Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সৌন্দর্যের দেবী ক্লিওপেট্রা: প্রাচীন মিশরের সর্বশেষ রানীর উত্থান-পতন

ক্লিওপেট্রা; মিশরের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ আছে অথচ এ নামটি শোনেননি, এমন মানুষ হয়তো নেই। এই নারী শাসকের প্রেম আর সৌন্দর্যের ফাঁদে পড়েননি, এমন পুরুষ সে আমলে পাওয়া যাবে না বললেই চলে। এই লাস্যময়ী নারী শুধুমাত্র তার রূপের গুণেই কত বড় বড় যুদ্ধ বিনা রক্তপাতে জয়লাভ করেছেন!

অথচ এমন একদিন এসেছিল, যেদিন তাকে কিনা বন্দী হতে হতো অক্টাভিয়ানের হাতে, হয়তো বরণ করে নিতে হতো দাসীর জীবন। তিনি ভেবেছিলেন, এর চেয়ে বরং মৃত্যুই শ্রেয়! সারা জীবন তিনি বিলাসিতা আর সৌন্দর্যের যে উপাখ্যান রচনা করেছেন, মৃত্যুতেও সেই ইতিহাস অমর করে রাখতে চেয়েছিলেন ক্লিওপেট্রা। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন অমরত্ব লাভের অন্য পথ। বিষাক্ত সাপ তুলে নিয়েছিলেন হাতে, আর সেই সাপ ছোবল মারে তার বুকে।

ক্লিওপেট্রা, শিল্পীর কল্পনায়; egyptianartcaravan.com

হলিউড সিনেমাগুলোতে ক্লিওপেট্রাকে যেভাবে শুধুমাত্র এক আকর্ষণীয় নারী চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, বাস্তবে তিনি ছিলেন তার চেয়েও ঢের বেশি। অসম্ভব কুশলী আর যথেষ্ট রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন তিনি। তারপরও কীভাবে এই করুণ পরিণতির সম্মুখীন হলেন ‘সৌন্দর্যের দেবী’ বলে আখ্যায়িত ক্লিওপেট্রা, সেটিই তুলে ধরা হচ্ছে আজকের লেখায়।

৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজা টলেমি অলেটিসের ঘরে জন্ম নেন সপ্তদশ ক্লিওপেট্রা। ধন-দৌলত, ঐতিহ্য বা ইতিহাস- সবদিক থেকেই মিশর ছিল অতুলনীয়। ক্লিওপেট্রা জন্মানোর আরো ১০০ বছর আগে থেকেই অন্য এক পরাশক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল সে অঞ্চলে, সেই শক্তির অধিপতি ছিল রোমানরা। মিশরের বুকে টলেমি রাজবংশের রাজত্ব প্রায় ৩০০ বছর ধরে চলছিল। টলেমিদের পূর্বপুরুষ ছিলেন গ্রিকের মেসোডোনিয়ার। আদি অধিবাসী না হয়েও বছরের পর বছর মিশরের নাগরিকদের শাসন করে আসছিল তারা, এই নিয়ে ধীরে ধীরে ক্ষুব্ধ হতে থাকে মিশরীয় রক্ত ধারণ করা মানুষগুলো। ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে টলেমি রাজত্ব। যেকোনো সময়েই রোমানরা আক্রমণ চালাতে পারে, এই ভয়ে টলেমি বংশ রোমানদের সাথে শান্তিচুক্তি করে। দামি দামি উপঢৌকন আর প্রজাদের কর রোমানদের পাঠিয়ে তুষ্ট রাখতে চায় টলেমিরা, বিনিময়ে তাদের চাওয়া ছিল মিশরের শাসক হিসেবে বহাল থাকা।

এমনই এক নড়বড়ে অবস্থায় জন্ম ক্লিওপেট্রার। ৫১ খ্রিস্টপূর্বে অলেটিস যখন মারা যান, তার উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যান তার মেয়ে ক্লিওপেট্রা আর ছেলে ত্রয়োদশ টলেমিকে। প্রাচীন মিশরের নিয়ম অনুসারে, একজন নারী শাসক সবসময়ই পুরুষ শাসকের অধীনে থাকবে। তবে ক্লিওপেট্রার ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। সিংহাসনে আরোহণের কিছুদিনের মাথায় সরকারি সকল নথি থেকে, এমনকি মুদ্রা থেকেও ভাইয়ের ছবি বর্জন করেন তিনি। উল্লেখ্য যে, ক্লিওপেট্রার বয়স ছিল তখন ১৮ আর টলেমির বয়স ১০ এবং তাদের বিয়েও হয়েছিল! এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ, প্রাচীন মিশরীয় বংশে এটি ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এ রীতির ফলে সিংহাসনের দাবিদার যেমন কমে যেত, তেমনি রাজবংশের মেয়েরাও রানী হিসেবে যথোপযুক্ত মর্যাদায় জীবন অতিবাহিত করতেন! কিন্তু ক্লিওপেট্রা এতেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার চোখে ছিল সারা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নারী আর ধনকুবের হওয়ার স্বপ্ন।

