Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আইনের সহায়তায় ৫,০০০ শিশুকে কালোবাজারে বিক্রি করে দেওয়া জর্জিয়া ট্যানের গল্প

ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের একপাশে ফেলে রাখা ছোট্ট একটা খাটে শুয়ে অবিরত কাশছিল বাচ্চাটি। চোখের সামনে সন্তানের এই দুর্দশা দেখে যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির দরিদ্র, হতভাগ্য সিঙ্গেল মাদার আলমা সিপল খুব অসহায়বোধ করতে লাগলেন। দশ মাস বয়সী শিশুসন্তান ইরমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন, সেই আর্থিক সঙ্গতিও তার নেই। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে কী করা যায় ভাবছিলেন তিনি। হঠাৎ করে দরজায় বেশ জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ হলো। দ্রুত পায়ে দরজার কাছে গিয়ে হাতল মুচড়ে দেখলেন এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন বাইরে। ধূসর চুল, গোল ফ্রেমের চশমা আর চোখে-মুখে কঠোর অভিব্যক্তি সম্পন্ন সেই নারীই যে তার জীবনের চাকা ঘুরিয়ে দেবেন- তা যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতেন আলমা, তবে সেই মুহূর্তেই হয়তো তাকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিতেন!

পত্রিকার পাতায় জর্জিয়া ও তার প্রতিষ্ঠান; Source: taringa.net

নিজেকে তিনি পরিচয় দিলেন স্থানীয় এক এতিমখানার পরিচালক হিসেবে। এখানে একটি অসুস্থ বাচ্চার খোঁজ পেয়ে ছুটে এসেছেন বলে আলমাকে জানান তিনি। স্বয়ং ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে আসা মহিলাটিকে নিয়ে ভেতরের ঘরে ছুটে গেলেন তিনি। অসুস্থ বাচ্চার কাছে তাকে নিয়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাটির প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য শিশুটিকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন মহিলাটি। আলমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন ভুলেও যেন সে তাদের পিছু না নেয়। কারণ একবার যদি নার্সরা টের পায় বাচ্চাটির মা বেঁচে আছে, তাহলেই মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হবে আলমাকে। নিঃস্ব সেই মায়ের পক্ষে এত বড় ঝুঁকি নেয়া কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। বাচ্চাটিকে কোলে করে খাট থেকে উঠিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মহিলাটি। দুদিন পর আলমার কাছে খবর এলো, তার বাচ্চাটি মারা গেছে। এরই মধ্যে ইরমাকে পাচার করে দেয়া হয় ওহিওর একটি বাড়িতে, তার দত্তক পিতা-মাতার কাছে। এরপর প্রায় ৪৫ বছর পর মেয়ের মুখখানা দেখার সৌভাগ্য হয় পাগলপ্রায় মা আলমার। এমনি আরও প্রায় ৫,০০০ শিশুচুরির ঘটনার সাথে জড়িয়ে থাকা সেই নারীর নাম জর্জিয়া ট্যান।

ত্রাণকর্তার বেশে ইরমাকে রক্ষা করতে আসা জর্জিয়া ট্যান একজন শিশু চোর। বিংশ শতাব্দীতে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ঘটেছিল এই ঘটনা। ৩০ বছর ধরে এই পেশায় নিয়োজিত জর্জিয়া প্রায় ৫,০০০ শিশু চুরি করে মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত স্কাউট, বিচারক আর রাজনীতিবিদদের সহায়তায় অবাধে এ কাজ করে যাচ্ছিল সে। নবজাতক শিশু থেকে শুরু করে স্কুলে যাওয়া কিশোরদেরও রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যেত জর্জিয়া। সামান্য আইসক্রিমের লোভ দেখিয়ে পাল্টে দিত তাদের জীবনের চাকা। ছেলে ধরার পেশায় মুনশিয়ানা দেখিয়ে বাচ্চাদের ব্যাপারে বৈধ কাগজপত্রও তৈরি করে ফেলত অসাধু আইনের লোকজনের সাহায্যে। সম্প্রতি তার সম্পর্কে নথিপত্র ঘেঁটে চমকপ্রদ সব তথ্য আবিষ্কার করেছেন বারবারা বিসান্টজ রেমন্ড। যত্নের সাথে জর্জিয়ার ভিক্টিম ও তাদের পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে খুঁজে বের করে তাদের কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্য পেয়ে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, জর্জিয়া অন্ততপক্ষে ৫ হাজার শিশু চুরি করেছে।

