উপনিবেশবাদের দিক থেকে দেখলে পুরো আফ্রিকা মহাদেশের রয়েছে বেদনাবিধুর এক ইতিহাস। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথমবারের মতো ব্যবসায়িক কারণে আফ্রিকায় কেবল আগমন ঘটছিল উপনিবেশিক ইউরোপীয় শক্তিগুলোর। আর দশটা উপনিবেশে যা হয়েছিল, আফ্রিকায়ও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বাণিজ্যের নিমিত্তে আসলেও খুব দ্রুত সবকিছু দখল করে নিতে শুরু করে ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে থাকা সশস্ত্র সৈন্যরা। মাত্র ষাট বছরের মধ্যে পুরো একটা মহাদেশের নব্বই শতাংশ অঞ্চল তৎকালীন ইউরোপীয় শক্তিশালী দেশগুলোর কাছে স্বাধীনতা হারিয়েছিল– কী দ্রুততার সাথে ইউরোপীয়রা আফ্রিকার দুর্গম অঞ্চলগুলো দখল করে নিয়েছিল, কল্পনা করা যায়! শুধু তা-ই নয়, আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলকে নিজের উপনিবেশ বানানোর প্রতিযোগিতায় যেন কোনো সংকটের সৃষ্টি না হয়, এজন্য জার্মানির বার্লিনে ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলো একটি সম্মেলনের আয়োজন করে, যেখানে আফ্রিকাকে তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ইতিহাসে একে 'স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
তবে আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রমও আছে। পুরো আফ্রিকার নব্বই শতাংশ অঞ্চলে ইউরোপীয়রা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেও বাকি দশ শতাংশ ছিল স্বাধীন, এই দশ শতাংশে অবস্থান করা দুটো দেশ নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে সফল হয়েছিল। লাইবেরিয়া এবং ইথিওপিয়া– এই দুটো দেশ তাদের ইতিহাসে কখনও বাইরের কোনো দেশের শাসকের দ্বারা শাসিত হয়নি। বিষয়টি কিন্তু মোটেও এরকম নয় যে, ইউরোপীয় দেশগুলো এই দুটি দেশকে নিজেদের উপনিবেশ বানানোর জন্য চেষ্টা করেনি। ইথিওপিয়া দখলের জন্য ইতালি প্রথমে কূটনৈতিকভাবে চেষ্টা চালিয়েছে। এরপর যখন দেখা গিয়েছে ইথিওপিয়ানরা নিজেদের স্বাধীনতা ইতালিয়ানদের হাতে অর্পণে রাজি নয়, তখন রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধে ইতালিয়ানদের পরাজিত করে রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করে ইথিওপিয়ান জনগণ। একতার পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার সংকল্প থাকলে যে আধিপত্যকামী শক্তিকে রুখে দেয়া যায়, লজ্জাজনক পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে বাধ্য করা যায়– ইথিওপিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ইউরোপের দেশ ইতালি আফ্রিকার দিকে নজর দিতে শুরু করেছিল বেশ আগে থেকেই। নিজেদের উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ও আধুনিক সামরিক পরিকল্পনার জন্য তারা প্রাথমিকভাবে বেশ সাফল্য লাভ করে। এরপর যখন 'স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা' তথা আফ্রিকাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার জন্য বাকি ইউরোপীয় দেশগুলো যখন তোড়জোড় শুরু করে, তখন ইথিওপিয়ার রাজা দ্বিতীয় মেনিলিক বুঝতে পারেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে সংগ্রামের পথ বেছে নিতে হবে। বার্লিনে যখন ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে আফ্রিকার বন্টন নিয়ে সম্মেলন হয়, তখন বলা হয়েছিল ইথিওপিয়া ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোর উপর ইতালি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অধিকার লাভ করবে। এই খবর যখন ইথিওপিয়ার রাজা দ্বিতীয় মেনিলিকের কাছে আসে, তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রয়োজনে যুদ্ধ করে হলেও ইতালিয়ানরা তার রাজ্যকে নিজেদের উপনিবেশ বানানোর চেষ্টা করবে। প্রথমদিকে রাজা দ্বিতীয় মেনিলিক সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন যাতে যেকোনো প্রকার যুদ্ধ এড়িয়ে কূটনৈতিকভাবে ব্যাপারটির মীমাংসা করা যায়।
অগ্রসরমান ইতালিয়ান সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে দ্বিতীয় মেনিলিক প্রাথমিকভাবে ইতালির সাথে সমঝোতায় রাজি হন। এই উদ্দেশ্যে ইথিওপিয়ার অভ্যন্তরে 'উচালে' নামের একটি জায়গায় ইতালিয়ান কূটনীতিকদের সাথে দ্বিতীয় মেনিলিকের একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যাকে ইতিহাসে 'ট্রিটি অব উচালে' বলা হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ইতালিকে ইথিওপিয়ার উত্তরের কিছু অঞ্চল, যেমন- বোগোস, হামাসেন ইত্যাদির শাসনভার হস্তান্তর করা হয়, এর বিনিময়ে ইথিওপিয়া ত্রিশ হাজার বন্দুক ও আটাশটি কামান লাভ করে। চুক্তিপত্রের দুটো সংস্করণ তৈরি করা হয়েছিল। একটি ছিল ইথিওপিয়ার জাতীয় ভাষা 'আমহারিক' ভাষায়, অপরটি ইতালিয়ান ভাষায়। চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করার কিছুদিন পর রাজা দ্বিতীয় মেনিলিক ও তার সভাসদরা আবিষ্কার করেন- চুক্তিপত্রের ইতালিয়ান সংস্করণ ও আমহারিক সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য আছে। ইতালিয়ান সংস্করণে ইথিওপিয়াকে ইতালির একটি 'আশ্রিত রাজ্য' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই বিষয়টি ইথিওপিয়ার রাজা দ্বিতীয় মেনিলিককে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ করে তোলে।
