উত্তরবঙ্গে সর্বপ্রথম রেল আসে ১৮৭৮ সালে। সাঁড়াঘাট-শিলিগুড়ি এবং পোড়াদহ-দামুকদিয়া রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গে রেলওয়ের আগমন ঘটে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের পর ঈশ্বরদী থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত লাইনটি মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রূপান্তরিত করা হয়। ফলে কলকাতার সাথে নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এই সেকশনটি ছিল উত্তরবঙ্গের প্রধান রেল সেকশন। কিন্তু উত্তরের বিভিন্ন জেলায় ক্রমবর্ধমান কৃষিপণ্য; যেমন- চা, পাট, তামাক, ইক্ষু পরিবহনের জন্য কেবলমাত্র এই একটি লাইনই যথেষ্ট ছিল না। আজকে আমরা জানব উত্তরের বিভিন্ন জেলায় বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়া রেল সেকশনগুলো সম্পর্কে।
পার্বতীপুর-লালমনিরহাট-বুড়িমারী রেল সেকশন
১৮৭৮ সালে সাঁড়াঘাট থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত ৩৩৬ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়। প্রতিষ্ঠার পর এটি ছিল নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে কোম্পানির প্রথম কাজ। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা এবং উত্তরাঞ্চলীয় সমৃদ্ধ অর্থনীতিকে ব্যবসায়িক কাজে বিনিয়োগ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার উত্তরবঙ্গে রেলপথকে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৭৯ সালে পার্বতীপুর থেকে রংপুর, কাউনিয়া, তিস্তা, লালমনিরহাট হয়ে বুড়িমারী পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ করে নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে কোম্পানি।
তিস্তা নদীতে প্রথমে বাষ্পীয় রেলফেরি চলাচল করত। পরে ১৯০০ সালে সেতু নির্মাণ করা হয়। বুড়িমারী লাইনটিকে পরে কোচবিহার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় এবং লালমনিরহাট-জলপাইগুড়ি সেকশনের সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, শুধুমাত্র লালমনিরহাট থেকেই দুটো লাইন ভারতের মধ্যে প্রবেশ করেছে। উল্লেখ্য, ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি ১৮৮৪ সালে সরকারিকরণ করা হয় এবং ১৮৮৭ সালে নর্থ বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে কোম্পানিকে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সাথে একীভূত করা হয়।
পার্বতীপুর থেকে রংপুর হয়ে বুড়িমারী পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের পর কাউনিয়া থেকে তিস্তা জংশন হয়ে দুটি ন্যারোগেজ (২.৫ ফুট) রেলপথ ধরলা নদী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। এই রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। ১৯০১ সালে ধরলা-কাউনিয়া রেল সেকশনকে ন্যারোগেজ থেকে মিটারগেজে উন্নীত করা হয়। ধরলা স্টেশনটি পুরাতন কুড়িগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন হিসেবে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
১৮৭৯ সালে নির্মিত পার্বতীপুর-বুড়িমারী রেল সেকশনের তিস্তা জংশন থেকে একটা ন্যারোগেজ রেললাইন কুড়িগ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যায় হয়। ১৯২৮ সালে এই সেকশনটি ন্যারোগেজ থেকে মিটারগেজে রূপান্তর করা হয়। ১৯৬৭ সালে কুড়িগ্রাম থেকে একটা মিটারগেজ রেলপথ চিলমারী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। বর্ধিত এই নতুন রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৮.৫৫ কিলোমিটার। ১৯৭০ এর বন্যা এবং ভাঙনে চিলমারী স্টেশন ব্রহ্মপুত্র নদের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে এই সেকশনের রমনা বাজার রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত রেলপথ কার্যকর রয়েছে। এছাড়া ট্রেন চলাচল না থাকায় কুড়িগ্রাম পুরাতন রেল স্টেশনও ২০০৩ সালে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে ১৮৯১ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল ডুয়ার্স নামক এক রেলওয়ে কোম্পানি। চা শিল্প অগ্রযাত্রার জন্যই মূলত এই রেল কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর ১৮৯১ সালে এই কোম্পানি লালমনিরহাট থেকে মোঘলহাট, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, মালবাজার হয়ে হিমালয়ের পাদদেশে ভুটান সীমান্তবর্তী ডুয়ার্স পর্যন্ত একটি মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ করে। এই রেলপথের ইতিহাস অনেক বিস্তৃত। আসাম মেইল নামক একটি ট্রেন সান্তাহার থেকে আমিনগাঁও পর্যন্ত নিয়মিত চলাচল করত। কলকতা থেকে দার্জিলিং মেইলে করে সান্তাহার, এবং সান্তাহার থেকে আসাম মেইলে করে আমিনগাঁও (গুয়াহাটি) পর্যন্ত নির্বিঘ্নে যাতায়াত করা যেত। তাছাড়া শিয়ালদহ থেকে সান্তাহার পর্যন্ত ব্রডগেজে আরেকটি আসাম মেইল চলত। ব্রডগেজ আসাম মেইল সান্তাহারে পৌঁছলে ঐ যাত্রীদের নিয়ে মিটারগেজ আসাম মেইল গুয়াহাটির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যেত। এই রুটের আরেকটি ঐতিহাসিক ট্রেন ছিল উত্তরপূর্ব এক্সপ্রেস।