দত্তক নেয়া যমজ দুই কন্যার সাথে জোয়ান ক্রোফোর্ড; Source: kidspot.com

যে সময়টাতে জর্জিয়া তার ব্যবসা চালাত, তখন সারা পৃথিবীর মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ছিল মেম্ফিসে। জর্জিয়া তার হেফাজতে থাকা কিছু মেয়ে শিশুকে উৎপীড়িত হতে এবং কয়েকটি শিশুকে যৌন নিপীড়কের হাতে তুলে দিতে সাহায্য করে। বাবা-মা হওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা দম্পতিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে বাচ্চাগুলোকে তাদের হাতে তুলে দিত সে। একদম কম বয়সী বাচ্চাদেরও কৃষিকাজে সহায়তার জন্য বা বাড়ির চাকর-বাকরের কাজের জন্য বিক্রি করে দেয়া হতো। যারা বিক্রি হতো না, তাদের কপালে জুটত নিরন্তর কষ্ট। খেয়ে না খেয়ে মারধর আর ধর্ষণের শিকার হতে হতো তাদের। সৌভাগ্যবান শিশুরা চলে যেত ধনী পালক বাবা-মার কাছে। হলিউড তারকা লানা টার্নার এবং জোয়ান ক্রোফোর্ড দত্তক নেন যমজ দুটি মেয়ে ক্যাথি আর সিনথিয়াকে। দীর্ঘদিন ধরে বেছে-খুঁটে শেষমেশ এই দুজনকেই পছন্দ হয় তাদের। কিছু বাচ্চাকে নিয়ে ম্যাগাজিনে আর্টিকেল বেরিয়েছিল। আর কিছু বাচ্চা ঠাঁই পেয়েছিল ব্রিটেনে, নতুন পরিবারের কাছে।

এবার প্রশ্ন হচ্ছে, কে এই জর্জিয়া ট্যান আর এতগুলো জীবন নিয়ে পুতুল খেলার স্পর্ধা তার কীভাবে হলো? ১৮৯১ সালে মিসিসিপির হিকোরি এলাকায় জন্মগ্রহণ করা জর্জিয়ার বাবা জর্জ ছিলেন হাইকোর্টের বিচারক। মা বেউলা ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল বাড়ির অভ্যন্তরে জীবন কিন্তু খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না। জর্জিয়ার বাবা ছিলেন বদরাগী, দাম্ভিক আর দুশ্চরিত্রের অধিকারী। শৈশব থেকেই বাবা-মার ঝগড়া দেখতে দেখতে বড় হওয়া মেয়েটি তাদের সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তার ছোটবেলার ছবিতে দেখা যায় চওড়া কাঁধের ফ্ল্যানেল শার্ট আর ট্রাউজার পরে আছে সে। সে সময়কার মেয়েদের জন্য একেবারে বেমানান ছিল সে পোশাক। এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাপ্ত আঘাতের কারণে সামান্য খুঁড়িয়ে চলতে হতো তাকে। সে সময় সমাজসেবাকে নারীদের কাজ বলে গণ্য করা হতো না। কিন্তু চার দেয়ালের এই দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্যই সমাজসেবাকে হাতিয়ার বানিয়ে নেয় জর্জিয়া।

সমাজ সম্পর্কে সে নিজের কিছু তত্ত্ব দাঁড় করায়। প্রজনন সংক্রান্ত তার সে বাণীগুলোর সাথে জার্মানি নাৎসিদের বক্তব্যের বেশ মিল পাওয়া যায়। ধনী লোকজনকে সে ‘সমাজের উচ্চ শ্রেণী’ হিসেবে অভিহিত করেছে। তার মতে, সমাজে দরিদ্র নারীদের ভূমিকা শুধুমাত্র ‘সন্তান জন্মদানকারী’র। ব্যক্তিগত ডায়েরি এবং চিঠিপত্রে তাদেরকে সে গরুর সাথে তুলনা করতেও ছাড়েনি। তার দাবী অনুযায়ী, দরিদ্র লোকজনের কোনো সামর্থ্যই নেই বাচ্চাদের মানুষ করার। কাজেই তাদের বাচ্চাদের ‘মানুষ’ করার মহান দায়িত্ব সে তুলে নেয় নিজের হাতে। ‘মিসিসিপি চিলড্রেন হোম ফাইন্ডিং সোসাইটি’তে কাজ নেয়ার পর তার এতদিনের সঞ্চিত বিশ্বাসগুলোকে সে কর্মে রূপ দেয়। সে সময়টায় যুক্তরাষ্ট্রে সন্তান দত্তক নেয়ার প্রথা খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না। জর্জিয়া নিজ দায়িত্বে এই প্রথাটির সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেয়। শুরুতে সে শুধুমাত্র এতিম বাচ্চাদের দত্তক নেয়ার জন্য পালক বাবা-মা আহ্বান করতো। কিন্তু খুব দ্রুতই তার মাথায় ঢুকে যায়, একটি সন্তানের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা দম্পতির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা সম্ভব।

