Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট: ব্রিটিশ ভারতে তৃতীয় লিঙ্গ নিধন আইন

বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য ইত্যাদির আলোচনায় স্বাভাবিক মেরুকরণের দ্বারা আমরা শ্বেতাঙ্গ বনাম কৃষ্ণাঙ্গ, পুরুষ বনাম নারী পরিস্থিতির কথাই ভাবি। কিন্তু বাইনারি এই দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়- দুই মেরুর মাঝখানের ধূসর বাসিন্দারা। তথাকথিত মূলধারার বা স্বীকৃত মেরুর বাইরে তেমনই একটি লৈঙ্গিক ধারা রয়েছে, যাদের আমরা বলি তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া বা বৃহন্নলা কিংবা শিখণ্ডী।

পৃথিবী জুড়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় আমাদের পেশার হরেকরকম পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বর্তমান যেন অতীতেই পড়ে আছে, আজকের দিনে এসেও তাদের জীবিকা নির্বাহ হয় নাচ-গান ও ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে।

তাদের অনেক কর্মকাণ্ডকে আমরা খারাপ চোখে দেখি। কিন্তু তাদের জীবনধারণের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন এবং সেই অর্থের জন্য যে কর্মসংস্থান প্রয়োজন, যেটি থেকে তারা বঞ্চিত- তা কিন্তু আমরা প্রায়শই তলিয়ে দেখতে চাই না।

উপমহাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো আজও অবহেলিত; Image Source: Dhaka Tribune

মুঘল আমলে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ঠাঁই হতো রাজদরবারে। এদের কেউ ছিলেন জন্মগতই বৃহন্নলা, আবার অনেককে কৃত্রিমভাবে ‘খোজা’ করা হতো। এই লোকগুলোকে বিবেচনা করা হতো মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসেবে।

তারা মূলত মুঘল বাদশাহদের হেরেমের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করতেন। হেরেমে বসবাস করা রাজপরিবারের নারী সদস্য এবং অন্যান্য দাসীরা যাতে কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার না হন, সেজন্য নিয়োগ করা হতো তৃতীয় লিঙ্গের এই লোকদের। এমন প্রচলন তুরস্কের অটোমান সুলতানদের প্রাসাদেও ছিল।

মুঘল আমলে হেরেমে কাজ করে তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেই প্রভূত ক্ষমতা, সম্মান ও সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। প্রাসাদ-রাজনীতিতেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। কিন্তু তাদের এই ‘মধুচন্দ্রিমা’ একসময় শেষ হয়ে যায়। ব্রিটিশরা ক্ষমতা দখলের পর তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যান।

ঘটনার সূত্রপাত উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে। ১৮৫২ সালের আগস্টে উত্তর ভারতের মেইনপুরি জেলায় বোরাহ নামের তৃতীয় লিঙ্গের এক ব্যক্তি খুন হন। তিনি তার দুজন শিষ্য ও এক প্রেমিককে নিয়ে বাস করতেন। কোনো বাড়িতে বিয়ে হলে, অথবা কারো সন্তান হলে সেখান থেকে উপহার নিয়ে বোরাহর দিনাতিপাত হতো। মেলাসহ আরো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেচে-গেয়েও আয়-রোজগার হতো তার।

খুন হওয়ার আগে তিনি তার প্রেমিককে ছেড়ে আরেক পুরুষের সাথে সম্পর্ক গড়েছিলেন। সে ঘটনা আদালত অবধি গড়ায়। ব্রিটিশ বিচারকেরা বিচারকাজ শেষে ঘোষণা দেন, ক্রোধের বশবর্তী হয়েই বোরাহকে খুন করেছেন তার সাবেক প্রেমিক। একইসাথে তারা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ক্রস-ড্রেসার, ভিক্ষুক ও জঘন্য পতিতা হিসেবে অভিহিত করেন। তাদেরই একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য কলঙ্ক’ হিসেবে উল্লেখ করেন! 

