Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বোর্নিওর সাদা রাজাদের ইতিহাস

বোর্নিও দ্বীপের নাম অনেকেই শুনেছেন। প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই বিশাল দ্বীপটি অবস্থিত দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দক্ষিণে, সাগরে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এর মালিকানা বিভক্ত ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনেই আর মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে। এই মালয়েশিয়া অঞ্চলেরই একটি প্রদেশের নাম সারওয়াক। ঘন বন আর পাহাড়ে ঢাকা এই দুর্গম প্রদেশটি একসময় পরিচিত ছিল ‘কিংডম অব সারওয়াক’ নামে। স্বাধীন এই রাজ্যটি একশ বছরের বেশি সময় টিকে ছিল।

এতটুকু পড়ে মনে হতে পারে, মালয়েশিয়ার এক প্রান্তে আলাদা একটি স্বাধীন রাজ্য থাকতেই পারে। কিন্তু এই সারওয়াক কিংডম শাসন যারা করতেন, তারা মালয়েশীয় রাজবংশের মানুষ নন। নিখাদ সাদা চামড়ার এক ব্রিটিশ এই শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি এবং তার বংশধরেরাই সার্বভৌম এই অঞ্চল শাসন করে এসেছেন ১৯৪৫ সাল অবধি। জেমস ব্রুক নামের এই ব্রিটিশ অভিযাত্রীর গল্প রুপকথাকেও হার মানায়।

বোর্নিওর ম্যাপ; Source: e-borneo.com

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

ভারতীয় উপমহাদেশ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন চলছে দেশে। বেরেলির এক ইংরেজ বিচারক থমাস ব্রুকের ঘরে জন্ম নিল অ্যাডভেঞ্চারপিয়াসী এক শিশু, নাম জেমস ব্রুক, সাল ১৮০৩। কিছুদিন ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করে জেমস ব্রুক ভারতে এসে যোগ দিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেনাদলের একাংশ, বেঙ্গল আর্মিতে। কোম্পানী তখন হরদম যুদ্ধ লড়ছে। শক্তিশালী বর্মী রাজা বাগিদাও এর সেনাপতি মাহা বান্দুলার সৈন্যরা দখল করে নিয়েছে আসাম। জেমস ব্রুক লড়তে গেলেন সেখানে ১৮২৫ সালে। গুলি খেয়ে ফিরেও আসতে হল কিছুদিন পর। সৈন্যবাহিনীতে ইস্তফা দিয়ে দীর্ঘদিন বিশ্রাম নিলেন। কিন্তু মাথায় অ্যাডভেঞ্চারের নেশা চেপে বসলে ঘরে আর কয়দিন মন টেকে! কিছুদিন চীনে ব্যবসাপাতি করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভাগ্য বিরুপ। শেষমেষ সিন্দুক ঝেড়েঝুড়ে ৩০ হাজার পাউন্ড বের করে কিনে ফেললেন ১৪২ টনের জাহাজ ‘রয়্যালিস্ট’, পাল তুললেন বোর্নিও দ্বীপের উদ্দেশ্যে।

ব্রিটিশ অভিযাত্রী জেমস ব্রুক; Source: malaysia.my.co

বোর্নিওতে আগমন

১৮৩৮ সালে জেমস বর্তমান সারওয়াক প্রদেশের রাজধানী কুচিং এ এসে পৌঁছান। ওই সময় সারওয়াক শাসন করতো ব্রুনেইয়ের সুলতানরা। কুচিং এ তখন সুলতানী শাসনের বিরুদ্ধে জোর বিদ্রোহ চলছে, এর সাথে জুটেছে আশেপাশের অঞ্চলের জলদস্যুদের উৎপাত। অতিষ্ঠ সুলতানকে সাহায্য করবার প্রস্তাব দিলেন জেমস। তিনি সেনাবাহিনীর মানুষ, আধুনিক সব সমর কৌশল প্রয়োগ করে দ্রুতই বিধ্বস্ত করে ফেললেন বিদ্রোহীদেরকে। কৃতজ্ঞ সুলতান জেমস ব্রুককে সারওয়াক প্রদেশের গভর্নর বানিয়ে দিলেন। ১৮৪১ সালে তাকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। পরের বছর সুলতান দ্বিতীয় ওমর সাইফুদ্দীন সারওয়াকের ওপর ব্রুকের সার্বভৌমত্ব মেনে নেন, প্রতিষ্ঠা ঘটে কিংডম অব সারওয়াকের।