কিন্তু অচিরেই তার এই পন্থা রাজকার্যের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের খেপিয়ে তোলে। কিছুদিনের মধ্যেই তাকে এই কার্যকলাপের প্রতিবাদে আলেকজান্দ্রিয়া (তৎকালীন মিশরের রাজধানী) থেকে বিতাড়িত করেন ত্রয়োদশ টলেমি। ক্লিওপেট্রা পালিয়ে যান সিরিয়ায়।

মাঝে আরও বেশ কিছু বিরোধের ঘটনা ঘটে রোমান আর মিশরীয়দের মাঝে। একদিকে ক্লিওপেট্রা ছিলেন নিজের শাসন ক্ষমতা ফিরে পেতে উদগ্রীব, আর অন্যদিকে মিশরের দিকে চোখ ছিল রোমান সাম্রাজ্যের। একদিকে ছিলেন টলেমি, ক্লিওপেট্রা; অন্যদিকে ছিলেন জুলিয়াস সিজার। জুলিয়াস সিজার হলেন রোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের এক ঐতিহাসিক চরিত্র। সিজারের সাথে ছিল সেপ্টিমিয়াস আর আচিলাসের বাহিনী। সিজার খুব সহজেই টলেমিকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন। আর তখনই চাল চাললেন বুদ্ধিমতী ক্লিওপেট্রা।

অ্যাপোলোডোরাস নামের বিশ্বস্ত সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দরে হাজির হলেন তিনি। খুব দামি একটি কম্বল কিনে ক্লিওপেট্রাকে ওই কম্বল দিয়ে পেঁচিয়ে সিজারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন অ্যাপোলোডোরাস। যুদ্ধের সময় এমন একটি উপহার পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন সিজার। ভেতরে ক্লিওপেট্রাকে পেয়ে আকাশ থেকে পড়লেন তিনি। তাকে দেখে সিজারের যেন মাথা ঘুরে গেল। আর সিজারকে বশ করতেও খুব বেশি সময় লাগল না ক্লিওপেট্রার। ব্যাপারটি ভাবলে দেখা যায়- একদিকে টলেমি ক্ষমতাচ্যুত হলেন, আলেকজান্দ্রিয়ার জন্য যুদ্ধ করলেন সিজার আর সেপ্টিমিয়াস; ওদিকে বিনা যুদ্ধে সিংহাসনে বসলেন কিনা ক্লিওপেট্রা! একটি সৈন্যও মারা গেল না, একটি তীরও ছুঁড়তে হল না তাকে!

সিনেমার দৃশ্যে কম্বলে পেঁচানো ক্লিওপেট্রা © Peter Snell

ক্লিওপেট্রার সাধ ছিল পৃথিবীর সেরা ধনবান নারী হওয়ার। আর এদিকে মোটা অংকের ঋণ জোগাড়ে জুড়ি ছিল না সিজারের। তাই সম্পর্ক ভালোই চলছিল দুজনের।

কিন্তু ঘটনার অন্যতম নায়ক টলেমিকে ভুলে গেলে চলবে না। এত সহজে ক্ষমতার লোভ ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। পনথিনাসের নেতৃত্বে ২০,০০০ সৈন্য নিয়ে ৪৭ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্দ্রিয়া আক্রমণ করেন তিনি। কিন্তু অচিরেই যুদ্ধে পরাজিত হন টলেমি। পালাতে গিয়ে নীল নদে ডুবে মারা যান তিনি। তার কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন সিজার এবং ক্লিওপেট্রা। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই আততায়ীর হাতে খুন হন সিজার। ক্লিওপেট্রা নিজেকে যেমন মিশরীয় দেবী আইসিসের পুনরুত্থান বলে মনে করতেন, তেমনি সিজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তিনিও খুব শীঘ্রই নিজেকে দেবতা হিসেবে ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। তাই রোমানরা তার এই পাগলামি আর সহ্য করতে না পেরে খুন করেছিল তাকে। অথচ এই খুনের ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হন ক্লিওপেট্রা নিজে। কারণ তখন তিনি হলেন প্রাচীন মিশরের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী।

