মানবাধিকার নিয়ে বর্তমান বিশ্বে কাজ করছেন, এমন অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পূর্বেকার প্রেক্ষাপট ছিল অনেক ভিন্ন। পৃথিবীর সামগ্রিক পরিস্থিতি সাম্রাজ্যবাদ থেকে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হলেও স্বাধীন দেশগুলো তখনও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে তেমন ভাবেনি। এমনকি স্বাধীন দেশগুলোর সরকারপ্রধান কিংবা শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তৎপর ছিল না। বিশ্ব রাজনীতি, সামরিক শক্তিবৃদ্ধি এবং দেশ পুনর্গঠন নিয়েই ব্যস্ত ছিল তারা।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পূর্বে কারাবন্দীদের নির্যাতন কমাতে কিংবা সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে একাধিক আঞ্চলিক আলোচনা কিংবা চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো কখনোই বৈশ্বিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট ছিল না। কেননা, কারাবন্দী কিংবা যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াও হাজারো সমস্যা ছিল মানবসমাজে। এত এত কাজের ফাঁকে সারাবিশ্বে একটি বৈশ্বিক মানবাধিকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা অবশ্য বর্তমান সময়ের সাথে তুলনা করলে বোঝা যায়। যদিও তার মানে এই নয় যে, পৃথিবীতে মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু প্রথম থেকে বৈশ্বিকভাবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা কাজ করে গেছেন, তারা আমাদের থেকে অনেকখানি কৃতজ্ঞতা আশা করতেই পারেন। আর তাদের মধ্যে অন্যতম একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্ট লেডি ইলিনর রুজভেল্ট।
Stanley Troutman/AP
এ পরিচয়ের বাইরেও তার আরো অনেকগুলো পরিচয় রয়েছে। ১৯৪৫ সালে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট মারা যাওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন হ্যারি ট্রুম্যান। তিনি নবগঠিত জাতিসংঘের প্রথম মার্কিন ডেলিগেট হিসেবে ইলিনর রুজভেল্টকে দায়িত্বপালনে অনুরোধ করেন। জাতিসংঘে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ইলিনর রুজভেল্ট বৈশ্বিকভাবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত লাগান। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমর্থন আদায়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ান। এছাড়াও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটদের বোঝাতে সক্ষম হন, এটি শুধুমাত্র তার কিংবা জাতিসংঘের সফলতা নয়, বরঞ্চ এটি ডেমোক্রেটদের অর্জনের তালিকা মর্যাদাপূর্ণ করবে।
১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরের ১০ তারিখ। জাতিসংঘ অধিবেশনে চূড়ান্ত বৈশ্বিক মানবাধিকার ঘোষণা পাঠ করেন ইলিনর রুজভেল্ট। এই কারণেই প্রতি বছর দিনটি বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালন করা হয়। যদিও একই বছরের সেপ্টেম্বরে প্যারিসে বিশ্ব মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে এক বক্তৃতাকালে ইলিনর রুজভেল্ট বলেন,
যে সমস্ত লোক স্বাধীনতার ঝলক দেখেছে, তারা ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের জন্য এটি সুরক্ষিত করতে পারে। এছাড়াও মানুষ হিসেবে মানুষকে যে সম্মান দেয়া হচ্ছে, তা যদি কেউ অস্বীকার করে তবে তা আজীবন অব্যাহত থাকবে এবং এটি কখনোই স্বীকার করা হবে না।
মানবাধিকার সমর্থনের মাধ্যমে যুদ্ধ প্রতিরোধ
১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসে ৫১টি দেশ মিলে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার কয়েকমাস পরই প্রতিষ্ঠিত হয় সংস্থাটি। মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে দু'টি বিশ্বযুদ্ধ, প্রথম পারমাণবিক বোমা হামলা, অভিবাসী সংকটের মতো বিষয়গুলো যখন তৃতীয় আরো একটি বিশ্বযুদ্ধের সংকেত দিচ্ছিল, ঠিক তখন জাতিসংঘ বিশ্ব নেতাদের মানবজাতির কল্যাণে এক হতে আহ্বান জানিয়েছিল। অন্যদিকে, এ সংস্থায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে ইলিনর রুজভেল্ট নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়ে ধ্বংসপ্রায় পৃৃথিবীতে কাজে নেমে পড়েন।
