Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যেভাবে পৃথিবীর অধিকাংশ শহরের আগে বিদ্যুৎ এসেছিল হনুলুলুতে

হাওয়াই বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য। ১৯৫৯ সালে পঞ্চাশতম অঙ্গরাজ্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের যোগ দেয় এ দেশটি। কেউ কেউ হাওয়াইয়ের কথা না শুনলেও, এর রাজধানী ‘হনুলুলু’ শহরটির নাম হয়তো ঠিকই শুনেছে। হনুলুলু নামটি যতই আজগুবি ঠেকুক না কেন, একদিক থেকে কিন্তু এ শহরটি বেশ এগিয়ে আছে। পৃথিবীর অধিকাংশ শহরের আগেই বিদ্যুৎ এসেছিল এখানে, এমনকি ইউরোপ আমেরিকার অনেক শহরেরও আগে। সেটি কীভাবে সম্ভব হলো? 

১৮৮১ সালের কথা। হাওয়াইয়ের রাজা ডেভিড কালাকাউয়া ঠিক করলেন, পৃথবী ভ্রমণে বের হবেন। সেবার তিনি ভারত, মিশর, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র হয়ে গোটা পৃথিবীই সফর করেন বলা যায়। তখনকার রাজাদের জন্য এটি ছিল একটি ব্যতিক্রমী বিষয়। কালাকাউয়া অবশ্য অন্যদের থেকে কিছুটা ব্যতিক্রমই ছিলেন। অন্যরা যেখানে নিজের রাজ্য শোষণে ব্যস্ত থাকতো, সেখানে পৃথিবীতে কোথায় কী হচ্ছে এবং সেগুলো কীভাবে তার দেশে প্রয়োগ করা যায় এ বিষয়ে আগ্রহী থাকতেন তিনি।

রাজা কালাকাউয়া; Image Source: Wikimedia Commons

১৮৮১ সালের আগস্ট মাসে তিনি যখন প্যারিসে আসেন, তখন ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোজিশন অব ইলেকট্রিসিটি আয়োজিত হচ্ছিল সেখানে। ডায়নামো, ব্যাটারি, বৈদ্যুতিক বাতি ইত্যাদি নিয়ে সাম্প্রতিক উদ্ভাবনগুলো প্রদর্শিত হচ্ছিল এ অনুষ্ঠানে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন গবেষকরা তাদের গবেষণাপত্র নিয়েও আলোচনা করেছিলেন এখানে। রাজা কালাকাউয়া এ প্রদর্শনীতে যোগ দিয়েছিলেন। প্রদর্শনী দেখে বিদ্যুৎ বিষয়ে আরো জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি।

এরপর ভিয়েনাতে এসে তিনি পরিচিত হন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সহপ্রতিষ্ঠাতা জর্জ জোনসের সাথে। জোনস রাজার বিদ্যুৎ বিষয়ে আগ্রহের কথা জেনে তাকে এডিসনের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখ রাজা তার অ্যাটর্নি জেনারেল আর্মস্ট্রং ও জর্জ জোন্স এডিসনের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান তার নিউইয়র্কের অফিসে। এডিসন রাজাকে বৈদ্যুতিক আলোর প্রযুক্তিগত দিকগুলো ব্যাখ্যা করেন। পাশাপাশি বিদ্যুৎ শক্তি বিক্রির ব্যবসা প্রসঙ্গেও আলোচনা করেন।

তখন হনুলুলুর রাস্তা আলোকিত করার জন্য কেরোসিনের বাতি ব্যবহার করা হতো। রাজা কালাকাউয়া এ অবস্থার উন্নয়নে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তিনি বাতির জন্য গ্যাস নাকি বিদ্যুত, এ দুটির কোনটি ব্যবহার করবেন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। রাজা এডিসনকে বলেন, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি বৈদ্যুতিক আলোকসজ্জ্বার একটি সম্পূর্ণ ব্যবহারিক প্রদর্শনী দেখতে চান। এটি দেখার জন্য আরো পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাকে।

