Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মন্যুমেন্টস মেন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক অজানা অধ্যায়

ইউরোপ জুড়ে বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলো চুরি হয়ে যাচ্ছে। লবণ খনিগুলোর অভ্যন্তরে বিখ্যাত চিত্রকর্ম ও অন্যান্য নির্দশন লুকোনো। অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে একটি বিশ্বখ্যাত যাদুঘরের সমস্ত নিদর্শন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। চিত্রশিল্পী, ইতিহাসবিদ এবং যাদুঘরের তত্ত্বাবধায়কদের নিয়ে গঠিত একটি ছোট দল ইউরোপের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে বাঁচানোর জন্য সময়ের বিরুদ্ধে লড়ছে। কোনো অ্যাডভেঞ্চার সিনেমার কাহিনীর মতো শোনালেও বাস্তবে এটি ‘মন্যুমেন্টস মেন’-এর বাস্তব গল্প।

১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে ইউরোপে নাৎসি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। তারা সফলতার সাথে ইউরোপের প্রতিটি ইঞ্চি লুণ্ঠন শুরু করলে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

নাৎসিরা কয়েক মিলিয়ন মানুষের ভবিষ্যৎ ছিনিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা তাদের অতীতকেও ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। হিটলারের বাহিনী ইউরোপের গির্জা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা (বিশেষত ইহুদি পরিবারের সদস্যদের) থেকে অমূল্য চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, ধর্মীয় প্রতীক এবং সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলো লুণ্ঠন করে। তারা বাদ্যযন্ত্র, পুরোনো গ্রন্থাগার, মোজেসের অনুশাসন সম্বলিত কয়েক শতাধিক প্রাচীন স্ক্রল, হাজার হাজার গির্জার ঘণ্টা, এমনকি স্ট্রেসবার্গ ক্যাথেড্রালের ঠিক বাইরের কাচও লুট করে নেয়।

জার্মানির এলিগেনে একটি চার্চের মধ্যে সংরক্ষিত নাৎসি বাহিনীর লুট করা শিল্পকর্ম; Image source: National Archives

এই লুটতরাজের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। পুরো পৃথিবীতে নিজের আধিপত্য এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্নে নিমগ্ন হওয়ার অনেক আগে ভবিষ্যতের জার্মান স্বৈরশাসককে অন্যরকম এক আবেগ মোহগ্রস্ত করে- শিল্প। তবে ভিয়েনার একাডেমি অফ ফাইন আর্টস কিশোর হিটলারকে অযোগ্য বলে প্রত্যাখ্যান করার পর তার শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে যায়। শিল্পের প্রতি হিটলারের অদম্য আগ্রহ কখনোই কমেনি, বরং নিজের জন্মস্থান অস্ট্রিয়ার লিঞ্জ শহরে বিশ্বের  মূল্যবান সব শিল্পকর্ম দিয়ে পরিপূর্ণ ‘ফারমিউজিয়াম’ নামে একটি ব্যক্তিগত যাদুঘর তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্থানের সাথে সাথে হিটলারের কমান্ডিং জেনারেলরা দলগতভাবে শিল্পকর্ম চুরি করতে শুরু করেন। তারা ‘আইনস্টাস্টাব রেইচস্লেটার রোজেনবার্গ’ (ইআরআর) দল গঠন করেন, যাদের সুস্পষ্টভাবে পূর্বের পরিকল্পনানুযায়ী পুরো ইউরোপ জুড়ে শিল্প ও সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলোতে লুটপাট চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্যারিসের যাদুঘর ‘গ্যালারি নেশনালে ডু জিউ ডি পাউম’কে নাৎসি বাহিনীর লুট করা ধন-সম্পদ সংরক্ষণ করার কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগার হিসাবে ঠিক করা হয়। এর বাইরে নাৎসিরা জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া জুড়ে অবস্থিত লবণের খনি ও প্রাচীন দুর্গ তাদের লুটপাট করা সম্পদ লুকিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করতো।

জার্মানির ন্যুশওয়াস্টাইন প্রাসাদে রাখা নাৎসিদের লুট করা শিল্পকর্ম; Image Courtesy: Thomas Carr Howe