প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ১৯৪৫ সালে মিসেস রুজভেল্টকে জাতিসংঘের মার্কিন প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করার অনুরোধ জানান। এরপর আর নিজের স্বপ্ন প্রতিষ্ঠায় পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা আমেরিকার গণ্ডি পেরিয়ে তার সুখ্যাতি তখন পৌঁছে গিয়েছিল ইউরোপ, এশিয়া এবং সুদূর আফ্রিকা মহাদেশে। ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট থাকার সময় থেকেই সেবামূলক কাজে জড়িত ছিলেন মিসেস রুজভেল্ট। ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত রুজভেল্ট প্রশাসনের হয়ে দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা এবং নাগরিক অধিকার আদায়ে সর্বদা জনমানুষের সাথে মিলেমিশে কাজ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে ছুটে গিয়েছেন ইউরোপ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।
১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে ইলিনর রুজভেল্ট জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সভাপতির দায়িত্ব পান। একই বছর তিনি বৈশ্বিক মানবাধিকার ঘোষণায় একটি খসড়া তৈরির কাজ শুরু করবেন বলে জানান। আর কাজটি করার জন্য তার থেকে যোগ্য কেউ তখনকার কমিটিতে ছিলেন না। কেননা, দুটো বিশ্বযুদ্ধে তিনি পৃথিবীর ক্ষয়ক্ষতি দেখেছেন। এতে করে বৈশ্বিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কোন কোন বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া দরকার, তা তিনি ভালোভাবে জানতেন। এছাড়াও সদ্যপ্রয়াত প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সহধর্মিনী হওয়াতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইলিনর রুজভেল্টের সেবামূলক কাজের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক এবং স্কলার এলাইডা ব্ল্যাক। যুদ্ধ চলাকালে মিসেস রুজভেল্ট মার্কিন যোদ্ধাদের খাবার পরিবেশন করেছিলেন। এছাড়াও ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত সেন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে আটকে পড়া নৌযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছিলেন তিনি। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ ও আমেরিকায় ধ্বংসযজ্ঞ দেখে সবসময় যুদ্ধের বিরোধিতা করে মানবতার লক্ষ্যে মানুষকে একতাবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন তিনি। ইলিনর রুজভেল্ট পেপার্সে প্রোজেক্টে কাজ করতে গিয়ে এই বিষয়গুলো খুঁজে পান মিলার সেন্টারের এই স্কলার। যদিও ইলিনর রুজভেল্ট নিজে পত্রিকায় তার ভ্রমণ সম্পর্কে লিখতেন। ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির একটি ক্যাম্প পরিদর্শনের পর নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন মিসেস রুজভেল্ট। সেখানে হলোকাস্টের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ইহুদিদের সঙ্গে সাক্ষাত প্রসঙ্গে তিনি লেখেন,
"কবে আমাদের বিবেক জাগ্রত হবে, কখন প্রতিশোধের পরিবর্তে আমরা মানুষের দুর্দশা রোধ করতে কাজ করব?"
বিশ্ববাসীর জন্য ঘোষণাপত্র তৈরি
ইলিনর রুজভেল্টের পক্ষে মানবাধিকারের খসড়া ঘোষণাপত্র তৈরির কাজটি সহজ ছিল না। প্রথমত, তিনি রাজনৈতিকভাবে ডেমোক্রেট ছিলেন বলে নিজ দেশেও প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন একে অপরের বিপরীতে অবস্থান করছিল। এমন পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষকে মানবাধিকারের গুরুত্ব বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাকে।
এছাড়াও জাতিসংঘ সাধারণ সভায় মার্কিন ডেলিগেট হিসেবে কাজ করা স্বদেশী রিপাবলিকান নেতা জন ফোস্টারের মতো লোক ছিলেন যিনি কিনা ডেমোক্রেট নেত্রীর নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। স্বভাবত জাতিসংঘে তার বিরোধিতা করার মতো মানুষের সংখ্যা ছিল একাধিক। আর তাই সবাইকে ডিঙ্গিয়ে কাজটি করতে হতো তাকে।
যেহেতু জন ফোস্টার সহ রিপাবলিকানদের খুশি করতে হতো, সেহেতু মিসেস রুজভেল্ট অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অধিকারসমূহ তালিকায় উল্লেখ করবেন বলে প্রস্তাব দেন। এবং এতে তিনি সফল হন। কারণ রিপাবলিকানরা এটি নিয়ে বিগত বছরগুলোতে বেশ কয়েকদফা দাবি জানিয়েছিল।
