Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হতাশার অভিশাপে ঘেরা হোপ ডায়মন্ড

বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ইভ্যালিন ওয়ালশ ম্যাকলিন। দারুণ কাটছিল তার দিন। হঠাৎ তার মাথায় ঝোঁক চেপে বসলো নীল রঙের বড়সড় ঐ হীরের টুকরোটিকে নিজের করে নেয়ার। নিজের হাতেই যেন দুর্ভাগ্যকে আমন্ত্রণ জানালেন ইভ্যালিন। শুরুর দিকে বেশ স্বাভাবিকভাবেই চলছিল সবকিছু। মাঝে মাঝে গলায় ডায়মন্ডটি ঝোলাতেন তিনি, কখনো বা সেটি শোভা পেত পোষা কুকুরটির গলায়। এরপরেই যেন হরর সিনেমার মতো তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া। ডায়মন্ডটি গলায় ঝোলানোর মাত্রাতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করতে হলো ইভ্যালিন ও তার পরিবারকে। প্রথমেই মারা গেলেন তার শ্বাশুড়ি, তারপর তার নয় বছর বয়সী ছেলেকেও হারালেন তিনি। অন্য এক নারীর জন্য তাকে ত্যাগ করলেন তার স্বামী, পরবর্তীতে তিনি মানসিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ২৫ বছর বয়সে অতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে প্রাণ হারায় তার মেয়ে। ঘটনাক্রমে পরিস্থিতির শিকার হয়ে ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর মতো পত্রিকাও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন ইভ্যালিন। দেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে যান তিনি। ঋণে জর্জরিত হয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ইভ্যালিন।

হোপ ডায়মন্ড; Source: bellevuerarecoins.com

গ্রীসের এক বণিক সাইমন মাওনকারেডসও একসময় ডায়মন্ডটি কিনেছিলেন। তার অভিশাপ? পাহাড়ি উপত্তকার গিরি খাঁদ ঘেঁষে গাড়ি চালাচ্ছিলেন তিনি। ফলাফল, স্ত্রী-সন্তান সহ ওখানেই মৃত্যুবরণ করেন সাইমন।
জেমস টোড, একজন মেইলম্যান যিনি স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরে হীরার টুকরোটি পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক ট্রাক দুর্ঘটনায় পা হারান তিনি। তার কিছুদিন পর আরেক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পান টোড। আগুন লেগে পুরো ঘরবাড়ি পুড়ে যায় বেচারার।

এতসব দুর্ঘটনা যাকে কেন্দ্র করে, সেই হীরের টুকরোটির নাম ‘হোপ ডায়মন্ড’। যুগ যুগ ধরে হীরা মানুষকে আকর্ষণ করেছে দুর্নিবারভাবে। কাজেই এই হীরাকে ঘিরে কুসংস্কার এবং লোকগাঁথা থাকবে এমনটাই স্বাভাবিক। সারা বিশ্বে নামকরা এমনই এক দর্শনীয় হীরা ‘হোপ ডায়মন্ড’। প্রায় চারশো বছরের ইতিহাসে বিরল নীলরঙা ঝকমকে এই হীরাটিতে বোরন পরমাণুর উপস্থিতি শনাক্ত করা গেছে। হীরাটির ওজন প্রায় ৪৫.৫২ ক্যারাট। ব্যতিক্রমী আকৃতির জন্য রত্নের জগতে এটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আখরোটের সমান এই হীরার টুকরোটি কিনতে চাইলে কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হতে পারে। কিন্তু তার আগে ভেবে দেখতে হবে হীরার সঙ্গে দুর্ভাগ্যকে ডেকে আনছেন না তো?