পত্রিকায় কালাকাউয়া ও এডিসনের সাক্ষাৎ; Image Source: pinterest.com

২১ জুলাই, ১৮৮৬ সালে হনুলুলুর ব্যবসায়ী চার্লস অটো বার্জার এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। প্রায় পাঁচ হাজার দর্শক, ব্যান্ড সঙ্গীত ও সামরিক প্যারেডের সাথে জমকালো আয়োজনে আয়োজিত হয় এ প্রদর্শনী। কালাকাউয়ার তৈরি করা প্রাসাদ আয়োলানি প্যালেস (Iolani palace) সেদিন আলোকিত হয়েছিল বৈদ্যুতিক আলোয়। এর কয়েক মাস পর রাজার জন্মদিন উপলক্ষেও সম্পূর্ণ রাজপ্রাসাদ ও এর চারপাশ বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত করা হয়।

এখানে একটি মজার বিষয় হলো আয়োলানি প্যালেসে যে বৈদ্যুতিক আলোকায়ন হয়েছিল সেটি কিন্তু হাওয়াইতে সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক আলো ছিল না। এর কৃতিত্ব ক্লাউস স্পার্কলস নামের একজন চিনি ব্যবসায়ীর। তিনি রাত-দিন সবসময় কাজ চালু রাখার জন্য বৈদ্যুতিক আলোকায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন তার ফ্যক্টরিতে। রাজা ও তার পরিবারের সদস্যবর্গ বেশ কয়েকবার তার এ বৈদ্যুতিক আলোকায়ন দেখতে গিয়েছিলেন। দিনের আলোর মতো এ কৃত্রিম আলোক-ব্যবস্থা উচ্ছ্বাসিত করেছিল সবাইকে। তবে তার এ ব্যবস্থা কেবল তার ফ্যাক্টরিতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

হাওয়াইতে বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দুটি বড়সড় প্রতিবন্ধকতা ছিল। একটি হলো এ দ্বীপদেশে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা আর অন্যটি হলো এর জন্য সঠিক জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা। ডায়নামো, টারবাইন, পাইপ ভাল্ভ সহ ইত্যাদি যন্ত্রপাতি সব আনা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য হাওয়াইয়ের ভূখণ্ড ও জলবায়ুর কথা মাথায় রেখে জলবিদ্যুৎই ছিল স্বাভাবিক পছন্দ। প্রাসাদ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নুউ’উওয়ানু জলপ্রপাত থেকে প্রথম বৈদ্যুতিক আলোক স্টেশনের বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। কিন্তু এর জল প্রবাহ সবসময় একই রকম থাকতো না, তাই পরবর্তী বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা হয়েছিল।

আয়োলানি প্যালেস; Image Source: flickr.com/Scotsman_in_Hawaii

তাদের বিদ্যুতের এ জ্বালানি নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। যখন রাজা এডিসনের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তখন এ বৈদ্যুতিক জ্বালানি নিয়ে কথা ওঠে। এ সময় রাজার এটর্নি জেনারেল এডিসনকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কি আপনার বৈদ্যুতিক তারকে সাগরতল দিয়ে আনতে পারবেন?”

এডিসন জবাব দেন, “হ্যাঁ। কিন্তু এতে খরচ অনেক বেশি হবে।”

এরপর তিনি কৌতুক করে বলেন, “নাহলে আপনি আমাদের রাজ্যে আসতে পারতেন। আমাদের একটি বিশাল আগ্নেয়াগিরি আছে। এটি থেকে প্রতিদিন হাজার টন কয়লা উৎপন্ন হয়। আপনি আপনার বয়লারটি এর ওপর বসিয়ে দিয়েই পুরো দেশের জন্য বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারবেন।”

এডিসন তার কৌতুকটি ধরতে না পেরে, তাকে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আপনারা কি সেখান থেকে আপনাদের কয়লা সংগ্রহ করেন?”