বছরখানেকে আগেও যিনি ইলিনর রুজভেল্টের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তিনিই প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন, সঙ্গে ছিলেন মিসেস রুজভেল্ট। দু'জনে সম্মিলিতভাবে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানকে মানবাধিকারের খসড়ায় অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অধিকারের গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হন।
যদিও ঘোষণার আগপর্যন্ত মিসেস রুজভেল্ট যে মানবাধিকার কমিশনের একমাত্র নারী সদস্য ছিলেন, তা কিন্তু নয়। সদ্যস্বাধীন হওয়া ভারতের পক্ষে ঐ কমিশনে দ্বিতীয় নারী হিসেবে যোগদান করেন ডক্টর হানসা মেহতা। ঘোষণাটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ঘোষণাপত্রের প্রথম অনুচ্ছেদে "All men are born free and equal” বাদ দিয়ে “All human beings are born free and equal" লিখতে পরামর্শ দেন ডক্টর মেহতা। এছাড়াও উপমহাদেশ সহ সারাবিশ্বে বাল্যবিবাহ রোধে এই খসড়া ঘোষণাপত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় উল্লেখ করেন তিনি। মূলত জহরলাল নেহেরুর অনুরোধক্রমে জাতিসংঘে নিযুক্ত হয়েছিলেন ডক্টর মেহতা।
এটি অনুমোদনে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ইলিনর রুজভেল্ট ছুটে গিয়েছেন ব্রাজিল, আয়ারল্যান্ড সহ ইউরোপ, আমেরিকার অনেক দেশে। মধ্যপ্রাচ্যেও একাধিকবার ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেয়া রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে দফায় দফায় সাক্ষাৎ করেন। এটি তখনও বাধ্যতামূলক কোনো আইন হিসেবে পাশ হয়নি। তবে সদ্য যুদ্ধের রেশ কাটিয়ে ওঠা দেশগুলোতে আইন প্রণয়নে বেশ কার্যকরী ছিল। ঠিক এ কারণেই বারবার বিভিন্ন দেশে গিয়ে সমর্থন আদায়ে ক্লান্ত হননি মিসেস রুজভেল্ট।
রাশিয়ান ডেলিগেটের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েছেন, লেবাননের কূটনীতিকদের মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েছেন। এমনকি স্বদেশী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন ত্রুটিপূর্ণ আইন সমূহ সংস্কারের বিষয়ে। তিনি যখনই ঘোষণাপত্রে নতুন একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতেন, তখনই সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ ইউরোপের অনেক দেশ একই বিষয়ে মার্কিন আইনের সমালোচনা করত।
পুরো ঘোষণাপত্র প্রস্তুত সম্পন্ন করে ইলিনর রুজভেল্ট ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ৯ তারিখ সন্ধ্যা থেকেই জাতিসংঘ অধিবেশনে তিনি এটি পাঠ করে শোনান। মধ্যরাত থেকে শুরু হয় পক্ষে-বিপক্ষে ভোটগ্রহণ। সৌদি আরব, সোভিয়েত ইউনিয়ন, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ মোট আটটি দেশ পক্ষে বা বিপক্ষে কোনোপ্রকার ভোট দেয়নি। যদিও ফলাফল পেতে ১০ ডিসেম্বর সকাল অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ৪৮-০ ভোটে জাতিসংঘে পাশ হয় বৈশ্বিক মানবাধিকার ঘোষণাটি।
সবার সম্মুখে জয়োল্লাসরত ইলিনর রুজভেল্টকে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। তবে এখানেই শেষ হয়নি তার যাত্রা। ১৯৬২ সালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ মানবাধিকার অক্ষুণ্ণ রাখায় কতটুকু সোচ্চার, সে বিষয়ে নজরদারি করেছেন তিনি। বর্তমানে সারাবিশ্বে মানবাধিকার কতটুকু লঙ্ঘিত হচ্ছে, সে বিষয়ে আলোচনা করার অনেক অনেক কারণ রয়েছে। তবে মিসেস রুজভেল্টের এ তৎপরতা না থাকলে এখন যতটুকু শ্রদ্ধাবোধ এবং শান্তি পৃথিবীতে বিরাজমান, তার ছিটেফোঁটাও হয়তো থাকত না।
This article written about former and the longest-serving First Lady of the United States Anna Eleanor Roosevelt. When her husband Franklin D. Roosevelt died she joined U.N as first ever U.S delegate. In April 1946, she became chair of the U.N. Commission on Human Rights, and took on the task of drafting a human rights declaration for the world.
Necessary sources have been hyperlinked inside the article.
Feature Image Source: UN Photo Archives