হোপ ডায়মন্ডের রেপ্লিকা; Source: insider.si.edu

কার্ল শাকার তার ‘দ্য আনএক্সপ্লেইনড’ বইটিতে এই বিপদজনক রত্নটির কথা উল্লেখ করে বলেন,

“এটি ভারতের এক মন্দিরের দেবীর কপালে ঝকমক করতো, যতদিন পর্যন্ত না এক চোর হিন্দু পুরোহিত তা অধর্মের সাথে তুলে নিয়ে যায়। শাস্তিস্বরূপ তাকে অত্যন্ত মর্মান্তিক মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয়। পরবর্তীতে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের কিস্তনা নদী তীরবর্তী গোলকন্দা খনির পাশে হীরাটি খুঁজে পাওয়া যায়। ১৬৪২ সালে হীরাটি এক ফ্রেঞ্চ বণিকের হাত ধরে ইউরোপে পৌঁছায়। বণিক সাহেব ‘হোপ ডায়মন্ড’ বিক্রি করে দেন ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের কাছে। খুব ভালো একটি পুরস্কারের আশা করেছিলেন তিনি. কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বেচারা একদল বন্য কুকুরের আক্রমণে নৃশংসভাবে মারা যান।”

মূলত ফরাসী রত্ন ব্যবসায়ী জিন-ব্যাপ্টিস্ট ট্যাভার্নিয়ার ভারতে এসে দেবীর চোখ থেকে রত্ন খুলে নিয়ে যাওয়ার কাজটি করেন। কোথাও কোথাও বলা হয় হোপ ডায়মন্ডের প্রকৃত আকার ছিল ১১৫.১৬ ক্যারাট। ১৬৭৩ সালে রাজা চতুর্দশ লুই হীরাটিকে কাটিয়ে বর্তমান আকৃতিতে নিয়ে আসেন। তখনকার দিনে ‘হোপ ডায়মন্ড’ পরিচিত ছিল ‘The Blue Diamond Of The Crown’ অথবা ‘French Blue’ নামে। চতুর্দশ লুইয়ের রাজস্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রক ছিলেন নিকোলাস ফুকুয়েট, হীরাটি দেখশোনার দায়িত্ব তার উপরেই ন্যস্ত ছিল। মাঝে মাঝে কিছু অনুষ্ঠানে নিজের ব্যক্তিগত কাজেও এটিকে ব্যবহার করতেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই রাজা চতুর্দশ লুইয়ের সাথে কিছু কারণে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় ফুকুয়েটের। রাজা তাকে ফ্রান্স থেকে নির্বাসনে পাঠান। পরবর্তীতে এই শাস্তি পরিবর্তন করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। পিগ্নেরল দুর্গে ফুকুয়েটকে ১৫ বছর বন্দী করে রাখা হয়। অপরদিকে রাজা চতুর্দশ লুই ৭২ বছর বয়সে গ্যাংগ্রিন রোগে ভুগে বেশ কষ্ট পেয়ে মারা যান।

Source: wikimedia.org

১৭৯২ সালে ফরাসি বিপ্লব শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত হীরাটি ফ্রান্সের রাজ পরিবারের জিম্মায় ছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে তখন ‘হোপ ডায়মন্ডের’ মালিক ছিলেন রাজা ষোড়শ লুই। বিপ্লবের সময় রাজা ষোড়শ লুই এবং রাণী ম্যারি অ্যান্টোইনেটকে শিরোচ্ছেদ করে মেরে ফেলা হয়। ধারণা করা হয় তারা দুজনও এই রহস্যময় হীরকখণ্ডের অভিশাপের শিকার হয়েই প্রাণ হারান। তাদের মৃত্যুর সময় রাজ পরিবার থেকে চুরি হয় হোপ ডায়মন্ড। এরপর বেশ কয়েক দশক ধরে তার আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। হাত থেকে হাতে ঘুরতে থাকে মূল্যবান এই রত্নটি। উড়ো কিছু খবরে জানা যায়, ব্রিটেনের রাজা চতুর্থ জর্জের হাতে পড়ে হোপ ডায়মন্ড। ঘটনাক্রমে দেনার দায়ে জর্জরিত রাজা জর্জ তার পুরো সাম্রাজ্য বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।

