Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হোরাশিও গর্ডন রবলে: মৃত মানুষের মাথা সংগ্রহ করাই ছিল যার নেশা

হোরাশিও গর্ডন রবলে ছিলেন একজন ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা। সেনা অফিসার হিসেবে তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। ১৮৬০ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে নিউজিল্যান্ডের ব্রিটিশ সেনাবিভাগে যোগদান করেন। 

সৈনিক হয়েও বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ সম্পর্কে জানার তার প্রবল আগ্রহ ছিল। এছাড়া নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিও ছিল তার প্রচন্ড ভালবাসা। মায়ের মতো তিনিও ছিলেন একজন চিত্রশিল্পী। মায়ের কাছ থেকে তা উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জন করেছিলেন রবলে।

হোরাশিও গর্ডন রবলে; Image Source: harryteach.wordpress.com

কর্মসূত্রে তাকে বেশ কয়েক বছর নিউজিল্যান্ডে থাকতে হয়েছিল। এই সময় দেশটির বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো তার এক নেশা হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে ঘুরে বেড়ানোর সময় তার প্রথম নজরে পড়ে মাওরি উপজাতির অধিবাসীদের বৈচিত্র্যময় মুখ। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের বেশ কিছু জায়গায় মাওরি উপজাতিরা বহু বছর ধরে বাস করে আসছে। সমাজ ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসে মাওরি উপজাতিদের মধ্যে বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়। নিজেদের শরীরে উল্কি করা তাদের সমাজ জীবনের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। পুরো শরীর ও মুখে নানা ধরনের উল্কি এঁকে মাওরিরা নিজেদেরকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে থাকে।

মাওরিদের শরীর ও মুখের এই উল্কিকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘টা মোকো’। মাওরি উপজাতিদের এসব উল্কি বা ট্যাটু জেনারেল গর্ডনকে আকৃষ্ট করে। তিনি মাওরিদের এই শিল্পকর্মে এতটাই মুগ্ধ হন যে নিজের নোট বইয়ে তিনি মাওরিদের মুখের উল্কিগুলো এঁকে রাখতে শুরু করেন এবং এই বিষয়ে বিভিন্ন রকম প্রবন্ধ লিখতে থাকেন।  

মাওরি উপজাতি; Image Source: hetravel.com

নিউজিল্যান্ডে থাকাকালীন সময়েই এই উল্কি নিয়ে গর্ডন ‘Moko or Maori Tattooing’ এবং ‘Pounamu: Notes on New Zealand Greenstone’ নামে দুটি বই লেখেন। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তার প্রথম বইয়ে মাওরি উপজাতিদের ট্যাটু নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন এবং এই বইতে মাওরিদের সংরক্ষিত উল্কিযুক্ত মুখমন্ডল সম্পর্কে আলাদা এক অধ্যায় লেখেন।

মাওরি উপজাতিদের মুখের ট্যাটু গর্ডনকে খুব আকৃষ্ট করে; Image Source: harryteach.wordpress.com

গর্ডনের দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে উঠে আসে মাওরিদের মুখের ট্যাটুর বিশেষত্ব। মাওরি সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং গণ্যমান্য পুরুষ ও নারীদের ট্যাটু অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ফলে সমাজে নিজেদের অবস্থান বোঝানোর জন্য সেসব মাওরিদের ট্যাটু এমনভাবে আঁকা হতো যাতে তাদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। এমনকি সমাজের উচ্চ আসনে থাকা নারীরা তাদের ঠোঁট এবং চিবুকেও উল্কি করতেন, তবে তা ছিল বিরল।

গর্ডন তার বইতে মোমোকাইয়ের বর্ণনার সাথে যুক্ত করেন নিজের আঁকা ছবি; Image Source: harryteach.wordpress.com

সমাজের প্রভাবশালী কোনো মাওরির মৃত্যু হলো সেই মৃত ব্যক্তির সম্মানার্থে তার মাথাটি সংরক্ষণ করার প্রচলন ছিল। এই সংরক্ষণের জন্য মৃত ব্যক্তির মাথা শরীর থেকে আলাদা করা হতো। তারপর মাথার ভেতরের পচনশীল অংশ, যেমন- চোখ, মস্তিষ্ক ইত্যদি বের করে নিয়ে তার মধ্যে বিশেষ এক ধরনের গাছের শুকনো ছাল আর এক ধরনের আঠা দিয়ে তা পূর্ণ করা হতো। তারপর বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাথাটি রোদে শুকানোর ব্যবস্থা করা হতো। মুখের চামড়া যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য হাঙরের তৈরি একপ্রকার তেলের মিশ্রণ মুখের উপরের চামড়ায় মাখানো হতো। ফলে মুখের চামড়া প্রায় অবিকৃত থেকে যেত।

উল্কিযুক্ত এই মাথা সংরক্ষণকে বলা হতো ‘মোকোমোকাই’। মাওরি উপজাতিরা মাথা সংরক্ষণের এই প্রক্রিয়া কীভাবে শিখেছিল তা জানা না গেলেও এই প্রক্রিয়া যে বেশ কার্যকর ছিল তা বলাই বাহুল্য। এভাবে সংরক্ষণের কারণে বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সেসব মৃত মানুষের মাথা এখনও অবিকৃত থেকে গেছে। 

মাওরি উপজাতিদের মুখের ওপর তৈরি করা ট্যাটু মোকোমোকাই; Image Source: cvltnation.com