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতার পর এই সেকশনটি হুমকির মুখে পড়ে। ১৯৫৫ সালে ভারত-পাকিস্তান পুনরায় ট্রেন চালুর বিষয়ে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। সে বছর থেকেই প্রাণ ফিরে পায় মোগলহাট রেল ট্রানজিট পয়েন্ট। সেসময় মোগলহাট থেকে গীতলদহ পর্যন্ত নিয়মিত যাত্রীবাহী এবং মালবাহী ট্রেন চলাচল করত। এরপর ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের জের ধরে এ রেলপথে পুনারায় বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন শুধু মালগাড়ি চলাচল করলেও স্থায়ীভাবে আর কখনোই এই রুট চালু করা সম্ভব হয়নি।
১৯৯৫ সাল পর্যন্ত মোগলহাট অবধি ট্রেন চলাচল করলেও ২০০২ সালে এসে সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে এ লাইনটি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত এবং প্রায় বিলুপ্ত। একসময়ের জমজমাট ট্রানজিট পয়েন্ট মোগলহাট রেলওয়ে স্টেশনটিও আজ বিলুপ্ত। কালের পরিক্রমায় রেলপথ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও ধরলা নদীর উপরে রেল ব্রিজ আজও কালের সাক্ষী হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই সেকশনটি মোগলহাট থেকে গীতলদহ, বামনহাট হয়ে বাংলাদেশের পাটেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারি, সোনাহাট দিয়ে পুনরায় ভারতের গোলকগঞ্জ পর্যন্ত গিয়েছে। ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন পাটেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারি, সোনাহাটের রেলপথ তুলে ফেলা হয়েছে। কালের বিবর্তনে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী কতকিছুরই পরিবর্তন ঘটে। পাটেশ্বরী-সোনাহাট রেলপথ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও দেড়'শ বছর ধরে সোনাহাট রেল ব্রিজটি আজও নিরলসভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। রেলপথ না থাকায় বর্তমানে এই রেল ব্রিজটি সড়ক ব্রিজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রেল সেকশন
পার্বতীপুর থেকে যখন বুড়িমারী সেকশনে রেলপথ নির্মিত হচ্ছিল ঠিক একই সময় পার্বতীপুর থেকে দিনাজপুর হয়ে রুহিয়া পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হয়। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান আমলে রুহিয়া থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণ করা হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ৯৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রেলপথ আধুনিকায়নের কাজ শুরু হয়। এতে পার্বতীপুর-দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় রেল সেকশনটি ডুয়েল গেজে রূপান্তরিত হয়। ২০১৬ সালে এই আধুনিকায়নের কাজ সমাপ্ত হয়। এদিকে পঞ্চগড় থেকে উত্তরে সীমান্তববর্তী স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রেল সেকশনের কাঞ্চন জংশন থেকে বিরল হয়ে একটা ব্রডগেজ লাইন ভারতের বারাসই পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বর্তমানে এ সেকশনে কোনো যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল না করলেও উভয় দেশের মধ্যে কিছু মালবাহী ট্রেন চলাচল করে। তাছাড়া বিরল স্টেশন থেকে বাংলাদেশের মধ্যে নিয়মিত ট্রেন চলাচল করে।
সান্তাহার-কাউনিয়া সেকশন