এখানে বসেই বিচারকাজ চালাতেন রাজা ব্রুক; Source: shutterstock

রাজা ব্রুকের শাসনামল

জেমস ব্রুক ছিলেন বুদ্ধিমান কূটনীতিবিদ। সার্বভৌম ক্ষমতা পেয়েও মাথা ঠান্ডা রেখেছিলেন। সারওয়াকের কাছেই সিঙ্গাপুরে ব্রিটিশ ঘাঁটি ছিল। তিনি সর্বদা ব্রিটেনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ১৮৫৭ এর দিকে এক দফা লন্ডনে ঘুরেও আসেন। তবে সারওয়াকের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে তিনি নাকি ছিলেন বেজায় খড়গহস্ত। কোনোরকম বিদ্রোহ বা অসন্তোষের খবর পেলেই তা কঠোর হস্তে দমন করতেন। তার শাসনামলে এই অভিযোগ প্রায়ই উঠতো যে তিনি জলদস্যু দমনের নামে আসলে স্রেফ বিদ্রোহী প্রজাদের পিষে মারছেন।

তবে একটি কথা স্বীকার করতেই হবে, আইন কানুনের প্রয়োগটা রাজামশাই খুব যথাযথভাবেই করেছিলেন। সে আমলে সারওয়াকের দুর্ধর্ষ দায়াক যোদ্ধাদের ছিল এক বিদঘুটে স্বভাব, যুদ্ধে প্রতিপক্ষের মাথা কেটে নিয়ে এসে জমানো। বিয়ে করার সময় অন্তত একটা মাথা না নিয়ে যেতে পারলে নাকি তাদের বিয়েই হত না! জেমস এই প্রথা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। জেমস ব্রুক সারওয়াক রেঞ্জার্স নামের এক পুলিশ বাহিনীও গঠন করেছিলেন। বর্তমান সারওয়াক প্রদেশের গভর্নরের বাসভবন জেমসের আমলে বানানো হয়। এরই প্রাঙ্গণে তিনি বিচার সভা বসাতেন। সেখানে নাকি মানুষের পাশাপাশি পশুদেরও টুকটাক বিচার হত। রাজা জেমস একবার এক কুমীরকে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত দিয়েছিলেন, কারণ সে মানুষ খেয়ে ফেলে রাজ্যে বিষম উৎপাত সৃষ্টি করেছিলো।

দুর্ধর্ষ দায়াক যোদ্ধা; Source: pinterest.com

চার্লস ব্রুক

জেমস ব্রুকের কোনো সন্তান ছিল না। মৃত্যুর পর তার ভাগ্নে চার্লস ব্রুক ১৮৬৮ সালে রাজা হন। তার শাসনামলে সারওয়াকের রাজধানী কুচিং একটি আধুনিক শহরে পরিণত হয়। উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ইটের তৈরি সুরম্য অট্টালিকা, জাদুঘর, রাস্তা, ট্রেন, রেস কোর্স, এমনকি বিলিয়ার্ড খেলার ব্যবস্থা পর্যন্ত গড়ে ওঠে। যখন জেমস ব্রুক ক্ষমতায় আসেন, তখন সারওয়াক রাজ্যের পরিধি ছিল মাত্র ৫ হাজার বর্গ মাইল। বাকিটা ছিল দুর্গম পাহাড় আর জঙ্গল। চার্লস ব্রুক এই সীমা বাড়িয়ে সারওয়াককে প্রায় ইংল্যান্ডের সমান একটি রাজ্যে পরিণত করেন। চার্লসের শাসনামলেই সারওয়াক ব্রিটিশ প্রটেক্টোরেট হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯১৭ সালে চার্লস ব্রুকের মৃত্যু হয়।