তাদের লুট করা সম্পদের মধ্যে বিখ্যাত শিল্পী র‌্যামব্র্যান্ড, দ্য ভিঞ্চি, পিকাসো, ম্যাটিস, জোহানেস ভার্মির, ভ্যান গগসহ অনেকের অগণিত কাজ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এগুলো যাদুঘর, পাবলিক গ্যালারি এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে লুট করা হয়। হিটলারের ডেপুটি (ডান-হাত হিসেবে পরিচিত) হারমান গোরিং বিশবার প্যারিসের জিউ ডি পাউমে পরিদর্শন করেন যাতে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত মাস্টারপিসগুলো নিতে পারেন এবং অবশেষে শুধুমাত্র নিজের জন্য দুটি মালবাহী রেলগাড়ি ভর্তি শিল্পকর্ম নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এ থেকেই অনুমান করা যায় যে, নাৎসি বাহিনী পুরো ইউরোপ থেকে কী পরিমাণ লুট করেছিল। লুটতরাজের পরিমাণ এত বিশাল ছিল যে জেনারেল ডুয়াইট ডি আইজেনহাওয়ারের মতো যারা বন্দিশিবির এবং যুদ্ধক্ষেত্রের নৃশংস ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাদেরকেও হতবাক হতে হয়। আইজেনহাওয়ার ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্টে একজন শ্রোতাকে বলেন, “গুহা, খনি এবং বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের আড়ালে আমরা দেখতে পেয়েছিলাম হিটলার এবং তার দল … পুরো ইউরোপ থেকে জমা করা শিল্পকর্ম জমিয়ে রেখেছিল।

ইতিহাসের সবচেয়ে বড়  শিল্পকর্ম চুরির মধ্যে নাৎসি নেতারা তাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার জন্য ইউরোপের অভিজাত যাদুঘরের নির্দশনসমূহের বর্ণনামূলক তালিকাকে ‘শপিং লিস্ট’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।  বার্লিনে, হিটলারকে চুরি করা শিল্পকর্মের ছবিতে ভরা একটি অ্যালবাম দেওয়া হয় যেটি দেখতে কোনো অভিজাত দোকানের জিনিপত্রের ক্যাটালগের মতো লাগছিল এবং সেখান থেকে হিটলার তার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা ‘ফারমিউজিয়াম’ এর জন্য শিল্পকর্ম বেছে নেন।

যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই শিল্প ইতিহাসবিদ এবং যাদুঘরের পরিচালকরা সাংস্কৃতিক ধন-সম্পদের চুরি ও ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা মিত্রবাহিনীকে যুদ্ধে ধ্বংসের আশঙ্কায় থাকা ইউরোপের বিভিন্ন নির্দশন এবং শিল্পকর্মগুলোকে সনাক্ত এবং সুরক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত একটি সংগঠন তৈরির লক্ষ্যে তদবির চালান এবং ১৯৪৩ সালে মিত্রবাহিনী Monuments, Fine Arts, and Archives (MFAA) প্রতিষ্ঠা করে। এটি ইতিহাসবিদ, স্থপতি, যাদুঘর তত্ত্ববধায়ক এবং অধ্যাপকদের সমন্বিত সংগঠন যাদের বেশিরভাগই ছিল মধ্যবয়স্ক পুরুষ এবং যাদের যুদ্ধের পূর্বঅভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ কোনোটিই ছিল না, কিন্তু ইউরোপের শিল্পকর্ম পুনরুদ্ধারের জন্য তারা ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ১৩টি দেশের প্রায় ৩৫০ জন নারী-পুরুষ ‘মন্যুমেন্টস মেন’ নামে পরিচিত ইউনিটে যোগদান করেন।

মন্যুমেন্টস মেন-এর সদস্যরা উদ্ধারকৃত Ghent Altarpiece চিত্রকর্মটি পরীক্ষা করছেন; Image source: Salem News

মন্যুমেন্টস মেন নামে পরিচিত এই বাহিনীর উপর গির্জা এবং যাদুঘরগুলোর মতো স্থানের সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো শিল্প রক্ষার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করা হয়। যুদ্ধের অগ্রগতির সাথে সাথে নাৎসিদের চুরি করা শিল্পকর্মের দলিল তৈরি করা এবং পুনরুদ্ধারের দায়িত্বও তাদের উপর এসে পড়ে। তাদের অন্যতম বড় সাফল্য ছিল ‘মোনালিসা’কে ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন বাড়িতে দক্ষতার সাথে লুকিয়ে রেখে নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করা।

সার্জেন্ট হ্যারি এটলিংগার ২০০৭ সালে ‘রেপ অফ ইউরোপা’ বইয়ের আদলে ডকুমেন্টারি তৈরির জন্য এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাদের উপর অনেক বেশি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।” “আমাদের কাছে কোনো ট্রাক ছিল না, কোনো জিপও ছিল না। সম্বল বলতে জুতো ছাড়া আর কিছুই ছিল না এবং উপরমহল থেকে কোনো ধরনের সমর্থনও ছিল না।