সান্তাহারের তৎকালীন নাম ছিল সুলতানপুর। ১৮৯৯ সালে ব্রহ্মপুত্র-সুলতানপুর রেলওয়ে নামক এক কোম্পানি ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তাপাড় থেকে শুরু করে বোনারপাড়া হয়ে সান্তাহার পর্যন্ত ৯৪ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ করে। তিস্তার ভাঙনের ফলে এই লাইনের অনেকাংশই বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে ফুলছড়ি উপজেলার বালাসী ঘাট পর্যন্ত রেলপথ আছে। এদিকে ১৯০৫ সালে পার্বতীপুর-বুড়িমারী রেল সেকশনের কাউনিয়া থেকে ৪৪ কিলোমিটারের একটা মিটারগেজ লাইন বোনারপাড়া পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়। ফলে কাউনিয়া এবং বোনারপাড়া স্টেশন থেকে জংশনে রূপান্তরিত হয়। উল্লেখ্য, বাংলায় তৎকালে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেল কোম্পানি গঠিত হয়েছিল। ব্রহ্মপুত্র-সুলতানপুর রেল কোম্পানিও সেসবের মধ্যে অন্যতম। এই কোম্পানি শুধুমাত্র এই একটি লাইনই নির্মাণ করেছিল।
ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেল সেকশন
বাংলায় রেলপথ নির্মাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত আরেকটি ছোট রেল কোম্পানি হলো সাঁড়া সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের পর ১৯১৫-১৬ সালে ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মিত হয়। বাণিজ্যিক গুরুত্ব বিবেচনায় শুধুমাত্র সিরাজগঞ্জ শহরেই রায়পুর, বাজার স্টেশন, বাহিরগোলা এবং সিরাজগঞ্জ ঘাট নামে চারটি রেল স্টেশন নির্মিত হয়। কালের বিবর্তনে সিরাজগঞ্জ ঘাট এবং বাহিরগোলা স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। শত বছরের পুরনো বাহিরগোলা রেলসেতুটি আজও টিকে আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে শতাব্দীপ্রাচীন এই ব্রিজে ছিল এক চমৎকার প্রযুক্তি। ব্রিজের নিচ দিয়ে যখন উঁচু উঁচু পণ্যবাহী জাহাজ যেত তখন লন্ডন ব্রিজের মতো এই ব্রিজটি মাঝখান থেকে দু'ভাগ হয়ে উঁচু হয়ে যেত। বাহিরগোলা রেল স্টেশন ভবনটি বর্তমানে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে। একসময়ের ব্যস্ততম রেল রুটটি আজ নিশ্চিহ্ন।
১৯৯৯ সালে যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মিত হলে ঢাকার সাথে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ সেকশনের জামতৈল থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ৯৪ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হয়। অবশ্য এর আগে ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন শুধুমাত্র ট্রেন পারাপারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধন করা হয়।
আগে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী সকল ট্রেনকে ঈশ্বরদী আসতে হত। ইঞ্জিন ঘুরিয়ে উল্টোদিকে লাগিয়ে পুনরায় ঢাকা যেতে হত। এতে একদিকে যেমন প্রচুর সময় নষ্ট হত, তেমনি যাত্রীদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হত। এই সমস্যার সমাধানকল্পে ২০০৩ সালে নির্মিত হয় ঈশ্বরদী বাইপাস রেলওয়ে স্টেশন। মজার ব্যাপার হলো, স্টেশনটির নাম ঈশ্বরদী বাইপাস হলেও এর অবস্থান নাটোর জেলার লালপুরের ডহরশৈলাতে।
২০০৩ জামতৈল থেকে ঈশ্বরদী বাইপাস হয়ে পার্বতীপুর পর্যন্ত ব্রডগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হয়। ডুয়েলগেজ হলো এমন একটি লাইন যাতে তিনটি স্লিপারের মাধ্যমে ব্রডগেজ এবং মিটারগেজ উভয় ট্র্যাক বিদ্যমান থাকে। ফলে এই লাইনের উপর দিয়ে ব্রডগেজ এবং মিটারগেজ উভয় ট্রেন চলতে পারে। জামতৈল থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের ফলে ঢাকা তথা পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের সাথে উত্তরবঙ্গসহ পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা সাধিত হয়।
আব্দুলপুর-পুরনো মালদহ রেল সেকশন
এই লাইনটি নির্মিত হয় ১৯৩০ সালে। ঈশ্বরদী-পার্বতীপুর রেল সেকশনের আব্দুলপুর থেকে রাজশাহী, আমনুরা, রহনপুর হয়ে ভারতের পুরনো মালদহ জংশন পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ অংশের রেললাইন বাংলাদেশ রেলওয়ে ও ভারত অংশের রেললাইন ভারতীয় রেলের অধীনে পরিচালিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।
আব্দুলপুর থেকে নির্মাণ শুরু হয় ১৯২৭ সালের দিকে। আগেই কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় আব্দুলপুর থেকে রাজশাহী পর্যন্ত রেলপথ ১৯২৯ সালের ১৪ মার্চ ট্রেন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ উন্মোচন করা হয় ১৯৩০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। আব্দুলপুর-নবাবগঞ্জ কোম্পানি নির্মিত এই রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৫৬ মাইল।