জর্জিয়া পরিচালিত এতিমখানা; Source: nypost.com

১৯২০ সালের দিকে পালক সন্তান গ্রহণের বিষয়ে কড়াকড়ি কোনো আইন না থাকায় এবং বিচারকের পদে নিজের বাবাকে পেয়ে জর্জিয়া সানন্দে গরীব নারীদের কাছ থেকে শিশু অপহরণ করে তাদের নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। তার প্রথম দিকের ভিক্টিমে পরিণত হওয়া এক নারী রোজ হার্ভে। ১৯২২ সালের বসন্তের এক সকালে, মিসিসিপি থেকে ফোর্ড চালিয়ে জ্যাসপার কান্ট্রিতে চলে আসে। এখানকার এক কেবিনে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল গর্ভবতী রোজ। তরুণ, বিধবা, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, সর্বোপরি দরিদ্র রোজের পাশে বসে খেলা করছিল তার দু’বছর বয়সী ছেলে অনিক্স। কালো চুল আর বাদামি চোখের সহজ শিকার অনিক্সকে গাড়িতে উঠিয়ে শহরে নিয়ে আসে জর্জিয়া। তার বাবা বৈধ কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে ঘোষণা করে, মা হিসেবে রোজ অযোগ্য এবং অনিক্সকে সে ত্যাজ্য করেছে। বেশ বড়লোকের ঘরে জায়গা পায় অনিক্স। জর্জিয়াদের বিরুদ্ধে মামলা করে রোজ, কিন্তু শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে টিকতে না পেরে সন্তানের অভিভাবকত্ব হারায় হতভাগ্য মা।

১৯২৪ সালে টেনেসি চিলড্রেন হোম সোসাইটির সাথে যুক্ত হয় জর্জিয়া। বাচ্চা চুরির পার্ট-টাইম চাকরিটিকে এবার সে ব্যবসায় পরিণত করে। “এখনো আমি হলঘরে তার পায়ের আওয়াজ শুনতে পাই। বড় বড় পায়ে লেসের জুতো পরত সে,” জানান চিলড্রেন হোমের প্রাক্তন এক বাসিন্দা। “সে সারা রাত উপর-নিচ করে বাচ্চাদের দেখাশোনা করতো। বিশেষ করে পরদিন যাদের বিক্রি করে দেয়ার কথা থাকত, তাদের দেখভালে কোনো ত্রুটি রাখত না”। মেম্ফিসে এসে খুব দ্রুতই সেখানকার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মেয়র, এডওয়ার্ড হাল ক্রাম্পকে নিজের যোগসাজশের সঙ্গী বানিয়ে নেয় জর্জিয়া। ১৯২৬ সালের মধ্যে নিজস্ব একটি এতিমখানা তৈরি করে সে।

ততদিনে অ্যান অ্যাটউড হলিন্সওর্থ নামে এক সমকামী পার্টনার জুটে যায় জর্জিয়ার। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাচ্চা চুরি করতে তাকে সহায়তা করতো অ্যান। জর্জিয়া নিজেও একটি মেয়েকে দত্তক নেয়, নাম তার জুন। জুনের মেয়ে ভিচ্চি জানায়, “মার মুখে শুনেছি জর্জিয়া খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ ছিল। তার কাছ থেকে বাহুল্য কোনো উপহার কখনো পায়নি মা। আমি জানি না কেনই বা মাকে দত্তক নিতে গিয়েছিল সে।” ৩০ এর দশকে নিঃসন্তান দম্পতিদের কাছে প্রায় ১ লক্ষ ডলার করে দাবী করতে শুরু করে জর্জিয়া। এবার প্রশ্ন হচ্ছে একেবারেই বাধা-বিঘ্ন ছাড়া একের পর এক চুরি কীভাবে করে যাচ্ছিল সে?