ঘটনা এখানে শেষ হলেও পারত। কিন্তু আসল নায়কের আবির্ভাব এখনো বাকি। রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বিদ্রোহীদের সাহায্য করার অভিযোগে ক্লিওপেট্রাকে কঠোর বার্তা পাঠান রোমান নেতা মার্ক অ্যান্টনি। অ্যান্টনি জুলিয়াস সিজারের সমর্থক ছিলেন এবং তার জীবদ্দশায় তার জেনারেলদের একজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আলোচনার উদ্দেশ্যে সিলিসিয়ায় যেতে বাধ্য করা হলো তাকে, মহাসমারোহে সিলিসিয়ায় পৌঁছালেন ক্লিওপেট্রা। কিন্তু তাকে দেখে এতটাই বিমোহিত হয়ে পড়েছিলেন অ্যান্টনি, সবকিছু ভুলে রানীর সাথে আলেকজান্দ্রিয়ায় ফেরত আসলেন তিনি। এক বছরের মধ্যে জমজ সন্তানের জন্ম দিলেন ক্লিওপেট্রা। বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ৩৬ খ্রিস্টপূর্বে পুনরায় ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করলেন অ্যান্টনি। আগের স্ত্রীর সাথে বিবাহ-বিচ্ছেদ করলেন তিনি। আর তার সাথে সকল রোমান মুদ্রায় মুদ্রিত হলো ক্লিওপেট্রার ছবি।

অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রার চেহারা খচিত মুদ্রা; Source: wildwinds.com

এসব কিছু ক্ষিপ্ত করে তোলে অ্যান্টনির আগের স্ত্রী অক্টাভিয়ার ভাইকে। নৌপথে আক্রমণ চালান তিনি। অ্যান্টনির বাহিনী এত শক্তিশালী ছিল না যে, এই আঘাত সামাল দিতে পারবে। তাই অচিরেই আলেকজান্দ্রিয়ায় পালিয়ে জীবন রক্ষা করেন তিনি। কিন্তু বিধি বাম! নিজের ভালোবাসার মানুষ ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর মিথ্যা সংবাদ তাকে উদ্যত করে আত্মহত্যা করতে, নিজের তরবারি দিয়ে নিজেরই প্রাণ নেন এই মহান যোদ্ধা। নিজের মৃত্যুর ভুয়া খবর নিজেই ছড়িয়েছিলেন ক্লিওপেট্রা, কিন্তু এ ব্যাপারে অ্যান্টনি জানতেন না কিছুই!

কিছু ভালোবাসার কাহিনী যেমন অমর হয়ে থাকে, তেমনই ছিল ক্লিওপেট্রা আর অ্যান্টনির সম্পর্ক। অ্যান্টনির মৃত্যুর সংবাদে বিচলিত হয়ে ওঠেন তিনি। বুঝতে পারেন, কী বিশাল ভুল হয়েছে তার। এরপর ৩০ খ্রিস্টপূর্বে ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ব্যথা নিয়ে সাপের কামড়ে আত্মাহুতি দেন ক্লিওপেট্রা। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর সাথে সাথে শেষ হয় মিশরে টলেমিদের রাজত্বের, ভিত্তি স্থাপন হয় মিশরের বুকে রোমান সাম্রাজ্যের।

Source: VYC Travel

প্রশ্ন ওঠে, ক্লিওপেট্রা কি আসলেই সৌন্দর্যের দেবী ছিলেন? তার সাফল্যগাথা কি কেবল তার রূপের সাথেই জড়িত ছিল? সিজার অথবা অ্যান্টনির মতো কুখ্যাত নারীঘেঁষা চরিত্র ক্লিওপেট্রাকে কি কেবল তার আকর্ষণীয় রূপের জন্যই ভালোবেসেছিলেন?

বাহ্যিক সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে হয়তো ক্লিওপেট্রাকে মাপা যাবে না। রোমান ইতিহাসবিদ ক্যাসিয়াস ডিও আমাদেরকে বলেন যে, ক্লিওপেট্রার নিজেকে প্রত্যেকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মতো অসাধারণ জ্ঞান ছিল। একইভাবে, গ্রীক ইতিহাসবিদ প্লুটোচ বলেন, ক্লিওপেট্রার সাথে কথোপকথন ছিল একটি অলঙ্ঘনীয় কবিতার মতো; আর তার উপস্থিতি, তার বক্তৃতা যেকোনো চরিত্রকে আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তিনি আরো লিখেছিলেন যে, ক্লিওপেট্রার কণ্ঠে মিষ্টতা ছিল; এবং তিনি সহজেই যেকোনো পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতেন।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ক্লিওপেট্রার ভাস্কর্যের ধ্বংসাবশেষ; Source: ADRIAN DENNIS/AFP/Getty Images

তাই বলা যায়, কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, বরং বুদ্ধি, সাহস আর মর্মস্পর্শী আচরণ দিয়ে তিনি হৃদয় জয় করেছিলেন সিজার ও অ্যান্টনির মতো ক্ষমতাধর পুরুষদের। ক্লিওপেট্রার আসল সৌন্দর্য ছিল তার বুদ্ধিদীপ্ত আচরণে, তা নিয়েই তিনি হাজার হাজার বছর ধরে অমর হয়ে থাকবেন পৃথিবীর ইতিহাসে।

ফিচার ইমেজ: Jozef-Szekeres

Related Articles