্যাদার আসনে রয়েছে। বর্তমানে সম্রাটের নির্বাহী কোনো ক্ষমতা নেই। পরিবারের প্রথানুযায়ী সম্রাটের বড় ছেলে পরবর্তী সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হবে।
১৯৪৭ সালে যুদ্ধপরবর্তী দেশ গঠনের জন্য রাজপরিবার তাদের সম্পত্তির অনেক অংশই দান করে দেয়। ১৯৮৯ সালে সম্রাট হিরোহিতো মারা যাওয়ার সময় তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ ছিলো ১১ মিলিয়ন ইউরো। বর্তমান সম্রাট আকিহিতো প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারের মালিক। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে প্রাসাদসহ নানা সুবিধা। তবে সংবিধান অনুসারে রাজপরিবারের সমস্ত সম্পত্তিই রাষ্ট্রের মালিকানাধীন, অর্থাৎ প্রয়োজনে রাষ্ট্র ব্যবহার করতে পারে। উল্লেখ্য, রাজপরিবারের জন্য ২০২১ সালে সরকারের বাজেট ৩২৪ মিলিয়ন ইয়েন।
গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সম্রাট
দ্য ক্রিসেনথিমাম থ্রোনে (চন্দ্রমল্লিকা সিংহাসন) এ পর্যন্ত ১২৬ জন সম্রাট আরোহণ করেছেন। তাই এর ইতিহাস, ঐতিহ্যের বিস্তৃতি ব্যাপক। প্রত্যেক সম্রাটের অবদানের কারণেই আজ হাজার পরেও টিকে আছে ইম্পেরিয়াল হাউজ অব জাপান নামের এই রাজবংশ। তবে ইতিহাসের অমূল্য এই সিংহাসনে বসেছেন এমন কিছু সম্রাট যাদের ভূমিকা উল্লেখ না করলেই নয়।
১. সম্রাট জিম্মু (৬৬০-৫৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
সম্রাট জিম্মুই ইম্পেরিয়াল হাউজ অব জাপানের প্রতিষ্ঠাতা। উপকথা অনুযায়ী সূর্যের দেবী এমাতেরাসুর বংশধর ভাবা হয় তাকে। তিনি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে আশেপাশের দ্বীপাঞ্চল অধিকারে নেন। তিনি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন ১১ ফেব্রুয়ারি। জাপানে ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ডে হিসেবে দিনটি এখনও পালিত হয়।
২. সম্রাট মেইজি (১৮৬৭-১৯১২)
মেইজি দ্য গ্রেট নামেই বেশি পরিচিত। আজকের আধুনিক শিল্পসমৃদ্ধ জাপানের গোড়াপত্তন করেন তিনিই। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন, জাপান ছিল সামন্ততান্ত্রিক দেশ, যেখানে শিল্পায়নের ছিটেফোঁটাও ছিলো না। অর্থনীতি ছিল দুর্বল কৃষিনির্ভর। আড়াই শতাধিক প্রদেশে ভাগ ছিল সাম্রাজ্য। তিনি সাম্রাজ্যে আমূল পরিবর্তন আনেন।রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থায় বিপ্লবের সৃষ্টি করেন, যার ফলে জাপান দ্রুতই বিশ্ব পরাশক্তিতে পরিণত হয়।
৩. হিরোহিতো (১৯২৬-৮৯)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে জড়িত সম্রাট হিরোহিতোর অনেকেরই জানা। ৬৩ বছরের শাসনকালে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন তিনি। জাপানের ১২৪ তম সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা দূর করতে বদ্ধপরিকর হন। এদিকে সামরিক বাহিনীও লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। তবে মনে মনে চাইলেও সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টাই তিনি করেননি। উপরন্তু নাৎসি আর ফ্যাসিস্টদের সাথে যোগ দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক এলাকা, প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেন। এমনকি প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত মার্কিন নৌ ঘাটি পার্ল হারবারে অকস্মাৎ আক্রমণ করে সফলও হন, যার ফল হলো ভয়াবহ।
হিরোশিমা, নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেললো আমেরিকা। লাখ লাখ মানুষ হতাহত হলো। আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে জাপান যুদ্ধের ইতি টানলো। যুদ্ধের পর যেখানে ঘৃণিত হওয়ার কথা, সেখানে জাপানের মানুষ তার পাশে দাঁড়ালো, নতুন করে দেশ গড়ে তুলতে তার আহ্বানে সাড়া দিল। জাপান বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হলো, যার কৃতিত্ব বহুলাংশে সম্রাট হিরোহিতোর।
এভাবে জাপানের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ইম্পেরিয়াল হাউজ অব জাপান। এক অর্থে বলাই যায়, ইম্পেরিয়াল হাউজের ইতিহাসই জাপান, আর জাপানের ইতিহাসই ইম্পেরিয়াল হাউজ।
This Bengali article discusses the history of the Imperial House of Japan.
Reference:
2. Japan’s Emperor and Imperial Family
6. Finances of the Imperial House
7. How are the imperial family's money and property managed?