বিষয়টি ছিল পুরোপুরি অনভিপ্রেত। একজন মানুষ খুন হয়েছেন। কিন্তু সেই বিচার চাইতে গিয়ে তার শ্রেণীভুক্ত সকলকে অপরাধী হিসেবে গণ্য হতে হয়েছিল। আর এর পেছনে ছিল ব্রিটিশদের ‘নৈতিক উদ্বেগ’।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জীবন সংগ্রাম এখনো চলমান © Abdul Majeed Goraya

শুধুমাত্র ব্রিটিশ বিচারকরা নন, ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আরো অনেক কর্মকর্তা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ‘অবাধ্য’ হিসেবে অভিহিত করেন। অনেক আবার তাদের ‘অশ্লীলতা, সমকামিতা, অপবিত্রতা ও রোগ’ ছড়ানোর জন্য দায়ী করেন। ব্রিটিশরা তাদের জনসাধারণের নৈতিক অবক্ষয় ছাড়াও সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য হুমকি মনে করেছিল।

সেই থেকেই ব্রিটিশরা ভাবতে শুরু করলো, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা। তবে সেই নিয়ন্ত্রণ হলো বর্তমান সময়ের জন্ম নিয়ন্ত্রণের মতো। তাদের সংখ্যা যাতে বৃদ্ধি না পায়, তার জন্য ১৮৭১ সালে উপমহাদেশে ‘ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট (সিটিএ)’ অনুমোদন করে ব্রিটিশ সরকার।

এই আইনে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ‘অপরাধী’ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং তাদের বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধিত হওয়ার নিয়ম চালু করা হয়। এই নিবন্ধনের উদ্দেশ্য ছিল তৃতীয় লিঙ্গের প্রকৃত সংখ্যা বের করা এবং তাদের সংখ্যা যেন এর বেশি না হয়, তা নিশ্চিত করা।

উপমহাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ‘হিজড়া’ বলা হয়; Image Source: AFP

নিবন্ধনের চেয়েও কঠোর ধারা যুক্ত ছিল সিটিএ আইনে। এই আইনে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের মেয়েলি পোশাক ও অলংকার পরিধান এবং মেলা ও জনবহুল জায়গায় নাচ-গান নিষিদ্ধ করা হয়। এই আইন ভঙ্গকারীদের জরিমানা থেকে শুরু করে জেলে প্রেরণের শাস্তি চালু করা হয়।

কখনো কখনো মেয়েদের পোশাক অথবা অলংকার পরার দায়ে পুলিশ সদস্যরা তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনদের চুল কেটে দিতেন। আবার কখনো পোশাক খুলে পুরো নগ্ন করে রাস্তায় ঘোরাতেন।

হিজড়াদের আয়ের মূল উৎস ছিল মেলা ও জনবহুল স্থানে নাচগান। আয়ের মূল উৎস বন্ধ হওয়ার কারণে, তারা নাচ-গানের অনুমতি চেয়ে আদালতে রিট করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাদের এই আবেদনে সাড়া দেয়নি। কেননা ব্রিটিশ শাসকদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল, আয়ের পথ বন্ধ করে অভাব-অনটনে নিষ্পেষিত করে তৃতীয় লিঙ্গ নিশ্চিহ্ন করা।

বিতর্কিত এই আইনের ফলে তৃতীয় লিঙ্গের অনেককে অনাহারে মৃত্যুবরণও করতে হয়। তখন ভারতের গাজীপুর জেলার তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা অনাহারী থাকার বিষয়টি সরকারকে জানান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাতেও কোনো সমাধান পাননি।

উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে তৃতীয় লিঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে; Image Source: AFP

ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে তৃতীয় লিঙ্গ নিশ্চিহ্ন করার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল। তারা তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের সাথে থাকা বাচ্চাদের সরিয়ে নেওয়া শুরু করে। যারা বাচ্চা-ছেলে নিয়ে থাকতেন, তাদের জেলে প্রেরণ করা হয়।

ওদিকে যেসব বাচ্চা তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের সাথে থাকতেন, তারা অনেকেই তাদের হয়ে কাজ করে অর্থ আয় করতেন। এদের অনেকে ছিল একেবারেই অনাথ। এছাড়া যারা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের সাথে গানবাজনা করতেন, তাদের সন্তানরাও থাকতো। কিন্তু সরকার সেসব বিষয়কে পাশ কাটিয়ে গণহারে বাচ্চাদের ছিনিয়ে নিতে শুরু করে।