শিশু চোর হিসেবে বেশ সমালোচিত হয় জর্জিয়া; Source: taringa.net

কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যেত, সিঙ্গেল বাবা বা মা তাদের বাচ্চাকে নার্সারি স্কুলে ছেড়ে যেত সকালবেলা। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাচ্চাকে তুলে নিতে গিয়ে জানতে পারল, সমাজসেবী কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের বাচ্চার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। আর বাবা-মা দরিদ্র হলে বাচ্চার ভালোর কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে তাদের নিয়ে যেত বিক্রি করার উদ্দেশ্যে। যেসব বাচ্চা দেখতে বেশি ভালো ছিল, তাদেরকে লেসের জামা-কাপড় পরিয়ে ফিটফাট অবস্থায় পালক বাবা-মায়ের সামনে হাজির করে অনেক টাকা বাগিয়ে নিত জর্জিয়া। বয়সে একটু বড় শিশুদের নির্দেশ দেয়া হতো- ‘লোকটার কোলে বসে তাকে ড্যাডি বলে ডাকো’। তবে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল নবজাতক শিশুদের। মাতৃসদনগুলোর নার্সদের টাকা খাইয়ে বাচ্চা চুরি করতো জর্জিয়া, আর নার্সরা গিয়ে বাচ্চার প্রকৃত মাকে জানাত, “আপনি মৃত বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন। তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।”

আইরিন গ্রিন নামক এক নারীর সাথেও একই ঘটনা ঘটেছিল। নার্সের এই কথার প্রতিবাদে তিনি বলেন, “ওকে আমি কাঁদতে শুনেছি!” মৃতদেহটি দেখার জন্য জোর করলে তাকে বলা হয় শেষকৃত্য হয়ে গেছে। জর্জিয়া ও তার লোকেরা এমনকি জন্মসনদও জাল করতো। ১৯৪৩ সালে মেরি রেড নামক আরেক নারী তাদের ভিক্টিমে পরিণত হয়। ১৮ বছর বয়সী মেরি এক ছেলে সন্তানের জন্ম দেয়। প্রায় বেহুঁশ মেরিকে দিয়ে সই করিয়ে নেয়া হয় কিছু ‘রুটিন পেপারে’। জ্ঞান ফিরে বাচ্চার খোঁজ করতে করতে তার বাচ্চাটি পৌঁছে যায় নিউ জার্সিতে। আইনজীবীর সাহায্য নিলে তাকে দেখিয়ে দেয়া হয়, বাচ্চাটিকে সে সজ্ঞানে জর্জিয়াদের প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করে দিয়েছে! প্রমাণস্বরূপ তার স্বাক্ষর করা কাগজপত্রের বিপরীতে কিছুই আর বলার থাকে না তার পক্ষের আইনজীবীর।

বাড়ন্ত শিশুদের নিয়ে মাঝে মাঝে ঝামেলায় পড়তে হতো জর্জিয়ার। দত্তক বাবা-মাকে খুশি করতে না পারলেই শুনতে হতো নানা ধরনের গঞ্জনা। তরুণ জয় বার্নারকে তার পালক বাবা বলেছিল, “৫ হাজার ডলার দিয়ে তোমাকে নিয়ে এসেছি। এই টাকা দিয়ে একটা কুকুর কিনলেও তোমার চেয়ে ভালো কাজের হতো সেটা। তোমাকে জন্ম দিয়েই পাপ করেছে তোমার বাবা-মা”। পরবর্তীতে জয় অনেক খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে, ১৯২৫ সালে সপরিবারে নৌভ্রমণের সময় আসল বাবা-মায়ের কাছ থেকে চুরি করে আনা হয় তাকে। ১৯৩২ সালে জিম ল্যাম্বার্টকে চুরি করে বিক্রি করে দেয়া হয় এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে। তার ঠিক দু’বছরের মাথায় আলাদা হয়ে যায় তার পালক বাবা-মা। নতুন মা জিমকে একদমই পছন্দ করতো না। বেসমেন্টে হুক দিয়ে তাকে ঝুলিয়ে রাখত নতুন মা। হায়রে ভাগ্য!