তারা নেতিবাচক জবাব দিয়ে বলেন যে না বরং তারা অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানি করেন। তবে আগ্নেয়াগিরিটি নিয়ে তাদের উচ্চাশা আছে। এ ব্যর্থ কৌতুকটি বেশ হাসির খোরাক যুগিয়েছিল সেদিন। উল্লেখ্য যে, তখনো কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া ব্যবহারিকভাবে আসেনি। তাই অনেকে এ ঘটনার উল্লেখ করে, আর্মস্ট্রয়ের বক্তব্যকে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিষয়ে আগ্রহ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু এটিকে আসলে স্রেফ একটি ব্যর্থ কৌতুকই বলা চলে।

যাহোক আবার হাওয়াইতে ফিরে আসি। ১৮৮৬ সালের দিকে এসে কালাকাউয়া তার রাজ্যের বাণিজ্যকে বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এরমধ্যে বিনিয়োগের জন্য বিদ্যুৎ শক্তিসহ অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি বিশেষ গুরুত্ব পেল। এর দুই বছরের মাথায় ১৮৮৮ সালের ২৩ মার্চ, হনুলুলুর রাজপথে পৌঁছে গেল বৈদ্যুতিক আলো। রাজকুমারী কাইয়ুলানি সুইচ টিপে স্ট্রিট-লাইটগুলোতে বৈদ্যুতিক আলোর উদ্বোধন করেন। এরপর ‘ই.ও হল অ্যান্ড সন’ নামের একটি কোম্পানি বাড়ি বাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জেনারেটর প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে।

হাওয়াইয়ান ইলেকট্রিক কোম্পানি; Image Source: staradvertiser.com

১৮৯০ সাল নাগাদ হনুলুলুর প্রায় আটশোটি বাড়ি বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করতে লাগলো। এ সময় পর্যন্ত এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেরই অনেক মানুষ বিদ্যুৎ শক্তির সুবিধা পায়নি। এর এক বছর পর ই.ও হল ‘হাওয়াইয়ান ইলেকট্রিক কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। হাওয়াইয়ান ইলেকট্রিক কোম্পানিই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র বৈদ্যুতিক প্রতিষ্ঠান যা একজন রাজার স্বপ্ন ও উৎসাহে গঠিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজা যা শুরু করেছিলেন, তার চূড়ান্ত রূপ দেখে যেতে পারেননি। ১৮৯১ সালে, ক্যালিফোর্নিয়া ভ্রমণকালে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার পরে তার বোন লিলিউওকালানি রাজ্য পরিচালনার ভার নেন। কিন্তু তার শাসনকাল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৮৯৩ সালে হাওয়াইয়ের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।

তার রাজত্ব শেষ হওয়ার মাত্র পাঁচদিন আগে, রানী লিলিউওকালানি একটি বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আইন প্রণয়ন করেন। দশ বছরের জন্য একমাত্র আবেদনকারী হাওয়াইয়ান ইলেকট্রিক কোম্পানিকে হনুলুলুর মানুষকে বিদ্যুৎ শক্তি সরবরাহের ইজারা দেওয়া হয়। তবে মূল পাওয়ার স্টেশন ও রাস্তার বাতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্ব সরকারেরই থাকে।

এভাবে রাজপরিবারের হাত ধরে হাওয়াইতে বিদ্যুতের যাত্রা শুরু করে। এ গল্পটি যতটা না প্রযুক্তিগত বিস্তারের, তার চেয়েও বেশি একজন আধুনিক মনন সম্পন্ন রাজার। যিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন, আগ্রহী ছিলেন নিজের দেশের মানুষকে আধুনিক প্রযুক্তির সুফল পৌঁছে দিতে। তার কৌতূহল ও আন্তরিক আগ্রহের কারণেই, ইউরোপ আমেরিকার অনেক শহরের আগেই একটি প্রত্যন্ত দ্বীপ হাওয়াইর শহর হনুলুলুর মানুষ পরিচিত হয়েছিল বিদ্যুতের সাথে।   

ফিচার ইমেজ- pentaxforums.com

Related Articles