বর্তমানে রহনপুর-সিঙ্গাঁবাদ ট্রানজিট পয়েন্টটি সচল রয়েছে। ১৯৭৮ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ ভারত ও নেপালের মধ্যে এক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে নেপাল থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ট্রানজিট পয়েন্ট ব্যবহার করা হত। মাঝখানে বন্ধ হয়ে গেলেও ২০১১ সালে নেপালে সার রপ্তানির মধ্য দিয়ে এই ট্রানজিট পয়েন্টটি চালু করা হয়। সিঙ্গাঁবাদ-রহনপুর ট্রানজিট পয়েন্টটি নেপালের র্যাক্জল থেকে বাংলাদেশের খুলনা অব্দি কোনো প্রকার ট্রানশিপমেন্ট চার্জ ছাড়াই ব্যবহৃত হয়।
আব্দুলপুর-পুরনো মালদহ রেল সেকশনের আমনুরা থেকে একটি শাখা লাইন চলে গিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে। অপরদিকে মালদহ থেকে একটি মিটারগেজ লাইন ছিল গোদাগাড়ী ঘাট পর্যন্ত, যা নির্মিত হয়েছিল ১৯০৯ সালে। ঠিক তার বিপরীতে (পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে) ছিল লালগোলা ঘাট। সেসময় শিয়ালদহ থেকে যাত্রীরা এসে নামত লালগোলা ঘাটে। লালগোলা ঘাট থেকে স্টিমারে করে পদ্মা পার হয়ে চলে আসত গোদাগাড়ী ঘাটে। গোদাগাড়ী থেকে ট্রেনে করে চলে যেত মালদহ। দেশভাগের পর ঘাটটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রেল রুটটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তাই অলাভজনক কারণ দেখিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার গোদাগাড়ী ঘাট থেকে আমনুরা জংশন পর্যন্ত রেলপথ তুলে ফেলে। কালের সাক্ষী হয়ে এখনও রেলপথটির স্মৃতিচিহ্ন রয়ে গেছে।
আগে রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেতে হলে আমনুরা রেলওয়ে জংশনে ইঞ্জিন ঘুরিয়ে যাওয়া লাগত। এই সমস্যার সমাধানকল্পে ২০১৭ সালে ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে আমনুরা বাইপাস রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়। এতে বর্তমানে রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সরাসরি ট্রেনে করে যাওয়া যায়।
ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালারচর রেল সেকশন
ঈশ্বরদী-ঢালারচর রেলপথ বাংলাদেশের নবনির্মিত রেলপথগুলোর মধ্যে অন্যতম। উত্তরবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং বাণিজ্যিক অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও পাবনা এযাবৎকাল রেলওয়ে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল।
ইতিপূর্বে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মাঝগ্রাম থেকে নগরবাড়ী ঘাট পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। অবশেষে ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর এই রেলপথ আলোর মুখ দেখে। চার দফা সময় বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ১৪ জুলাই মাঝগ্রাম থেকে পাবনা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। পাবনা থেকে ঢালারচর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি। বর্তমানে এই রুটে পাবনা এক্সপ্রেস নামের একটি ট্রেন ঢালারচর থেকে পাবনা, ঈশ্বরদী হয়ে রাজশাহী পর্যন্ত নিয়মিত চলাচল করছে। এই রেলপথের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলো হলো মাঝগ্রাম, দাশুড়িয়া, টেবুনিয়া, পাবনা, দুবলিয়া, সাঁথিয়া, কাশিনাথপুর, বাঁধেরহাট এবং ঢালারচর।
বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে দুই অঞ্চলে বিভক্ত। যমুনার পশ্চিমে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে এবং পূর্বে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে। খুলনা বিভাগ এবং উত্তরবঙ্গ পড়েছে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের আওতায়। পশ্চিমাঞ্চলে আবার দুটি রেল বিভাগ রয়েছে। একটি হলো পাকশী, অপরটি লালমনিরহাট। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সদরদপ্তর রাজশাহীতে অবস্থিত, যা পূর্বে পাকশীতে অবস্থিত ছিল। অপরদিকে পূর্বাঞ্চলেও দুটো রেল বিভাগ রয়েছে। একটি কমলাপুর (ঢাকা), অপরটি হলো পাহাড়তলি (চট্টগ্রাম)। পূর্বাঞ্চলীয় সদরদপ্তর চট্টগ্রামে অবস্থিত।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
১. ভারতবর্ষে রেলওয়ের আগমন - ১ম পর্ব
২. প্রথম যেদিন রেল এলো বাংলায় - ২য় পর্ব
৩. বিহার দুর্ভিক্ষ ও সাঁড়া-পার্বতীপুর-শিলিগুড়ি রেল সেকশন - ৩য় পর্ব
This is a Bengali article. It is the fifth part of the series 'History of Railway in Bangladesh'. It describes the history of railways in North Bengal
Necessary references have been hyperlinked inside the article.
Featured Image: Bangladesh Railway West Zone