সংরক্ষণ করা মাথাটি মাওরিরা একটি নকশা করা কাঠের বাক্সের মধ্যে রেখে মৃত ব্যক্তির পরিবারের নিকট হস্তান্তর করতো। পরবর্তীতে মাওরিদের কোনো এক পবিত্র অনুষ্ঠানে সংরক্ষিত মাথাটি প্রকাশ্যে আনা হতো। শুধুমাত্র সমাজের গণ্যমান্য মৃত ব্যক্তিদের মাথাই সংরক্ষণ করা হতো তা কিন্তু নয়, অনেক ক্ষেত্রে মাওরিদের মধ্যে এবং ভিন্ন কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে জয়লাভ করার পর বিজয়ী ব্যক্তি জয়ের পদক হিসেবে পরাজিতের মাথা কেটে এভাবে সংরক্ষণ করতো। এর মধ্যে দিয়ে সমাজে বিজয়ী ব্যক্তির প্রতিপত্তি ও সম্মান প্রকাশ পেতো। আবার দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধরনের মাথা আদান-প্রদানেরও ব্যবস্থা ছিল।

গর্ডন তার বইতে এসব মোমোকাইয়ের বর্ণনার সাথে সাথে নিজের আঁকা ছবিগুলো যুক্ত করে দেন। কিন্তু তার এই আঁকা ছবি দিয়ে তিনি সবাইকে বিষয়টি ভালোভাবে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছিলেন না। তার দেওয়া বর্ণনা থেকেও বিষয়টি খুব একটা স্পষ্ট হচ্ছিল না। সেজন্য গর্ডন বিকল্প নানা উপায় নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। হঠাৎই এক অদ্ভুত পরিকল্পনা তার মাথায় আসে। তিনি ঠিক করলেন, মাওরিদের সংরক্ষিত উল্কি করা মাথা তার সংগ্রহে রাখবেন। গর্ডন তার এই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে উদ্যত হলেন।

গর্ডনের সংগৃহিত মোকোমোকাই; Image Source: rarehistoricalphotos.com

১৬৯১ সালে পরিব্রাজক উইলিয়াম ডাম্পিয়ারের সৌজন্য ইউরোপীয়দের মধ্যে ট্যাটু নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। ফলে বলা যায়, অনেক আগে থেকেই ইউরোপীয়রা এই ট্যাটুর বিষয়ে কম-বেশি অবগত ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন ইউরোপীয়দের নিউজিল্যান্ডে আগমন ঘটে, তখন মোকোমোকাই বাণিজ্যের এক মূল্যবান আইটেম হিসেব পরিচিতি পায় ইউরোপীয়দের কাছে। গর্ডন রবলের মতো অনেক ইউরোপীয়র কাছে এই নকশা করা মাথাগুলো এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, কোনো কোনো ব্যক্তি নিতান্তই সংগ্রহের উদ্দেশ্যে, আবার কেউ শুধুমাত্র বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এই মাথা সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করে। এজন্য তারা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতে শুরু করে। শুধু তা-ই নয়, তাদের এই কাজটি নির্বিঘ্নে করার জন্য ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা তাদের সেনাবাহিনীরও সাহায্য নিতে থাকে।

মোকোমোকাই সংগ্রহের জন্য ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীদের ব্যবহার করতে থাকে; Image Source: listverse.com

মাওরিদের এই উল্কিযুক্ত মাথা সংগ্রহের জন্য সেনাবাহিনী দিয়ে আশেপাশের মাওরি উপজাতিদের গ্রামগুলোতে তল্লাশি চালানো হতো। এমনকি রপ্তানির চাহিদা পূরণের জন্য ক্রীতদাস এবং সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হওয়া মাওরিদের দিয়ে সাধারণ মৃত মানুষের মাথায় এ ধরনের নকশা করার জন্য চাপ দেয়া হতো। এভাবে গর্ডন রবলে ৩৫টির মতো মোকোমোকাই খুব স্বল্পমূল্যে সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।

সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর গর্ডন ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি যে বাড়িতে থাকতেন সেখানে মোকোমোকাই সংরক্ষণের তেমন কোনো উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। অনেক মোকোমোকাই সংরক্ষণের অভাবে এবং অযত্নে নষ্ট হতে শুরু করে। তখন গর্ডন তার সংগৃহিত মোকোমোকাইগুলো বিক্রির চেষ্টা করতে থাকেন। প্রথমে তিনি নিউজিল্যান্ড সরকারের কাছে মোকোমোকাইগুলো বিক্রির প্রস্তাব দেন। কিন্তু নিউজিল্যান্ড সরকার গর্ডনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।

 নিউ ইয়র্কের ‘আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’ জাদুঘরে সংরক্ষতি গর্ডন রবলের মোকোমোকাই; Image Source: cvltnation.com

পরবর্তীকালে ১৮৯০ সালের শুরুর দিকে নিউ ইয়র্কের ‘আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’ জাদুঘর ১,২৫০ ডলারের বিনিময়ে গর্ডন রবলের সংগ্রহে থাকা মোকোমোকাইগুলো কিনে নেয়। বর্তমানে এই জাদুঘরেই গর্ডন রবলের মোকোমোকাইগুলো দর্শকদের মাঝে প্রদর্শিত হচ্ছে।

ফিচার ইমেজ- cvltnation.com

Related Articles