ব্রিটিশরা এই বাচ্চাদের ‘অপবিত্র ও রোগ ছড়ানোর দোসর’ হিসেবে অভিহিত করে। অথচ ১৮৬০-১৮৮০ সালের মধ্যে সরকারি নিবন্ধনে মাত্র ৯০-১০০ জন বাচ্চা ছেলের নাম পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এদের অধিকাংশ তাদের ‘বায়োলজিক্যাল’ পিতামাতার সাথে থাকতেন।

ব্রিটিশ সরকার শুধুমাত্র তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের উপর সিটিএ আইন প্রয়োগ করেনি। যে সকল পুরুষ নারীদের পোশাক পরিধান করতেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন, তাদেরও হয়রানি করা হতো।

অনেক ব্রিটিশ এবং ইংরেজি ভাষাভাষী অভিজাত শ্রেণীর ভারতীয়রা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের হিন্দু সমাজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করতেন। তবে ব্রিটিশ সরকার তৃতীয় লিঙ্গ নিশ্চিহ্ন করার জন্য কোনো ধর্মকে বিবেচনা করেনি। বরং যে সকল ব্যক্তি তাদের লিঙ্গ নির্ধারণ করতে পারেননি, তাদের ওপরই ১৮৭১ সালের  ‘সিটিএ’ আইনের প্রয়োগ করা হতো। তাদের জনসম্মুখে চলাচলের ওপরেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল।

২০১৪ সালে ভারত ও বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গ আইনী স্বীকৃতি পেয়েছে; Image Source: AFP

ব্রিটিশ সরকারের এই অমানবিক আইনের কঠোর প্রয়োগ সত্ত্বেও তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা নিজেদের বিলুপ্তি ঠেকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তারা পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে জনসম্মুখে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা করতেন।

সংগ্রামের সাথে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চর্চা করতেন তারা। এমনই করে তারা নিজেদের মধ্যে সব কাজই করতে পারতেন, সেসব অবৈধ ছিল ব্রিটিশ আইনে। কিন্তু এর বাইরে প্রকাশ্যে প্রায় সবকিছুই ছিল অবৈধ। একসময় তারা আইন ভঙ্গ করতে দক্ষ হয়ে ওঠেন, এবং নিজেদের সম্পদ গোপন করতে শুরু করেন, যাতে পুলিশ তাদের নিবন্ধনের খাতায় সেগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে না পারে।

একসময় ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের ভুল বুঝতে পারেন। তারা অনুধাবন করেন, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে খুব বেশি শক্তিশালী নয়। তারা কখনোই সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারবেন না।

ওদিকে ব্রিটিশদের এই আইন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত সম্প্রদায়কে সাংস্কৃতিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে আরো কোণঠাসা করে দেয়। তবে ব্রিটিশদের দীর্ঘমেয়াদী যে স্বপ্ন ছিল, সেটা তারা পূরণ হতে দেননি। কঠোর জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা সমাজে টিকে ছিলেন।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের উপস্থিতি অস্বীকার করার সুযোগ নেই; Image Source: AFP

স্বাধীন ভারতে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা আবারো নাচগানের অধিকার ফিরে পান। তবে তাদের ভাগ্যের কোনো উন্নতি হয়নি। আদিকাল থেকেই তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। স্বাধীনতার প্রায় ৭০ বছর পর ২০১৪ সালে ভারত তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দেয়।

একই বছর বাংলাদেশেও তাদের আইনগত বৈধতা দেওয়া হয়। পাকিস্তানেও তৃতীয় লিঙ্গকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে পরিচয়-প্রদানের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা লাভ করার অধিকার পান।

তবে শুধুমাত্র এই আইনি বৈধতা তাদের জীবনের গতি-প্রকৃতি বদলাতে পারেনি। তাদের জীবন এখনো সেই নাচগান ও ভিক্ষাবৃত্তি-নির্ভর। প্রায় সকলেই তাদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। খোলা চোখে তাদের কর্মকাণ্ডকে অনেকে সন্ত্রাসীদের সাথে তুলনা করে থাকেন। কিন্তু তারা যখন বলেন,

তোরা না দিলে আমরা কোথায় পাবো ভাই?

আপনার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর আছে কি?

This article is in Bangla language. It is about 'Criminal Tribes Act 1871: How Britain Tried To Erase Third Gender Of Sub-continent.' Necessary references have been hyperlinked. 

Featured Image Source: Bridgeman Images        

Related Articles