১৮৩৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ড হেনরি থমাস হোপের মালিকানায় ছিল বিখ্যাত এই হীরকখণ্ড। তার নামেই হীরাটির নাম হয়ে যায় ‘হোপ ডায়মন্ড’। হোপের মৃত্যু নিয়ে অমীমাংসিত রহস্য রয়েছে। কেউ বলেন এক নারীর প্রেমে পাগল হয়ে পথে মৃত্যু হয় তার। আবার কারো কারো মতে তিনি এবং তার স্ত্রী দুজনই বেহিসাবে টাকা উড়াতেন। ফলে দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে করুণ মৃত্যু হয় এই দম্পতির। হোপের মৃত্যুর পর আবারও হাতে হাতে ঘুরে ফেরে আশা কিংবা হতাশার প্রতীক এই হীরাটি।

৪৫ ক্যারাটের হীরকখণ্ডটি; Source: ytimg.com

একদম শুরুতে যে দুর্ঘটনাগুলোর কথা বলছিলাম তা এরপরের ইতিহাস। ‘হোপ ডায়মন্ড’কে ঘিরে ‘হোপ কার্স’ নামে নতুন একটি কলাম খুলে ফেলে ১৮০০ শতকের সাংবাদিকরা। হীরাটির প্রতিটি মালিকের রহস্যজনক বা দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর কাহিনী ছাপানো হতো সেখানে। ধীরে ধীরে বাস্তবের সাথে গাল ভরা গল্পের মিশেলে ‘হোপ ডায়মন্ড’ পরিণত হলো রূপকথায়। ফারাওয়ের অভিশাপ বা তুতেনখামুনের অভিশাপ যেমন ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে, ঠিক তেমনি যেন হোপ ডায়মন্ডের অভিশাপও তখন সারা বিশ্বের আকাশে বাতাসে প্রতিফলিত হচ্ছিল। ‘হোপ ডায়মন্ডের অভিশাপে করুণ মৃত্যুর শিকার ১০ জন ব্যক্তি’ এমন সব সংবাদও বের হতে থাকে সংবাদপত্রে।

স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরে রাখা ডায়মন্ডটি; Source: newsdesk.si.edu

সব ঘটনা-দুর্ঘটনা পেরিয়ে ১৯৫৮ সালে হীরাটি স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামে এসে পৌঁছায়, তারপর থেকে একে কেন্দ্র করে আর কোনো দুর্ঘটনার কথা শোনা যায়নি। ২০০৭ সাল থেকে হোপ ডায়মন্ডের অজস্র রেপ্লিকা বের হতে থাকে। সারা পৃথিবীর মানুষকে দেখানোর জন্য বেশ কয়েকবার আন্তর্জাতিকভাবে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয় হোপ ডায়মন্ডের। ২০১১ সালে ‘ফ্রেঞ্চ ব্লু’ নামের একটি ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয় ডায়মন্ডটিকে।

খবরের কাগজে ফ্রেঞ্চ ব্লু; Source: pinimg.com

কারো কারো মতে হোপ ডায়মন্ডকে ঘিরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিছকই গল্প, এর সাথে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। ঈশপের প্রতিটি গল্পের শেষে যেমন একটি করে নীতিকথা থাকে, হোপ ডায়মন্ডের গল্পগুলোর শেষেও ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ এই জাতীয় একটি ‘মোরাল অফ দ্য স্টোরি’ জুড়ে দেয়া হয়েছে। এত বছর ধরে শান্ত থাকা হীরকখণ্ডটিও যেন নীরবে এসব বিভ্রান্তিকর তথ্যকে উসকে দেয়। সব কিছুর জানার পর আপনার যদি হীরকখণ্ডটি নিজের চোখে একবার দেখার ইচ্ছে হয়, তবে সোজা চলে যেতে পারেন স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউটের জাদুঘরটিতে। সামুরাই মুরামাসার অভিশপ্ত তরবারির মতো এই হীরকখণ্ডটি অন্তত চোখের দেখায় কারো প্রাণ কেড়ে নেয় না!

ফিচার ইমেজ: newsdesk.si.edu

Related Articles