রাজা দ্বিতীয় মেনিলিক তৎক্ষণাৎ আক্রমণ করতে চাইলেও পরিস্থিতি তার অনুকূলে ছিল না। ইথিওপিয়ায় ১৮৮৮ সালের দিকে এমন এক মহামারী দুর্ভিক্ষ হানা দেয়, যার কারণে ইথিওপিয়ার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এরকম পরিস্থিতিতে যুদ্ধে জড়ালে পরাজয় ছিল সুনিশ্চিত। তাই রাজা সিদ্ধান্ত নেন- দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পর ইতালিয়ান সেনাবাহিনীর উপর পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ চালাবেন। ১৮৯৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় মেনিলিক ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি নির্দেশ দেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম, এমন সবাই যেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, নিজের মাতৃভূমির স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখে, আর যারা সক্ষম নয়, তারা যেন যুদ্ধে বিজয়ের জন্য প্রার্থনা করে। ইথিওপিয়ায় বিভিন্ন গোত্রের, বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর, বিভিন্ন সংস্কৃতির সমস্ত মানুষ তার ডাকে সাড়া দেয়, স্বতস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। প্রায় এক লাখ সদস্যের লড়াই করার মতো একটি সেনাবাহিনী দাঁড় করিয়ে ফেলা হয় অল্প সময়ের মধ্যে।
ইতালিয়ারা এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তারা বরাবরই ইথিওপিয়ান রাজতন্ত্রের সামরিক শক্তিকে অবজ্ঞা করেছিল। আম্বা অ্যালাগি নামের একটি জায়গায় সর্বপ্রথম ইতালিয়ানরা আক্রমণের শিকার হয়। ইথিওপিয়ানরা সহজেই এই যুদ্ধে জয়লাভ করে। এরপর ম্যাকেলে নামের জায়গায় শুরু হয় দ্বিতীয় যুদ্ধ। ইতালিয়ানরা এবার নিজেদের সামরিক ঘাঁটির চারপাশে শক্তিশালী দুর্গ তৈরি করে। ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী দুর্গের চারপাশে অবস্থান নিয়ে তাদেরকে একঘরে করে ফেলে, এরপর নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গের ভেতরে পানির সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ, ইতালিয়ানদের 'হাতে না মেরে ভাতে মারা'র পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরপর আর উপায় না পেয়ে ইতালিয়ান কমান্ডার আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু রাজা দ্বিতীয় মেনিলিকের কাছে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন, অস্ত্রশস্ত্রসহ নিরাপদের স্বদেশে গমন করতে দিতে হবে তার সৈন্যদের ইথিওপিয়ান রাজা সেই দাবি মেনে নিয়েছিলেন। এরপর আদিগ্রাত ও সাউরিয়া– দুটো জায়গায় ইথিওপিয়ানদের কাছে আধুনিক ইতালিয়ান সামরিক বাহিনী পরাজিত হয়।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবাতে ইতালি ও ইথিওপিয়া দুই দেশের মধ্যে প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। ইতালিয়ানরা তাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়, ইথিওপিয়ার যেসব অঞ্চলে তাদেরকে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেয়া হয়েছিল, সেসব অঞ্চল থেকে তারা ইতালিয়ান সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়- তারা ইথিওপিয়াকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এই যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে ইতালিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় রদবদল ঘটে। ইথিওপিয়ায় ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে নিয়ে তৎকালীন ইতালিয়ান প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্সেসকো ক্রিস্পি পদত্যাগ করেন। পুরো আফ্রিকায় যখন ইথিওপিয়ার বিজয়ের কথা ছড়িয়ে পড়ে, তখন আফ্রিকার দেশগুলোর মাঝে ইথিওপিয়ার ভাবমূর্তি দারুণভাবে উজ্জ্বল হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে, ১৯৩৬ সালে পূর্বের লজ্জাজনক পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ইতালির কুখ্যাত একনায়ক বেনিতো মুসোলিনি সামরিক হামলা চালান ইথিওপিয়ায়। এবার ইতালি জয়লাভ করে, কিন্তু তাদের দখলদারিত্ব খুব বেশিদিন স্থায়িত্ব লাভ করেনি। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, ইতালিয়ানরা এই সময়ে কোনো কার্যকরী 'উপনিবেশিক প্রশাসন' তৈরি করতে পারেনি ইথিওপিয়ায়, তাই এই সময়ে ইথিওপিয়া ইতালির উপনিবেশ ছিল, এটা বলা যাবে না। বরং একে শুধুমাত্র সামরিক দখলদারিত্ব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তারা। ইথিওপিয়ার স্বাধীনতার সংগ্রাম আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়, মাতৃভূমির স্বাধীনতার প্রশ্নে এক এবং একাট্টা থাকলে বাইরের শত্রুদেশ কখনই স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার প্রশ্নে জয়ী হতে পারবে না।
Language: Bangla
Topic: How Ethiopia saved herself from colonial invaders?
Reference:
১) 124 years ago, Ethiopian men and women defeated the Italian army in the Battle of Adwa - QZ
২) How did Ethiopia resist colonization? - Sidmartin Bio
৩) Countries in Africa Considered Never Colonized - ThoughtCo
৪) Why did Ethiopia resist European colonization? - Janetpanic