সারওয়াক প্রদেশের গহীন বন; Source: pinterest.com

চার্লস ভাইনার ব্রুক

চার্লস ব্রুকের ছেলে চার্লস ভাইনার ব্রুক শাসক হিসেবে বাবার মতোই সুযোগ্য গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। সে সময়ে সারওয়াকে রাবার চাষের ধুম পড়েছে, খুঁজে পাওয়া গিয়েছে তেল। ফলে জঙ্গল-পাহাড়ে আবৃত এই দুর্গম অঞ্চলটি রীতিমত ধনী হয়ে ওঠে। চার্লস সেখানে সরকারি নানা সেবা চালু করেন। তার অন্যতম প্রশংসনীয় কাজ হচ্ছে তিনি দেশে মিশনারীদের যথেচ্ছ অত্যাচার বন্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেন। সে আমলে ব্রিটিশ মিশনারীরা দেশে দেশে গিয়ে সেখানকার আদিবাসীদেরকে কখনো লোভে ফেলে, কখনো চাপ প্রয়োগ করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করতো। রাজা বেশ কঠোর আইন করেন যাতে আদিবাসীরা নিজেদের প্রথা আর ধর্ম বজায় রাখতে পারে। তবে মাথা সংগ্রহের বিরুদ্ধে পূর্বসুরীদের মত তিনিও কঠোর ছিলেন। ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ রাজ তাকে নাইট উপাধি দান করে।

শেষ সাদা রাজা, চার্লস ভাইনার ব্রুক; Source: BritishEmpire.com

প্রথম দুই রাজার মতো চার্লস ভাইনার ব্রুকস শান্তিতে রাজত্ব শেষ করতে পারেননি। সালটা তখন ১৯৪১, জাপানীরা অবতরণ করলো সারওয়াকে। চার্লস অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে যান। যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।

যুদ্ধের পর তিনি কিছুদিন রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ততদিনে গোটা এশিয়াতে স্বাধীনতার জোয়ার এসেছে। নানাবিধ বিড়ম্বনা আর ব্রিটিশ চাপে পড়ে তিনি ১৯৪৬ সালে সারওয়াকের শাসনভার ছেড়ে দেন ব্রিটেনের হাতে। অবসান হয় স্বাধীন রাজত্বের। ১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ডে চার্লসের মৃত্যু হয়। সারওয়াক ব্রিটিশ ক্রাউন কলোনী হিসেবে নতুন পরিচয় লাভ করে।

পরিশিষ্ট

সারওয়াকের অধিবাসীরা এত সহজে ব্রিটিশ শাসন মেনে নেয়নি। চার্লস ভাইনারের ভাতিজা অ্যান্থনি চার্লস সিংহাসনের জন্য জোর দাবি তোলেন। বিপুল জনসমর্থনও পেয়েছিলেন। ওদিকে পাশের দেশ ইন্দোনেশিয়া তখন স্বাধীনতা লাভ করেছে। একদল লোক ঠিক করে তারা ইন্দোনেশিয়ার সাথে যোগ দেবে। এদেরই একজন, রোজলি ধোবি, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক স্যার ডানকান স্টুয়ার্টকে খুন করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়। শেষমেষ ১৯৫১ সালে অ্যান্থনি চার্লস সমস্ত দাবিদাওয়া ত্যাগ করে নিউজিল্যান্ডে চলে যান। সেখানেই ২০১১ সালে তার মৃত্যু হয়। আর সারওয়াক ১৯৬৩ সালে মালয়েশিয়া ফেডারেশনের সাথে যোগ দেয়।

সিংহাসনের জোরালো দাবি জানিয়েছিলেন অ্যান্থনি ব্রুক; Source: brooketrust.org

রাজ্য থেকে বহু দূরে, ইংল্যান্ডের ডার্টমুরের এক নিভৃত গ্রামে সারওয়াকের সাদা রাজারা শায়িত আছেন। অ্যান্থনী ব্রুকসের অস্থিভস্ম সারওয়াকে কবরস্থ করা হয়েছে।

ফিচার ইমেজ: commons.wikimedia.org

Related Articles