জর্জিয়ার কাছ থেকে শিশু দত্তক নেয়া তারকারা; Source: nypost.com

১৯৩৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি কোনায় জর্জিয়ার সরবরাহ করা শিশু পৌঁছে যায়। এক সমাজসেবী জানান, “বাচ্চারা ভালো থাকবে এমন কোনো জায়গায় তাদের পাঠাতে হবে, এই চিন্তা কখনোই জর্জিয়ার মাথায় ছিল না। সে শুধুমাত্র অর্থ আর প্রভাব-প্রতিপত্তির নেশায় এই কাজ করে বেড়াত।” দত্তক নেয়ার এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বাজে ছিল সিঙ্গেল বাবা কর্তৃক মেয়েশিশুদের কিনে নেয়া। রেমন্ডের ধারণা, তাদের বেশিরভাগই ছিল শিশু যৌন নিপীড়ক। আরও টাকার নেশায় পাগল হয়ে স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া শুরু করে জর্জিয়া, ‘এই ক্রিসমাসে জীবন্ত উপহার পেতে চান? যোগাযোগ করুন এই ঠিকানায়’। ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার প্রচারণা কৌশল হিসেবে সব জায়গায় সে বিজ্ঞাপন দিতে থাকে, ‘কষ্ট করে বাচ্চা জন্ম দেয়ার চেয়ে তৈরি বাচ্চা ঘরে নিয়ে যাওয়া অনেক সহজ। বাচ্চা আর ঘর- দুটোই আমরা অনেক ভেবেচিন্তে নির্বাচন করি। কাজেই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে সেরা শিশুটি।’

দুর্নীতিতে মোড়া সে সমাজের প্রেস তাকে ‘দত্তক প্রথার অগ্রদূত নারী’ হিসেবে অভিহিত করে। ইলিনর রুজভেল্ট তার শিশু কল্যাণ অধিদপ্তরে কাউন্সিলর হিসেবে নিয়োগ দেন জর্জিয়াকে। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান তার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতেন তাকে। কিন্তু ১৯৪০ সালের দিকে এসে দেশটিতে নবজাতক শিশু মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় অবধারিতভাবে আঙুল উঠতে থাকে জর্জিয়ার দিকে। এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ দত্তক শিশুর সংখ্যা বাড়ার হারের সাথে সমানুপাতিক হারে শিশু মৃত্যুর হার বাড়তে থাকার কারণ খুঁজতে গিয়ে জর্জিয়া সম্পর্কে বলেন, “শীতল রক্তের এক দানব বৈ আর কিছুই নয় জর্জিয়া। যত বেশি ক্ষমতা সে হাতে পাচ্ছে, ততই তার অপব্যবহারের মাত্রাও বেড়ে চলেছে। সবাইকে সে নিজের অপকর্মের জালে কুক্ষিগত করে রেখেছে।”

এক মায়ের কোল খালি করে অন্য একজনের কাছে শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়াই ছিল জর্জিয়ার কাজ; Source: taringa.net

১৯৫০ এর দিকে জর্জিয়ার ব্যবসার খুঁটিনাটি নিয়ে তদন্তে নামে সরকারি কর্মকর্তারা। রাষ্ট্রীয় তদন্তকারী রবার্ট টেইলর তার প্রতিবেদনে লেখেন, ‘জর্জিয়ার এতিমখানার আশেপাশের এলাকায় মশা-মাছির মতো মারা যাচ্ছে শিশুরা’। এতিমখানার পুরুষ কর্মচারীরা পাশের জঙ্গলে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে গিয়ে নানাভাবে নিপীড়ন চালাত। বেশ কিছু বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিল। বিক্রি না হওয়া শিশুরা আলোর মুখও দেখত না। এই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা সেখানে গিয়ে দেখতে পায়, বাগানে কোনোমতে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে এক শিশুর লাশ। ১৯৪৫ সালে কলেরা সংক্রমণে চার মাসের মধ্যে মারা যায় ৪০-৫০টি শিশু। তাদের চিকিৎসার জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।

তদন্তের জাল গুটিয়ে আসছিল চারদিক থেকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ঠিকই আইনের হাতকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছিল জর্জিয়া। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার ঠিক তিন দিন আগে পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়, জর্জিয়া মোটেই কোনো দেবদূত ছিল না। তাকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এমন শারীরিক অবস্থাও তার ছিল না। ১৯৫০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, ভোর ৪:২০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে কালোবাজার দাপিয়ে বেড়ানো এই নারী। তার মৃত্যুর পর আসল বাবা-মায়ের সাথে দেখা হয় এতিমখানায় আটকে পড়া বেশ কিছু শিশুর। শুরুতে যে আলমার কথা বলা হয়েছিল, ৪৫ বছর পর তিনিও খুঁজে পান ইরমাকে। কিন্তু এত বছর পর মা-মেয়ের মধ্যে গড়ে ওঠেনি কোনো সহজ সম্পর্ক। আফসোস করে বলেন আলমা, “আমার অন্তরে সারাজীবনের জন্য একটা ছিদ্র থেকেই যাবে”

ফিচার ইমেজ- nypost.com

Related Articles