এই গ্রুপের উল্লেখযোগ্য সদস্যদের একজন রোজ ভাল্যান্ড, একজন আর্ট কিউরেটর এবং প্যারিসের জিউ ডি পাউম যাদুঘরের একমাত্র কর্মী, যাকে নাৎসিরা যাদুঘর দখলের পরে রেখেছিল। নাৎসিরা জানতো না যে ভাল্যান্ড জার্মান ভাষায় পারদর্শী এবং সে তাদের সব কথোপকোথন আড়ি পেতে শুনত। তারপরে সে তাদের পরিকল্পনা ফরাসি ক্যাম্পে পৌঁছে দিত। ফ্রান্স থেকে চুরি হওয়া শিল্পকর্ম শনাক্ত করতে তিনি মন্যুমেন্টস মেনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন। তাদের আরেকজন অমূল্য সদস্য জর্জ স্টাউট, যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং হার্ভার্ড আর্ট সংরক্ষক। তিনি সংরক্ষণের নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ‘আলতাউসি আর্ট রেসকিউ’ নামে সবচেয়ে বড় অপারেশনের সাথেও যুক্ত ছিলেন।

মন্যুমেন্টস মেন-এর অন্য সদস্যদের সাথে জর্জ স্টাউট (বাম থেকে তৃতীয়); Image source: Archives of American Art

১৯৪৫ সালের মে মাসে ইউরোপে যুদ্ধ থেমে গেলেও মন্যুমেন্টস মেনের কাজ শুরু হয় মাত্র। ইউরোপ নাৎসিদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মুক্তি পেলেও এর সাংস্কৃতিক সম্পদ তখনও নিরুদ্দেশ ছিল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নাৎসিদের লুটতরাজ পুরোমাত্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৩-৪৫ সালের মধ্যে নাৎসিরা জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার আলতাউসি, মিকার্স এবং সিগেন জুড়ে অবস্থিত খনিগুলোতে তাদের চুরি করা শিল্পের বিশাল সংগ্রহ লুকিয়ে রাখে। গোরিংয়ের অধীনে কাজ করা এক জার্মান সৈনিকের খবরের মাধ্যমে মিত্রবাহিনী খনিগুলোতে লুকিয়ে রাখা বিশাল শিল্প সংগ্রহশালার খবর পায়। ৪০-৪৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রা এবং ৬৫ শতাংশ আর্দ্রতা খনিগুলোতে মূল্যবান শিল্পকর্মগুলোকে লুকিয়ে রাখতে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছিল।

জার্মানির লবণ খনিতে নাৎসিদের লুুুুকিয়ে রাখা শিল্পকর্ম পরিদর্শন; Image source: Archives of American Art

নাৎসি বাহিনীর ধনসম্পদ ছিল প্রচুর। শুধুমাত্র মিকার্সের লবণের খনিতে মার্কিন কর্মকর্তারা ৩০ মাইল লম্বা গ্যালারি এবং এক বিলিয়ন ইউরো মূল্যমানের স্বর্ণমুদ্রা পেয়েছিলেন। আলতাউসি খনিতে ১৩৭টি টানেলের মধ্যে কয়েক হাজার চিত্রকর্ম, ৯৫৪টি আলোকচিত্র এবং ১৩৭টি ভাস্কর্য ছিল।

মন্যুমেন্টস মেন-এর সদস্যরা লবণের খনিতে লুকিয়ে রাখা ‘Madonna and Child’ স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুত করছেন;
Image source: Archives of American art

২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অ্যাকশন-কমেডি মুভি ‘দ্য মন্যুমেন্টস মেন’ এর আগে মন্যুমেন্টস মেন-এর অসাধারণ কৃতিত্বের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ জানতো না। মুভিটি বিশ্বব্যাপী দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। এটি রবার্ট এম এডসেল রচিত  ‘The Monuments Men: Allied Heroes, Nazi Thieves, and the Greatest Hunt in History’ অবলম্বনে নির্মিত।

২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘The Monuments Men’ মুভির পোস্টার; Image source: Screen Rant

মুভিটি বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে শৈল্পিক স্বাধীনতা নেয়। তবুও এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বার্তা দিতে সক্ষম হয় তা হলো, এমএফএএ-এর পুরুষ এবং মহিলারা না থাকলে ইউরোপের অনেক মূল্যবান নিদর্শন চিরতরে হারিয়ে যেত।

Related Articles